দ্বিজাতি তত্ত্ব সমস্যার মীমাংসা না হওয়ায় ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষ ভাগ হয় দুটি স্ব-শাসিত দেশ ভারত ও পাকিস্তান নামে। আমরা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হই। এখানেও দু’টি দেশ- পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান। এখানেও দু’দেশের মধ্যে শুরু হয় নতুন টানাপোড়েন। এর মধ্যে প্রথম বৈরিতা শুরু হয় পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ থেকেই। দীর্ঘ প্রায় ২৪ বছর ধরে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ফুঁসে উঠতে থাকে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র লাভ করি আমরা। যার নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র বিনির্মাণে এমন অবদানের জন্য বাংলাদেশের জনগণ তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধীতে ভূষিত করে।
এবার এ আলোচনার বাইরে মূল আলোচনায় আসি। একজন সাধারণ গৃহবধূ কিভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘দেশনেত্রী’ হয়ে উঠলেন, তা নিয়ে। ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট ব্রিটিশ ভারতের জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেন বেগম খালেদা জিয়া। মাত্র ১৫ বছর বয়সে, ১৯৬০ সালে, পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুর শহরে খালেদার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ২৪ বছর বয়সী সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান। (তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া)।
বিয়ের পর থেকে খালেদা জিয়া ছিলেন একজন গৃহবধূ। ১৯৮১ সালের ৩০ মে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হন।
জিয়াউর রহমানের সঙ্গে খালেদা জিয়ার ২১ বছরের বর্ণাঢ্য সংসার জীবনে নেমে আসে অমানিশার কালো আঁধার। ছোট দু’সন্তান- তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমানকে নিয়ে শুরু হয় অন্তহীন সংগ্রামের জীবন। প্রথম দিকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন খালেদা জিয়া। একদিকে জিয়াউর রহমানের গড়ে তোলা নতুন রাজনৈতিক দলের হাল ধরা, অন্যদিকে সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তা।
এমন পরিস্থিতিতে বহু নাটকীয়তার পর দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপিতে যোগদান করেন খালেদা জিয়া। সে বছরেরই ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচএম এরশাদ নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে যখন ক্ষমতাচ্যুত করেন, তখন তার তীব্র প্রতিবাদ জানান বেগম জিয়া।
জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়া (১৯৭৯ সাল) ফাইল ছবি
১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে বিএনপির সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। ওই বছরের ১ এপ্রিল দলের বর্ধিত সভায় জীবনের প্রথম বক্তৃতা করেন। বিএনপির সাংগঠনিক বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যেই দলের হাল ধরে ১৯৮৩ সালে ৭ দলীয় ঐক্যজোট গঠন করেন। শুরু করেন স্বৈরশাসক এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন।
বেগম জিয়া মূলত ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বরে ৭ দলীয় ঐক্যজোটের মাধ্যমে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। এর মধ্যে ১৯৮৪ সালের ১০ তিনি দলের চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন।
১৯৮৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ দফা আন্দোলন চলতে থাকে। কিন্তু ২১ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগ হঠাৎ করে এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ছেদ পড়ে। নির্বাচন প্রশ্নের বিরোধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫ দল ভেঙে ৮ দল ও ৫ দলে ভাগ হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৮ দল ও জামায়াত ’৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়।
কিন্তু বেগম জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দল, বাম দলগুলোর পাঁচ দলীয় ঐক্যজোট রাজপথে অনড় থাকে।
১৯৮৭ সাল থেকে খালেদা জিয়া ‘এরশাদ হটাও’ এক দফার আন্দোলন শুরু করেন। এক পর্যায়ে সংসদ ভেঙে দিতে বাধ্য হন এরশাদ।
আওয়ামী লীগ সংসদ থেকে বের হয়ে এলে পুনরায় শুরু হয় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। রাজপথে দীর্ঘ ৮ বছর একটানা আপোষহীন সংগ্রামে ১৯৯০ সালে ৬ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।
সেই সাধারণ গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে এসে দেশবাসীর কাছে পেয়ে যান ‘আপোষহীন নেত্রীর’ খেতাব। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির সংসদ নির্বাচনে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে বেগম জিয়া হন বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। তিনি প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।
আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবির আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং পদত্যাগ করেন। ওই বছরের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১১৬টি আসন পেয়ে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেত্রী হন তিনি। আর আওয়ামী লীগ ১৪৭ আসন পেয়ে জাতীয় পার্টি ও জাসদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে।
