২০২৪ শেষ হতে আর কিছুদিন বাকি। দেখতে দেখতে এই বছরটাও শেষ হতে যাচ্ছে। প্রতিবছরই মনে হয়, এই বছরটা বুঝি আরও তাড়াতাড়ি কাটল। একেকটা বছর শেষ হয় আর আমার কাছে মনে হয়, জীবন থেকে আরও একটা বছর ঝরে গেল। আমাদের আয়ু শেষ হয়ে যাচ্ছে।
আসলে মানুষের জীবন দিনকে দিন খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। এই ব্যস্ততার সঙ্গে যোগ হচ্ছে প্রতিদিনের ক্লান্ততা, অবসন্নতা, শারীরিক জটিলতা। মানুষ হয়ে পড়ছে ক্ষিপ্ত, বিষাদময়, হতাশাগ্রস্ত। একটু ভালো সময় কাটানো বা নির্মল আনন্দ পাওয়ার জন্য এখন চেষ্টা করতে হয়, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়। তারপর সেই সুন্দর সময়টাও আবার খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়।
দেশে-বিদেশে উল্লেখযোগ্য কী ঘটল ২০২৪-এ?
২০২৪ সাল ছিল লিপ ইয়ার। প্রতি চার বছর পরপর একবার এই সৌভাগ্য হয় আমাদের পৃথিবীবাসীর। সূর্যের চারদিকে অতিক্রম করতে পৃথিবীর ৩৬৫ দিনের পরিবর্তে সোয়া ৩৬৫ দিন লাগে। তাই চারবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার পর আমরা গোটা একটা দিন পাই পৃথিবীর কাছ থেকে উপহার হিসেবে। তাই প্রতি চার বছর পর লিপ ইয়ার আসে। ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনের পরিবর্তে ২৯ দিনে শেষ হয়।
যাদের জন্ম ২৯ ফেব্রুয়ারি, তাদের জন্মদিন উদ্্যাপনের জন্য অনেক অপেক্ষা করতে হয়। প্রাইমারি স্কুলে আমার ছেলেদের কিন্ডারগার্টেন ক্লাসের শিক্ষিকার জন্মদিন ছিল ২৯ ফেব্রুয়ারি। ওনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে ওনার কেমন লাগে। উনি বলেছিলেন, ছোটকালে অনেক মন খারাপ হতো। পরে বড় হতে হতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।
আসলে অপেক্ষা করা খুব বড় একটি ধৈর্যের পরীক্ষা। ছুটে চলা ব্যস্ত জীবনে আমরা প্রায়ই ভাবি, এই পরীক্ষায় পাস করব না, ফেল মারব। কিন্তু কথায় বলে না, ঠেলার নাম বাবাজি। কেমন কেমন করে যেন আমরা জীবনের যেকোনো ঝুঁকি ও ঝামেলা উতরে যাই। তবে খুব বড় মাপের একটি ধৈর্যের পরীক্ষা চলছে পৃথিবীতে নয়, মহাকাশে।
দুজন পৃথিবীবাসী মহাশূন্যে গিয়ে আটকে পড়েছেন। এ বছর জুন মাসে দুজন নভোচারী যাত্রা করেছিলেন আট দিনের মহাকাশ ভ্রমণে। কিন্তু নভোযানে যান্ত্রিক ত্রুটি হওয়ায় তাদেরকে পৌঁছে দেওয়া হয় আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা জানায়, এই দুজনের আর এ বছরে ফেরা হবে না। নতুন নভোযান তাদেরকে নিতে মহাশূন্যে যাবে এবং তারপর তারা পৃথিবীতে ফেরত আসবে আগামী বছর, ২০২৫ এর ফেব্রুয়ারি মাসে। এতে অবশ্য তাদের মনঃক্ষুণ্ন হয়নি একটুও। তারা মহাকাশ স্টেশন আইএসএসে বসে দিন কাটাচ্ছেন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, ব্যায়াম করে আর মহাকাশে স্পেস ওয়াক করে। পৃথিবী নামক প্রিয় বাসভূমিতে ফিরতে তাদের অনেক মাস অপেক্ষা করতে হবে।
মহাশূন্যের সমস্যা সমাধান হলেও বিশ্বের অনেক দেশের সমস্যার সমাধান করা হয়নি। মাসের পর মাস সংঘটিত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের নির্মমতায় বিশ্বজুড়ে মর্মাহত যেকোনো হৃদয়সম্পন্ন বিবেকবান মানুষ। দুনিয়ার বড় বড় নেতারা একত্র হয়ে কোনো শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছাতে পারেননি। কেউ কেউ আবার যুদ্ধ বন্ধ হোক চায়নি। ব্যবসায়িক মুনাফা লাভ, ক্ষমতার জের প্রদর্শন, পরাশক্তির কাছে বার্তা প্রেরণ ইত্যাদি বহুবিধ কারণে তারা যুদ্ধ বন্ধ হোক চায়নি। নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু, অপরিসীম দুর্দশা অথবা জেনোসাইডের মতো জঘন্য অপরাধ তাদের বিবেকে কোনো প্রভাব ফেলেনি। আপনার, আমার মতো সাধারণ মানুষের জন্য যা মানসিকভাবে গ্রহণ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।
