১৯৭১ সাল থেকে ২০২৪-দিনপঞ্জির হিসাবে সুদীর্ঘ ৫৩ বছর। এই দীর্ঘ ব্যবধানে বিশ্বজুড়ে লাখো রাজ্য-সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন ঘটেছে, হয়েছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার হাতবদল, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ভাগীরথী-হাডসন নদে বয়ে অজস্র তরঙ্গপ্রবাহ। সবচেয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির জগতে। গোটা বিশ্বকে নিয়ে গড়ে উঠেছে গ্লোবাল ওয়ার্ল্ড। মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহ অভিযানে চলছে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। মানুষের চিন্তা-চেতনা-বুদ্ধিমত্তা-ধ্যানধারণা তথা মনোজগতেও অভাবনীয় পরিবর্তন সূচিত হয়েছে : চেনা-শোনা আপনজনেরা প্রয়োজনে অচেনা-অদেখা হয়ে গেছেন। আর বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে সবকিছুকে যাচাই-বাছাই করার মন-মানসিকতা থেকে সনাতনী আবেগ- অনুভূতি- স্নেহ- মমতা- বাৎসল্য-পরার্থপরতা ইত্যাদি মানুষের স্বাভাবিক জীবনাচরণ থেকে বিদায় নিয়েছে। তবে সবচেয়ে ঘৃণ্য পরিবর্তন সূচিত হয়েছে আশরাফুল মাখলুকাত নামক মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাপন, পারিবারিক-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আচরণ এবং মনুষ্যত্ববোধ নামক বিশেষ গুণ ও ধর্মের ক্ষেত্রে। মনুষ্যত্ববোধ এবং সদ্বিবেচনা শক্তির অধিকারী হিসেবে অপরাপর সৃষ্টিজগতের তুলনায় বিশ্বপ্রতিপালকের দরবারে মানুষ শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। অথচ বিগত অর্ধশতাব্দীতে বিশ্বজুড়ে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে মনুষ্যত্ব ও সৌভ্রাতৃত্ববোধ নির্বাসনে গেছে। গ্রাম-বাংলার হাজার বছরের সনাতনী কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য লজ্জায় পালিয়েছে। বাংলাদেশে মনুষ্যত্বের চরম অবক্ষয় এবং আত্মকেন্দ্রিকতার পরম বিকাশ ঘটায় মান্ধাতার আমলের একান্নবতী পরিবার-ব্যবস্থা জাদুঘরে স্থান পেয়েছে; স্বার্থপরতার তরঙ্গাভিঘাতে পরার্থপরতার আত্মাহুতি ঘটেছে। গোটা বিশ্বকে গ্রাস করার ঘৃণ্য প্রতিযোগিতা থেকে ইউক্রেন, মধ্যপ্রাচ্যসহ বলতে গেলে সারা বিশ্বে যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ। অসম প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের দুুর্মর লোভের বশবর্তী হয়ে মানুষের অবয়বধারী পেশিশক্তি ও ক্ষমতাবানরা হাজার হাজার মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে হালফ্যাশনের গগনচুম্বী হর্ম নির্মাণের মরণ খেলায় মেতে উঠেছে।
অন্যদিকে দেশের আনাচ-কানাচে বাস্তুহারা বস্তিবাসীর কোটি কোট চালাঘর গিজগিজ করছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন, প্যালেস্টাইন-গাজা উপত্যকাসহ সারা বিশ্বে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় গ্রহণকারী নিয়তিলাঞ্ছিত মানুষের সংখ্যাও কয়েক শ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। পরিবর্তিত চিন্তা-চেতনা এবং দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বর্তমানে হালাল উপায়ে জীবিকার্জনের প্রচেষ্টা জঘন্য অপরাধ হিসেবে সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছে। সমাজস্থিত অসহায়কে সাহায্য ও সর্বহারা আশাহতকে প্রাণবন্ত করা কিংবা বর্ষীয়ানদের শ্রদ্ধা ও ছোটদের স্নেহ করার সনাতনী জীবনাচরণ একুশ শতকের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দুর্বলতা ও অসহায়ত্বের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদা চুরি বা অবৈধ উপার্জন কিংবা বাম হাতের লেনদেন সামাজিক এবং ধর্মীয় দৃষ্টিতে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেছে। আইনের ফাঁকফোকর কিংবা বিশেষ মহলের আশীর্বাদে অপরের সম্পদ কুক্ষিগত করা, সরকারি সম্পদ ও কোষাগার লুণ্ঠন, খাল-বিল-নদী-নালা-রাস্তাঘাট-বালি-পাথর সবকিছু গোগ্রাসে গিলে খাওয়া বর্তমানে প্রতিপত্তি এবং শৌর্যবীর্য জাহিরের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাবেক পাকিস্তান আমলে পুকুরচুরির খবরে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হলেও বর্তমানে মেগা প্রকল্পের অছিলায় কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ, ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচারসহ বিভিন্ন সাগর-মহাসাগরতুল্য দুর্নীতি ও অন্যায়-অপরাধের খবর দেশের ১৮ কোটি হতভাগ্য জনতার নিকট নেহাত তুচ্ছ ব্যাপার-স্যাপারে পরিণত হয়েছে। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, রাজনীতির নামে বংশগত কায়েমি স্বার্থ প্রতিষ্ঠা ও অফুরন্ত ফায়দা লোটা, পেশিশক্তির উপদ্রব, দুরারোগ্য ক্যান্সারের মতো ঘুষ-দুর্নীতি-মাদকের জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিস্তার লাভ, বিচারহীনতা সংস্কৃতির বিশদ বর্ণনায় ভাষা হার মানতে বাধ্য। একদিকে উঠতি কোটিপতির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, অন্যদিকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বানভাসির শিকার এবং জোতজমাহীন বাস্তুহারার গুরুভারে গোটা বাংলাদেশ তলিয়ে যেতে বসেছে। এমনতর বৈপরীত্য, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, মাৎস্যন্যায় দশা এবং প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের অসহনীয় দাবদাহকে শিরোধার্য করেই স্বদেশে এবং প্রবাসে বাংলাদেশিরা ৫৩তম মহান বিজয় দিবস উদ্্যাপন করতে যাচ্ছেন ১৬ ডিসেম্বর সোমবার।
আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিতে প্রতিটি বিজয় দিবসের প্রাক্কালে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৬ ডিসেম্বরের স্মৃতিচারণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিশেষ আশীর্বাদে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ইত্যাদি জাতীয় দিবসকে উপজীব্য করে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক বিষোদ্গার চরম আকার ধারণ করেছে এবং ইতিহাস বিকৃতির একটি ঘৃণ্য প্রবণতা আমাদের উর্বর মস্তিষ্কে স্থায়ী পালঙ্ক পেতে বসেছে। তাই সীমিত জ্ঞানবুদ্ধি এবং বিবেকের তাড়নায় ৫৩তম বিজয় দিবস প্রসঙ্গে আলোচনাকালে বায়ান্নর ভাষাশহীদ, গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে প্রাণ বিসর্জনকারী বীর বাঙালি, ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবী, একাত্তরের ৩০ লাখ শহীদ, ২ লক্ষাধিক সম্ভ্রমহারা মা-বোন, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিহতদের আত্মার চিরপ্রশান্তি কামনা করছি। আর পঙ্গু এবং স্বজনহারাদের প্রতি গভীর সহমর্মিতা ও হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা প্রকাশ করছি। ১৯৭১ সালের ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাঙালি বিচ্ছুবাহিনীর নিকট সর্বাধুনিক সমরাস্ত্র সজ্জিত ৯৬ হাজার বর্বর পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণকে ঝিনুক দিয়ে সাগর সেচার অবিস্মরণীয় সাফল্য বললেও অতিশয়োক্তি হবে না। যুদ্ধ জয়ের জন্য মূলত সর্বোচ্চ মানের সমরকৌশল, অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণ এবং ক্ষেপণাস্ত্রের চেয়েও মুক্তিকামী জনতার আত্মাহুতির সংকল্প যে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, বীর বাঙালি ১৯৭১ সালে তা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করেছে। একাত্তরে বাঙালি রাজনীতিবিদ, সেনাসদস্য, ইপিআর, পুলিশ বাহিনী, ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী, আমলা-কামলা-ব্যবসায়ী তথা সর্বস্তর ও পেশার বাঙালি যে কালোত্তীর্ণ ইতিহাস রচনা করেছেন, মহাপ্রলয়ের আগ পর্যন্ত তা চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। অথচ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের স্বল্পসংখ্যক নষ্টচরিত নেতা-নেত্রী এবং দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীদের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ফলে শোষণ ও বঞ্চনামুক্ত কাক্সিক্ষত বাংলাদেশের স্বপ্ন বিজয়ের দ্বিতীয় বর্ষের সূচনাতেই মারাত্মকভাবে হোঁচট খেয়েছে।