সব ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসবেই প্রস্তুতি যেমন থাকে; তেমনি আবার উৎসব পালনেরও থাকে কিছু প্রণালি, পদক্ষেপ, অনুষ্ঠানাদি; যেগুলোকে সেই উৎসবের রীতি-নীতি বলে। এই রীতিগুলোই উৎসবকে পালন করতে, আনন্দমুখর করতে, সর্বোপরি উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা রক্ষা করতে সহায়তা করে। ২৫ ডিসেম্বর হলো খ্রিষ্টধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন। এই দিনটিকে খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীরা ইংরেজিতে ‘ক্রিসমাস’ বা স্প্যানিশ ভাষায় ‘নাভিদাদ’ অথবা বাংলায় ‘বড়দিন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক কারণে বিশেষ এই দিনটি পালনে ও উৎসবমুখর করতেও বিভিন্ন রীতি-নীতি বিগত দুই হাজার বছর ধরে চলে আসছে, আবার নতুন কিছু যোগ হচ্ছে, কিছু পরিবর্তিত হয়ে নতুন রীতিতে রূপ নিচ্ছে। তাদের মধ্য থেকেই কয়েকটি ‘সাপ্তাহিক ঠিকানা’ পত্রিকার পাঠক/পাঠিকাদের সঙ্গে সহভাগিতা করছি এবং একই সঙ্গে সবাইকে জানাই পুণ্যময় শুভ বড়দিনের আনন্দময় শুভেচ্ছা ও মঙ্গল কামনা।
বাহ্যিক ও আত্মিক প্রস্তুতি : ডিসেম্বর মাস এলেই যখন উত্তর গোলার্ধে শীত শীত লাগতে থাকে, প্রকৃতিতে পরিবর্তন আসতে শুরু হয়, সেই শীতের আমেজে বড়দিনের প্রস্তুতিও শুরু হয়ে যায় সবার মাঝে। যেকোনো বিপণি এলাকায় গেলেই তা টের পাওয়া যায় দোকান সাজানো থেকে দ্রব্যাদির মূল্য হ্রাসের বিজ্ঞাপন দেখে। বাড়ি-ঘর, গির্জা, রাস্তা, অলি-গলি পরিষ্কার করার পর তা রঙিন কাগজ, ফানুস, বৈদ্যুতিক বাতি দিয়ে সাজানো হয়। আধ্যাত্মিকভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বিশেষ প্রার্থনা, ধ্যান, উপবাস, আত্মশুদ্ধি, পাপস্বীকার সাক্রামেন্ত গ্রহণসহ বিভিন্নভাবে খ্রিষ্টের অনুসারীরা বড়দিনের প্রস্তুতি নিতে থাকেন বড়দিনের পূর্ব রাত্রি অর্থাৎ ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
ক্রিসমাস ট্রি : বড়দিনের একটা প্রতীক হলো ক্রিসমাস ট্রি। মধ্যযুগে জার্মানিতে খ্রিষ্টান মিশনারি পুরোহিত বনিফাস চিরসবুজ খ্রিষ্টীয় জীবনের উদাহরণ দিতে গিয়ে শীতপ্রধান অঞ্চলের ঝাউগাছ দেখিয়ে শিক্ষা দেন যে শীত ও গরমে ঝাউগাছের পাতা সবুজই থাকে, ঋতুর পরিবর্তনে তা ঝরে পড়ে না। খ্রিষ্টের জন্মদিনে ঝাউগাছ বা ক্রিসমাস ট্রি সাজিয়ে স্মরণ করা হয় যে খ্রিষ্টের শিক্ষায় তারাও চিরসবুজ, চির নবীন থাকবে, কখনো ধর্মবিশ্বাস থেকে রং বদলাবে না বা ঝরে পড়বে না।
গোশালা তৈরি : বড়দিনের আরেকটা প্রতীক হলো গোশালা। কারণ যিশুখ্রিষ্টের জন্ম হয় বেথলেহেম নগরীর এক গোয়ালঘরে। রোমান সম্রাট অগাস্টাস তার সাম্রাজ্যে কত অধিবাসী ছিল, তা জানার জন্য লোক গণনা বা আদমশুমারির আদেশ দেন এবং প্রত্যেক অধিবাসীকে তার পূর্বপুরুষের জন্মস্থানে গিয়ে তালিকাভুক্ত হতে বলেন। যোসেফ রাজা দাউদের বংশের হওয়ায় তাঁর সন্তানসম্ভবা স্ত্রী মারিয়াকে নিয়ে দাউদ নগরী বেথলেহেমে যান। কিন্তু সেখানে এত লোকের সমাগম হয়েছিল যে রাতে থাকার জায়গার অভাব পড়ে। এ সময় মারিয়ার সন্তান জন্ম দেওয়ারও সময় এসে যায়। কোনো উপায় না পেয়ে তাঁরা একটা গোশালায় রাতের জন্য আশ্রয় নেন এবং সেই রাতেই যিশুর জন্ম হয় সেখানে। সেই ঐতিহাসিক বিষয়টি স্মরণ করেই আসিসির সাধু ফ্রান্সিস গির্জায়, রাস্তার চত্বরে, বাড়িতে গোশালা তৈরি করে সাজানোর রীতি প্রবর্তন করেন ইতালি দেশের আসিসি শহরে। সেই রীতি খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ও বিশ্বব্যাপী তা এখনো চলে আসছে।