২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পুনরায় বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি। তবে অষ্টম সংসদের মেয়াদপূর্তির পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিরোধে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে ‘এক/এগারো’ রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে, তিনি ফের ক্ষমতার মসনদ থেকে ছিটকে পড়েন।
এ সময় তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার জোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু শত জুলুম-নির্যাতনের মুখেও তিনি দেশ ছেড়ে যাননি। ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এক বছর কারাগারে থাকার পর ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তিনি মুক্তিলাভ করেন। এর আগে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে, ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর গ্রেপ্তার হন তিনি।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনের পরের বছর জনগণের ভোটের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে গুলশানের দলীয় কার্যালয়ে একটানা ৯৩দিন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঘেরাওয়ে এক প্রকার বন্দীই ছিলেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ৪২ বছরের রাজনৈতিক জীবনে সামরিক সরকার এরশাদের আমলে দু’বার, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একবার কারাভোগ করেন। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়ের করা কথিত দুর্নীতির দুই মামলায় দণ্ডিত হয়ে আরো প্রায় দু’বছর কারাভোগ করেন। রাজনৈতিক জীবনে ছোট ছেলে আরাফাত রহমানের আকস্মিক মৃত্যু এবং লন্ডনে নির্বাসিত বড় ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে নানা মামলা আর রাজনৈতিক চাপ থাকার পরও দেশের মানুষকে ফেলে বিদেশে চলে যাননি খালেদা জিয়া। তাছাড়া গত ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ শাসনামলে দলের নেতাকর্মীদের ওপর নজিরবিহীন জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশে থেকেই কঠোরভাবে সাহস জুগিয়েছেন অসুস্থ বেগম জিয়া। দল তথা দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় তাঁকে একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও দেশনেত্রী বলেই মনে করেন তার ভক্ত ও শুভাকাক্সক্ষীরা।
এদিকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয় খালেদা জিয়াকে। এর পরই তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতির কথা জানাতে থাকেন নেতা এবং পরিবারের সদস্যরা। হৃদরোগ, লিভার, ফুসফুস, কিডনি, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয় তার। এসবের মধ্যে লিভার, কিডনি ও হৃদরোগকে সবচেয়ে ঝুঁকির কারণ বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তার চিকিৎসকরা।
এমন পরিস্থিতিতে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বারবার বিদেশে নিয়ে তাঁর উন্নত চিকিৎসা করানোর ইচ্ছা ও চেষ্টা করলেও তা পারেনি খালেদা জিয়ার পরিবার। কাল হয়ে দাঁড়ায় কথিত জিয়া অরফ্যানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার সাজা। পরবর্তীতে নির্বাহী আদেশে মুক্তির পর খালেদা জিয়া হাসপাতাল থেকে ফেরেন হুইলচেয়ারে। তখন থেকেই গুলশানের আবাসস্থল ফিরোজা এবং হাসপাতাল এভারকেয়ারে যাওয়া-আসা অনেকটা নিয়মিত হয়ে ওঠে তাঁর।
মেডিক্যাল বোর্ডের সুপারিশে ছয়বার আবেদন করা হয় বিদেশ চিকিৎসার জন্য। দলীয়ভাবে কর্মসূচিরও পালন করে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠন। কিন্তু কোনো কিছুই টলাতে পারেনি তখনকার সরকারকে।
অবশেষে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার খালেদা জিয়াকে স্থায়ী মুক্তি দেন। আইনি প্রক্রিয়ায় তার সাজা বাতিল করে আদালত। এর প্রেক্ষিতে উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ৭ জানুয়ারি রাতে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান বড় ছেলে তারেক রহমান ও পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান। সেখান থেকেই তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য সরাসরি চলে যান লন্ডন ক্লিনিকে।
উল্লেখ্য, প্রায় ৭ বছর পর চিকিৎসার জন্য সফরে গিয়ে আবার দেখা হয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ জিয়া পরিবারের মা-ছেলের। কারাবন্দি হওয়ার আগে সর্বশেষ ২০১৭ সালে লন্ডন সফরে যান বিএনপি চেয়ারপারসন। তখনই শেষবার সরাসরি দেখা হয়েছিল মা-ছেলের। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান ৭৯ বছর বয়সী অসুস্থ খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরবেন। আবারও এগিয়ে নেবেন দেশও জাতিকে- এমন প্রত্যাশায় বুক বেঁধে আছে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের লাখো কর্মী-সমর্থক ও দেশপ্রেমিক শুভানুধ্যায়ীরা। আমরাও প্রত্যাশা করি, দ্রুত সুস্থ হয়ে তিনি দেশে ফিরে আসুন। শুভকামনা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
লেখক : সাংবাদিক
ই-মেইল : shamsurjabber@gmail.com