Thikana News
০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

একটি ব্যর্থ গোয়েন্দা ইনিশিয়েটিভের গল্প

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন যখন বেগবান হয়ে একসময় এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায়, হাসিনার গদি উল্টে (Collapse) যাওয়ার উপক্রম হয়, তখন তাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য পুলিশ কর্মকর্তা মনির ও হারুন বিশেষভাবে সক্রিয়
একটি ব্যর্থ গোয়েন্দা ইনিশিয়েটিভের গল্প
নিজ জেলার জন্য প্রত্যেক মানুষেরই একটা আলাদা টান থাকে। এ ক্ষেত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ব্যতিক্রম নন। নিজ জেলা গোপালগঞ্জের প্রতি তার টান ও মমত্ববোধ যে কতটা গভীর ছিল, সেটা নিকট অতীতে ফাঁস হওয়া তার একটা ফোনালাপে সহজেই বোঝা যায়, যেখানে তিনি দম্ভভরে উচ্চারণ করেন, গোপালগঞ্জের ওপর যে হাত দেয়, তার হাত পুড়ে যায়। তার প্রিয় গোপালগঞ্জের একজন কর্মকর্তা বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থা স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) প্রধান অ্যাডিশনাল আইজি মনিরুল ইসলাম। জয়েন্ট কমিশনার হিসেবে তিনি একসময় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম উইংয়ের প্রধান ছিলেন। পরে পদোন্নতি দিয়ে তাকে এসবির প্রধান করা হয়। তিনি গোপালগঞ্জের অধিবাসী। ডিএমপিতে থাকাকালে পুলিশের বিভিন্ন অপারেশন নিয়ে বক্তব্য রাখতে তাকে প্রায়ই প্রেসের সামনে হাজির হতে দেখা যেত, যে কারণে তিনি বহু মহলে বিশেষ পরিচিতি পান। স্পেশাল ব্রাঞ্চে নতুন পদে যোগ দিয়ে তিনি শেখ হাসিনার প্রতি তার অকৃত্রিম আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন শুরু করেন। সে সময় তিনি হাসিনার বিরোধী পক্ষের দল ও সংগঠনের নেতাকর্মীদের দমন-পীড়ন, গ্রেফতার, তাদের কর্মকাণ্ড, আন্দোলন কর্মসূচি এবং তৎপরতার খবরাখবর বিশ্লেষণসহ প্রতিবেদন আকারে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করেন। বলে রাখা ভালো, মেধাবী ছাত্র মনির বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। এ কারণে মনির ক্রমেই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একজন অতি প্রিয়ভাজন কর্মকর্তা হয়ে ওঠেন। প্রধানমন্ত্রীকে সার্বিক সহযোগিতার কাজে মনিরের সঙ্গে যোগ দেন অপর এক পুলিশ কর্মকর্তা ডিএমপির ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশীদ। তিনি অবশ্য গোপালগঞ্জবাসী ছিলেন না।
তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের জেলা কিশোরগঞ্জের মিঠামইনের বাসিন্দা। অভিযোগ রয়েছে, এই দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা না করে, তাদের ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে হাসিনার প্রশ্রয়ে পুলিশ বাহিনীতে হাসিনাপন্থী পুলিশ লীগের ((Police League) জন্ম দেন, যার কাজ হবে হাসিনার বিরোধী পক্ষের সব তৎপরতা কঠোর হাতে দমন করা।