হয়তো তারই জোরালো বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে, যা ছিল এ বছর আমাদের আমেরিকাবাসীর জন্য একট বহুল আলোচিত ঘটনা। আমেরিকার বিদায়ী প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং তাদের ডেমোক্র্যাটিক পার্টি বিরাট অংশে তাদের জনপ্রিয়তা হারাল এই কারণে। অন্তত মুসলিম কমিউনিটির কাছে তাদের আর কোনো মুখ নেই। ফলে ক্ষমতায় এলেন রিপাবলিকান পার্টির সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ক্ষমতার চেয়ারে বসার আগেই তিনি যে রকম কথাবার্তা বলা শুরু করেছেন, তাতে আমেরিকার ইমিগ্র্যান্ট কমিউনিটি রীতিমতো ভীত, চিন্তিত ও শঙ্কিত। কে জানে, ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে।
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিশাল এক অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে এবং দিনে দিনে উত্তাপ বাড়ছে। সেই সঙ্গে আমাদের পৃথিবীর উত্তাপও দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণতার কথা আমরা সবাই কমবেশি জানি। বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীর সার্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। তাই ২০২৪ সালকে উষ্ণতম বছর হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি বন্যা, ঝড়, খরা, দাবানলের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলোকে ত্বরান্বিত করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার পদক্ষেপ গ্রহণ করা সত্ত্বেও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন বাড়ছে। ফলে তা পৃথিবীর মহাসাগর এবং বায়ুমণ্ডলকে উষ্ণ করে তুলছে এবং তা জলবায়ু প্যাটার্ন ও পানিচক্রকে প্রভাবিত করছে। ফলে প্রলয়ংকরী দুর্যোগ ঘটছে।
আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি, যেখানে প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের কল্পনাকেও হার মানাচ্ছে। এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স প্রযুক্তিবিদ্যার এক অভিনব উদ্ভাবন। আমরা জানি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকলা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সর্বক্ষেত্রে এখন এআই ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে জেনেরেটিভ এআই নিয়ে দেশে-বিদেশে তোলপাড় হচ্ছে। জেনেরেটিভ এআই হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এক নতুন রূপ, যা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডেটা থেকে নতুন বিষয়বস্তু তৈরি করতে সক্ষম। যেমন অডিও, ভিডিও, টেক্সট, ছবি, মিউজিক এ ধরনের বিভিন্ন কন্টেন্ট। আবার তারা বিভিন্ন কোডও লিখতে সক্ষম। তারই এক অন্যতম অ্যাপলিকেশন হলো ভাষা মডেল বা জিপিটি। এই জিপিটি অতি সহজে গল্প, কবিতা, রচনা, অনুবাদ, বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা তৈরি করতে পারে এবং তা খুবই গ্রহণযোগ্যভাবে উপস্থাপন করতে পারে। প্রযুক্তিতে এত উন্নতি মানুষের সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীলতার সংজ্ঞাই বদলে দিচ্ছে।
এ বছর অক্টোবর মাসে মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের প্রধান প্রতিপাদ্য ছিল ‘কর্মক্ষেত্রে মানসিক সুস্থতা’। শারীরিক সুস্থতা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক ততটাই মানসিক সুস্থতা গুরুত্বপূর্ণ। কাজের জায়গায় কাজের চাপ সামলানো, সমস্যার দ্রুত সমাধান করা, সহকর্মীদের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক রাখা, সহযোগিতামূলক আচরণ করাÑএগুলো মানসিক সুস্থতার মধ্যে পড়ে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো এখন তাদের কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষভাবে যত্নশীল হচ্ছে। কর্মীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নিশ্চিত করা এবং মানসিক স্বাস্থ্যসহায়ক পরিবেশ তৈরি করার লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন সেমিনার, ট্রেনিও, ভিডিও প্রচারণা ও ওপেন ডায়ালগ ফোরামের ব্যবস্থা করছে।