সান্টা ক্লজ ও উপহার আদান-প্রদান : যিশুর জন্মের আগাম খবর পেয়ে পূর্ব দেশের তিন পণ্ডিত রাজা যিশুকে সম্মান জানাতে এসে স্বর্ণ, সুগন্ধি ও গন্ধরস তেল উপহার দেন। সেটাকে জনপ্রিয় করার জন্য চতুর্থ শতাব্দীতে গ্রিসের অধীন স্মার্না অঞ্চলের বিশপ সাধু নিকোলাস ছোট ছেলেমেয়েদের বড়দিনের সময় উপহার দেওয়া শুরু করেন। এই উপহার দেওয়া-নেওয়ার রীতি পরবর্তী সময়ে সারা পৃথিবীময় একটা ঐতিহ্যে পরিণত হয়। এখন অবশ্য এটা ব্যবসাকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। তবু বড়দিনে উপহার আদান-প্রদানের রীতি আন্তরিকতা ও আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ হলে তা অনেক সুফল ও নিশ্চিত আনন্দ বয়ে আনে।
মধ্যরাতে গির্জায় উপাসনা : প্রার্থনা অনুষ্ঠান অবশ্যই সব ধর্মীয় উৎসবেরই প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। তবে বড়দিনের পূর্ববর্তী সন্ধ্যা ও রাত যেমন তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনি এই রাত পবিত্র, যে রাতে মুক্তিদাতা মানব বেশে এই ধরায় আগমন করেছেন। তাই বড়দিনের আড়ম্বর শুরু হয় মধ্যরাতে গির্জায় উপাসনা বা খ্রিষ্টযাগের মধ্য দিয়ে। এই উপাসনায় গির্জার ভেতর তৈরি করা ছোট আকারের গোশালা আশীর্বাদ করা হয়, যিশুর জন্মভিত্তিক বেশ কিছু ভক্তিমূলক ও আনন্দময় গান গাওয়া হয়, পবিত্র বাইবেল থেকে যিশুর জন্মের ভবিষ্যদ্বাণী ও বেথলেহেমে যিশুর জন্মের কাহিনি পাঠ করা হয়, পুরোহিত তাঁর ধর্মীয় বক্তব্য ও শুভেচ্ছা বাণী রাখেন এবং পবিত্র খ্রিষ্টযাগের পর খ্রিষ্টপ্রসাদ বিতরণ করা হয়। শেষে সংগীত দল মনমাতানো ক্যারল বা কীর্তন পরিবেশন করেন সবার সঙ্গে বড়দিনের আনন্দ সহভাগিতা করার জন্য। উপাসনার শেষে সবাই একে অন্যের সঙ্গে বড়দিনের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
কীর্তন : বড়দিন মানেই যিশুখ্রিষ্টের শুভ জন্মতিথির আনন্দ। সেই আনন্দ প্রকাশের বিভিন্ন মাধ্যমের বিশেষ একটা হলো সংগীত। তবে এর মধ্যে বিশেষ একটি কীর্তন সংগীত বা ক্যারল সংগীত। এটা দলগতভাবে করা হয় প্রায় প্রতিটি দেশে খ্রিষ্টানদের স্থানীয় কৃষ্টি অনুসরণ করে এবং কীর্তন দল বাড়ি বাড়ি ঘুরে কীর্তনের মাধ্যমে বড়দিনের আনন্দ সহভাগিতা করে।
পিঠা-পুলি ও বড়দিনের কেক : বড়দিন যেহেতু শীতের মৌসুমে হয়, বাঙালি খ্রিষ্টানদের ঘরে ঘরে বড়দিনের সময় শীতকালীন পিঠা ছাড়া বড়দিনের আনন্দ যেন সম্পূর্ণ হয় না। সেই সঙ্গে যোগ হয় পাশ্চাত্য দেশের রীতি অনুযায়ী বড়দিনের পাউন্ড ও ফ্রুট কেক। মজার ব্যাপার হলো বাড়ির দাদি, দিদা, মা, শাশুড়ি, বধূ, বোন, কন্যা এরাই পিঠা-পুলি তৈরি করে, অন্যদিকে বাড়ির দাদু, নানু, বাবা, শ্বশুর, গৃহকর্তা, ভাই, ছেলে এরাই কেক প্রস্তুত করে বেকারিতে নিয়ে তা বেক করে নিয়ে আসে। এটা যেন বড়দিনের চমৎকার একটা রীতিতে পরিণত হয়েছে।
আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণ ও সুস্বাদু খাবার : উৎসবে তো বিশেষ খাবারদাবার থাকবেই। তাই বড়দিনের সময়ও বিভিন্ন দেশের খ্রিষ্টানগণ তাদের দেশের প্রথা অনুযায়ী বিশেষ খাবার রান্না করে ও আত্মীয়-প্রিয়জন, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীদের আমন্ত্রণ করে। সেই বিশেষ খাবারগুলোও রীতিতে পরিণত হয়েছে। অনেক ইতালীয় বড়দিনের আগের রাতে মাংস রান্না করে না, তবে ৭ প্রকারের মাছ রান্না করে। পরের দিন তারা বিভিন্ন প্রকার