মনির তার প্রতিদিনের কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে প্রতিদিন দেশে সংঘটিত বিশেষ বিশেষ রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির একটি সারসংক্ষেপ সিচুয়েশন রিপোর্ট (সংক্ষেপে Sitrep) আকারে মধ্যরাতের আগে হাসিনার কাছে উপস্থাপন করতেন। এ ছাড়া প্রতিটি নির্বাচনের আগে মাঠপর্যায়ে আওয়ামী লীগসহ সব দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা ও তাদের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে একটি বিস্তারিত সমীক্ষা মন্তব্য সুপারিশসহ হাসিনার কাছে পেশ করতেন। শেষোক্ত কাজটি অবশ্য বাংলাদেশের অপর দুই গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স ও এনএসআইয়ের (ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স) পক্ষ থেকেও হাসিনার কাছে দেওয়া হতো।
হাসিনার প্রতি তার আনুগত্যের প্রকাশ দেখাতে মনির বিরোধী পক্ষের প্রতিটি আন্দোলন কর্মসূচি ব্যর্থ ও বানচাল করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এসব কাজ সম্পন্ন করতে বড় অঙ্কের অর্থ প্রদান করে মনিরকে সহায়তা করতে হাসিনা কখনো দ্বিধা করতেন না বলে শোনা যায়। বলে রাখা ভালো, গোয়েন্দা সংস্থাকে প্রদত্ত অর্থ বিভিন্ন প্রকাশ্য ও গোপনীয় (Overt and Covert) অপারেশন ও কাজে ব্যবহৃত হয় বিধায় সেই অর্থকে অডিটের বাইরে রাখা হয়। যে কারণে এই অর্থ কোন খাতে কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে-সেটা জানার কোনো উপায় থাকে না।
প্রোপাগান্ডামূলক লিটারেচার (লিফলেট, প্রদানপত্র ইত্যাদি) প্রণয়ন ও বিলি, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন দপ্তর, দল ও সংগঠনে ইনফরমেন্ট, এজেন্ট ও সোর্স নিয়োগসহ রাজনৈতিক দল ও সংগঠন ভাঙা-গড়া, রাজনীতিতে প্রয়োজনমতো মেরুকরণ (Polarization) সৃষ্টিসহ নানা খাতে এই অর্থ ব্যয়িত হয়। এ ক্ষেত্রে এরশাদের জাতীয় পার্টি ও এর অঙ্গসংগঠনের জন্মপ্রক্রিয়া ও সাম্প্রতিককালে বহুল আলোচিত কিংস পার্টি (KingÕs Party) গঠন ওপরে বর্ণিত উপায়ে সম্পন্ন করা হয়।
গোয়েন্দা পরিভাষায় থ্রি ডব্লিউস (Three W’s) বলে একটা কথা বহুল প্রচলিত আছে, যা দিয়ে Wine, Woman I Wealth বোঝানো হয়ে থাকে। মদ, নারী ও অর্থ-এই তিনটির কোনো একটির প্রতি আসক্তি বা দুর্বলতা অনেক মানুষের মধ্যেই রয়েছে, যার কোনো একটিকে exploit  করে নিজের স্বার্থ বা উদ্দেশ্য সফল করার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাকে প্রদত্ত অর্থের বড় একটি অংশ ব্যবহার করা হয়।
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন যখন বেগবান হয়ে একসময় এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায়, হাসিনার গদি উল্টে ((Collapse) যাওয়ার উপক্রম হয়, তখন তাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য পুলিশ কর্মকর্তা মনির ও হারুন বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। যেকোনো উপায়ে তারা আন্দোলনকে ব্যর্থ ও বানচাল করতে সংকল্পবদ্ধ হন। এই লক্ষ্যে পুলিশ কর্মকর্তা মনির একদিন গণভবনে গিয়ে হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। আন্দোলনকে কী উপায়ে ভণ্ডুল করা যায়, তা নিয়ে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সবিস্তারে সলা-পরামর্শ করেন। আলোচনার একপর্যায়ে এ কাজ সম্পন্ন করার জন্য মনির হাসিনার কাছে কয়েক কোটি টাকার প্রয়োজন হবে বলে জানান। ক্ষমতায় টিকে থাকতে মরিয়া হাসিনা সে সময় সবকিছু করতে রাজি ছিলেন। টাকার কথা শুনে হাসিনা সঙ্গে সঙ্গে তাকে ২৫ কোটি টাকা দিয়ে দেন। মনির এই টাকা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণের মাধ্যমে তাদেরকে আন্দোলনের পথ থেকে সরিয়ে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন বলে হাসিনাকে জানান। হাসিনা তথাস্তু বলে তার প্রস্তাবে সায় দেন।