সেদিন একটা ইন্টারেস্টিং আর্টিকেল পড়ছিলাম। এআই যেভাবে আমাদের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ছে, তাতে আমরা মানসিক সুস্থতার জন্য এআইয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। জীবনের নানাবিধ সমস্যা ও প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে কাউন্সেলিং বা মেন্টাল থেরাপির জন্য আমরা এআই থেরাপিস্ট ব্যবহার করছি। ২০২৫ সালে যে পাঁচটি এআই থেরাপিস্ট তালিকার শীর্ষে আছে, তাদের মধ্যে এক নম্বরে আছে ‘সেরিনা’-হোয়াটসঅ্যাপের চ্যাটবট। সেরিনা যেকোনো অ্যাংজাইটি বা ডিপ্রেশনের মতো মানসিক দুরবস্থায় মানুষের সেবায় ২৪/৭ সহায়তা দেবে। ভেবে দেখুন, সেরিনাকে আপনার মনের হতাশা ও ব্যর্থতার কথাগুলো বলবেন কি না। সেরিনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আপনার কথা শুনবে এবং পরিত্রাণের উপায় বাতলাবে। কিন্তু মুশকিল হলো, একটা মেশিনের কাছ থেকে আপনি কোনো পরামর্শ গ্রহণ করবেন কি না।
দেশের পরিমণ্ডলে সবচাইতে বড় খবর ছিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা। ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী সরকারের অবসান ঘটিয়ে ২০২৪ এর ৫ আগস্ট আমাদের দেশ দ্বিতীয় বার স্বাধীন হলো। শত শত ছাত্র-জনতার প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে মানুষ প্রাণভরে শ্বাস নিচ্ছে, নির্ভয়ে কথা বলছে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সিংহভাগ মানুষের সমর্থনে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসকে প্রধান করে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তার পর থেকে রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের কাজ চলছে। একইভাবে বিদ্রোহীদের মাত্র ১২ দিনের অভ্যুত্থানে টানা পাঁচ দশক ধরে সিরিয়ায় যে পরিবারটি শাসন করে যাচ্ছিল, সেই স্বৈরাচারী শাসকের অবসান ঘটল।
২০২৪ এর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে আমার দ্বিতীয় বই ‘একটু কথা ছিলো’। জড় জগতের মাঝে যদি প্রাণের সঞ্চার করা হয়, তাদের মন ও মানসিকতা বুঝতে যদি তাদেরকে কথা বলতে দেওয়া হয়, ব্যাপারটা কেমন হবে। সেই চিন্তাধারা থেকেই এই ব্যতিক্রমধর্মী, আত্মকথনমূলক গল্পের সংকলন। বলাই বাহুল্য, এই গল্পগুলো সম্পূর্ণভাবে আমার নিজস্ব চিন্তা ও কল্পনার রঙে রঞ্জিত। প্রকৃত অর্থে এই গল্পগুলোর মধ্য দিয়ে আমি আমাদের সমকালীন জীবন, জগৎ, মানসিকতা ও পারিপার্শ্বিকতার একটি সময়োপযোগী ও কালনির্ভর চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আরেকটি নতুন বইয়ের কাজ চলছে আগামী বইমেলায় প্রকাশের ইচ্ছায়। যারা খয়েরি রঙের ভক্ত, তাদেরকে একটা খবর দিই। প্যান্টোন কালার ইনস্টিটিউট প্রতিবছর একটি রংকে বছরের সেরা প্রভাবশালী রং হিসেবে নির্বাচন করে। এই রংটি সারা বছর ধরে, পুরো বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্য, এন্টারটেইনমেন্ট ও ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে গ্লোবাল পর্যায়ে আধিপত্য বিস্তার করে। আগামী ২০২৫ সালের রং হিসেবে তারা নির্বাচন করেছে ‘মোকা মুস’ বা খয়েরি রংকে। তাদের ভাষায়, খয়েরি রং মনে করিয়ে দেয় আমাদের চিরপরিচিত চা ও কফির মতো উষ্ণ কোমল পানীয়কে, যা কিনা মানুষের জীবনে বয়ে আনে নির্মল আনন্দ ও ভালো লাগার মুহূর্ত।
কাছে দূরে যারা আছেন, সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। সবাইকে নতুন বছর ২০২৫ এর অগ্রিম শুভেচ্ছা।
লেখক : কলামিস্ট ও ব্লগার, টেক্সাস।