মাংস ও পাস্তা রান্না করে। জার্মান ও পোলিশরা বিশেষ সসেজ রান্না করে। পর্তুগিজরা মনে করে, বাকালাও বা কড মাছ না খেলে বড়দিনের উৎসবটাই হলো না। স্প্যানিশদের আবার পায়েয়া (অনেকটা বিরিয়ানির মতো) ও লেচ্চন (পুরো শূকর রোস্ট করা) চা-ই চাই। ইংরেজ, আইরিশ, স্কটিশদের বড়দিনের ডিনার টেবিলে হ্যাম থাকতেই হবে। ফিলিপিনোরা আবার পানচেট (নুডল, কিছু সবজি ও বিভিন্ন রকমের মাংস) ও লেচ্চন হলে মনে করে উৎসব হচ্ছে। আমেরিকায় নভেম্বর মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার থ্যাক্সগিভিং দিবসে খাবারের মধ্যমণি হলো টার্কি, যা একটা রীতি হয়ে গেছে, তেমনি বড়দিনেও বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন খাবারকে বড়দিনের রীতির অন্তর্ভুক্ত করেছে।
দীন-দুঃখীদের সঙ্গে একাত্মতা : বড়দিনের সময় অভাবী, দরিদ্র, গৃহহীনদের সাহায্যে হাত বাড়ানো বড়দিনের একটা রীতিতে পরিণত হয়েছে। এ জন্য বিভিন্ন ধর্মীয়, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দান সংগ্রহের কাজে লেগে যায় চিঠি, বিজ্ঞাপন ইত্যাদির মাধ্যমে। মলে কিংবা বড় দোকানের সামনে সান্টা ক্লজ ঘণ্টা বাজিয়ে দরিদ্রদের জন্য বালতি বা ঝুড়িতে ভাংতি পয়সা চেয়ে নেয় বড়দিনের বাজার করতে আসা লোকদের কাছ থেকে। গির্জা বা অন্যান্য উপাসনা কেন্দ্রে বিশেষ দান সংগ্রহ করা হয় বড়দিনের উপাসনায়।
পরলোকগত প্রিয়জনদের স্মরণ : আনন্দের মাঝেও দুঃখ থাকে, যখন আত্মীয়-প্রিয়জন কিংবা বিশেষ ব্যক্তিরা আমাদের সঙ্গে বড়দিনে যোগ দিতে পারে না। আরও দুঃখ হয় মৃত্যুতে কাউকে হারিয়ে। বিভিন্ন জাতির খ্রিষ্টানদের মাঝে এই রীতি প্রচলিত আছে যে বড়দিনের দিন তারা তাদের পরলোকগত প্রিয়জনদের কবর পরিদর্শন করতে যান, শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন, প্রার্থনা করে কবরে ফুল দিয়ে তাদের স্মরণ করেন। বাড়িতে সবাই সমবেত হলে খাবারের আগে তাদের স্মরণ করাও অনেক পরিবারের বড়দিনের একটা অংশ হয়ে গেছে।
পোপ মহোদয়ের বড়দিনের বাণী (টৎনর বঃ ঙৎনর) : বড়দিনের দিন দুপুর ১২টার সময় রোমান ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের প্রধান পুণ্যপিতা পোপ মহোদয় ভাটিকানের সেইন্ট পিটার ব্যাসিলিকা থেকে দূত সংবাদ প্রার্থনা করার পর নগর (রোম) ও পৃথিবীর প্রতি (ঐশ জনগণ) বড়দিনের বাণী ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন বিভিন্ন ভাষায়, আমাদের মাতৃভাষা বাংলাও তার অন্তর্ভুক্ত। এটাও বড়দিনের একটা রীতিতে পরিণত হয়েছে। এটা ছাড়া রোমান ক্যাথলিকদের কাছে বড়দিন অসম্পূর্ণ মনে হয়।
১২ দিনের বড়দিন উৎসব : অনেক আনন্দের একটা বিষয় হলো শুধু ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন নয়, বরং সব মিলিয়ে আরও ১১ দিনকে বড়দিনের অন্তর্ভুক্ত করে ১২ দিনের বড়দিনের উৎসব করার রীতি চলে আসছে সেই মধ্যযুগ থেকে। এ নিয়ে বহু ধর্মীয় গান, ক্যারল ও কীর্তন রচিত হয়েছে, যা বড়দিনের আনন্দকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। এই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হোক এবং উৎসব সবার হোক, এটা আমার এবং সবার প্রার্থনা। শুভ বড়দিন ॥ 🎅🎄🧑🎄
লেখক : ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী, হলি ক্রস ও সেইন্ট যোসেফ স্কুল, নটর ডেম কলেজ ও সিটন হল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র, নিউ জার্সিবাসী, একজন রোমান ক্যাথলিক যাজক এবং ধর্মবিষয়ক কলামিস্ট