তথ্যমতে, মনির টাকা নিয়ে এসে তা ব্যাংকে না রেখে নিজের আলমারিতে রাখেন, যেটা ঘটনাক্রমে তার অফিসের দু-একজন কর্মকর্তা দেখে ফেলেন। তাৎক্ষণিকভাবে টাকা বিতরণের প্রয়োজন হতে পারে বিবেচনা করে ব্যাংকের পরিবর্তে টাকা আলমারিতে রাখা হয়।
টাকাপ্রাপ্তির পর মনির ডিবির হারুনের সঙ্গে দেখা করে আশু সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিয়ে কথা বলেন। ইতিমধ্যে হাসিনার ফ্যাসিস্টদের গুলিতে আবু সাইদ, মুগ্ধ, ওয়াসিম, রিয়া গোপসহ অসংখ্য মানুষের প্রাণহানির কারণে ছাত্র-জনতার আন্দোলন হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে নেমে তুঙ্গে উঠে আসে। এ সময় পুলিশের এই দুই কর্মকর্তা আন্দোলনের কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে (নাহিদ, হাসনাত, সারজিস প্রমুখ) ধরে ডিবি অফিসে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। সেখানে তাদেরকে ডিবির আয়নাঘরে রেখে নানা ধরনের ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখানো ছাড়াও দৈহিকভাবে নির্যাতন করা হয়। এসব সত্ত্বেও তারা আন্দোলন প্রত্যাহারে রাজি না হলে তাদেরকে বিপুল অঙ্কের অর্থ প্রদানের প্রলোভন দেখানো হয়। স্পষ্টত শত শত ছাত্র-জনতার হত্যা ও আন্দোলন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে বিবেচনা করে তারা কর্তৃপক্ষের প্রলোভনের ফাঁদে পা দিতে অস্বীকৃতি জানান। নির্যাতন, প্রলোভনসহ কোনোভাবেই নেতাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে ব্যর্থ হয়ে মনির ও হারুন রণেভঙ্গ দিতে বাধ্য হন। ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে হাসিনা দেশত্যাগে বাধ্য হলে তার অন্য অনেক দোসরের মতো পুলিশ কর্মকর্তা মনির ও হারুন ও গা-ঢাকা দেন। তারা বর্তমানে কোথায় আছেন (Whereabouts), তা জানা যায়নি। নীরবে গা-ঢাকা দেওয়ার পর যেসব কর্মকর্তা আলমারিতে টাকা থাকার বিষয়টি জানতেন, তারাসহ আরও কয়েকজন কর্মকর্তা আলমারির তালা ভেঙে সেখানে রক্ষিত সেই টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়ে নেন। লুটপাটকৃত টাকা উদ্ধারে ইতিমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তরে গঠিত একটি কমিটি কাজ করছে বলে জানা যায়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা যেভাবে অকথ্য নির্যাতন ও অর্থের প্রলোভন উপেক্ষা করে স্বৈরশাসন-বিরোধী আন্দোলনকে তার কাক্সিক্ষত গন্তব্যে নিয়ে গেছেন, তাকে এককথায় নজিরবিহীন বলা যায়। অন্যায়ের কাছে মাথানত না করে তারা মানুষের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতার যে কোনো বিকল্প হতে পারে না, তার এক গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আগামী দিনে হাসিনার মতো উন্নয়নের ধারণা ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান এবং ভয়ভীতির পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে যারা স্বৈরশাসন কায়েমের অপচেষ্টায় লিপ্ত হওয়ার প্রত্যাশা করেন, তাদের জন্য এটা একটা প্রতিরোধ (Determent) হিসেবে কাজ করবে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।
লেখক : কলামিস্ট

কমেন্ট বক্স