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়েই স্বার্থান্বেষী মহল আখের গোছানোর প্রতিযোগিতায় আদাজল খেয়ে লাগে। বিহারিদের পরিত্যক্ত সম্পদ কুক্ষিগত করা ছাড়াও সরকারি কোষাগার লুণ্ঠন ও খাল-বিল-নদী-নালা, সাগর-বালি-পাহাড়-পর্বত গ্রাসের প্রতিযোগিতা রাতারাতি তুঙ্গে ওঠে। দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ, স্বার্থপর আমলা-কামলা ও পেশিশক্তির অধীশ্বর, অতি মুনাফাখোর-লুটেরা ব্যবসায়ী ও সর্বভুক গণদুশমনরা গাঁটছড়া বেঁধে সদ্য স্বাধীন দেশকে স্মরণকালের ভয়াবহ কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ ও সংকটের মুখে ঠেলে দেয়। লবণ-চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর গগনচুম্বী মূল্যে দেশবাসী দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে গালমন্দ দিতে শুরু করে। পাশাপাশি সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি, জাসদসহ বিভিন্ন ভুঁইফোড় সংগঠন তথাকথিত বাম দলের কাঁধে ভর করে গুপ্তহত্যা, লুণ্ঠনসহ ভয়ানক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। চুয়াত্তরের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি এবং মাৎস্যন্যায় দশার সুযোগে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিজনে বঙ্গবন্ধুকে এবং পরবর্তীতে জাতীয় চার নেতাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। খন্দকার মোশতাক ও বিচারপতি সায়েম এবং পরিশেষে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হওয়ার পরও গুপ্তহত্যা, ক্যু, পাল্টা ক্যুর চপেটাঘাতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির জন্ম নেয়। একপর্যায়ে সুযোগসন্ধানী সেনাপ্রধান এরশাদ বন্দুকের জোরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পর বিদ্যমান রাজনীতির নল-খোলস সবই পাল্টে যায়। মোদ্দাকথা, রাজনীতিবিদদের দেশপ্রেমের তীব্র ঘাটতি, দুর্দমনীয় লোভ, ভোটারদের নিকট জবাবদিহির চরম অনীহা, সর্বোপরি প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, সামরিক শক্তির উত্থান, ভোটারবিহীন ভোটদান প্রথা, দিনের ভোট রাতে হওয়া, মিডিয়া ক্যুর অজুহাতে নির্বাচনী ফলাফল বানচালসহ নানা অপরাধপ্রবণতার নাগ-নাগিনীর সাত প্যাঁচে বাংলাদেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র এবং জনগণের ভাগ্য আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ে। আর দিনে দিনে সেই রাহুবন্ধন জোরদার হয় এবং বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিতরা ও তাদের পোষ্যরা সিন্দাবাদের একচোখা দৈত্যের মতো গোটা দেশ এবং দেশবাসীকে আস্ত গিলে খেতে উদ্যত হয়।
বাংলাদেশের বিগত ৫৩ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গণরোষের কবলে পড়ে স্বৈরাচারী সরকারগুলোর পতনের দু-তিন মাসের মাথায় নতুন চাঁদাবাজ, লুটেরা, বিশেষ সুবিধেভোগী, সিন্ডিকেট, উঠতি স্বৈরাচার, বখাটে, ভিসা চক্র আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সাবেক পতিত সরকারের লুটেরাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে অল্প দিনে নতুন লুটেরারা খাল-বিল-নদী-নালা-জলাশয়, হাট-বাজার-রাস্তাঘাট, নিত্য অপরিহার্য সামগ্রীর দোকানপাট, দেশের প্রচলিত আইনশৃঙ্খলা সবকিছু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। সাদামাটা ভাষায় বলা যায়, যাবতীয় শোষণ-বঞ্চনা-হতাশা, অন্যায়-অত্যাচার-বৈষম্যের কবল থেকে চিরমুক্তি এবং অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসাসহ স্বাভাবিক জীবনযাপনের বুকভরা আশা নিশ্চিতের লক্ষ্যেই একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি প্রথম বিজয় দিবস উদ্্যাপন করেছিলেন। অথচ রাজনৈতিক ফায়দাভোগী এবং লুটেরা ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ছাড়া নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে বিগত ৫৩ বছরে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৮৫% এর যাবতীয় কামনা-বাসনা-চাওয়া-পাওয়ার কবর রচিত হয়েছে। আর দেশজুড়ে হতাশা-বিচারহীনতা, অপরাধপ্রবণতা-মাদকাসক্তি, অন্যায়-পেশিশক্তির উত্থান এবং সহস্র ধরনের নির্যাতন-নিগ্রহ ও শোষণ-বঞ্চনার অগ্নিগহ্বর তৈরি হয়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে ১৯৭২ সালের সূচনালগ্নে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে দুর্নীতি নামক মহাব্যাধির যে চারাগাছটি বপন করা হয়েছিল, জবাবদিহি ও আইনের শাসনের অভাবে বস্তুত প্রতিটি সরকারের আমলেই রাজনীতিবিদদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তা বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়ে সমগ্র জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিস্তার লাভ করেছে। অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার, পেশিশক্তির মাত্রাতিরিক্ত উত্থান, স্বজনপ্রীতির সঙ্গে গাঁজা, ভাং, ফেনসিডিলসহ নেশা উদ্দীপক মাদকদ্রব্যের ব্যবহার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বিস্তার লাভ করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নীতিভ্রষ্ট সদস্য এবং রাজনৈতিক উচ্ছিষ্টভোগীদের প্রত্যক্ষ আশকারায় শহর-বন্দরের অলিগলি, গ্রামের ঝোপঝাড়, শ্মশান-গোরস্থান এবং গ্রামগঞ্জের ছোটখাটো হাট-বাজারও ইয়াবা, ভাং, গাঁজা ইত্যাদির কেনাবেচা ও সেবনের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। আর নেশাখোর-মাস্তান জবরদখলকারীরা দেশজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে বলে খবরে প্রকাশ। বিগত ৫৩ বছরের ভৌতিক ও অবকাঠামোগত যাবতীয় উন্নয়ন এবং অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে বাংলাদেশের উত্তরণসহ সামগ্রিক অর্জনও প্রকৃত প্রস্তাবে বুভুক্ষু রাজনীতিবিদ ও স্বার্থান্বেষী আমলা-কামলাদের সর্বগ্রাসী উন্মত্ততার যূপকাষ্ঠে আত্মাহুতি দিয়েছে।
যাহোক, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, রক্তাক্ত জুলাই-আগস্ট বিপ্লব ইত্যাদি নানা মুখরোচক বুলির আড়ালে স্বৈরাচারী শাসকদের পতন ঘটলেও তাদের দোসর এবং প্রেতাত্মারা বাংলার মাটি-মানুষ-ঘর-প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং আনাচ-কানাচে সর্বদা স্থায়ী পালঙ্ক পেতে বসে থাকে এবং রয়েছে। তাদের অমানবিক ও নিষ্ঠুর শোষণ-নির্যাতন-লুণ্ঠন-কালোবাজারি-বঞ্চনা-আহাজারি বিষক্রিয়ায় গোটা বাংলাদেশ প্রজ্বলিত অগ্নিগহ্বরে পরিণত হয়েছে। রক্তাক্ত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন এবং ভারতে পলায়ন সেই বিস্ফোরণোন্মুখ আগ্নেয়গিরির সামান্য লাভা উদ্্গিরণের নামান্তর বৈকি! অনেক বিদগ্ধজনের দৃষ্টিতে সারা বাংলাদেশ এখনো শোষণ-বঞ্চনা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে আগ্নেয়গিরির লাভা উদ্্গিরণের অপেক্ষায় রয়েছে। তাই রক্তাক্ত জুলাই-আগস্টের ২ সহস্রাধিক প্রাণহানি এবং ২০ সহস্রাধিক পঙ্গু-বিকলাঙ্গের সর্বাত্মক ত্যাগের ফসল হিসেবে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য দেশ-বিদেশে যারা একের পর এক অযৌক্তিক দাবির পাহাড় নিয়ে মাঠ গরমের প্রচেষ্টায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত তাদের আত্মসমালোচনা ও আত্মবিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। কাক্সিক্ষত জাতীয় সংস্কারকে পাশ কাটিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে সোচ্চার না হয়ে জাতীয় অত্যাবশ্যকীয় সমস্যাদির জরুরি ভিত্তিতে আমূল সংস্কারে সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা প্রত্যেক দেশপ্রেমিক নাগরিকের উচিত বলে দেশবাসী মনে করেন। কারণ নব্বইয়ের স্বৈরাচার-বিরোধী সফল গণ-অভ্যুত্থানে প্রাণহানির সংখ্যা এক অঙ্কে সীমিত থাকলেও ২০২৪ সালের স্বৈরাচার-বিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে প্রাণহানির সংখ্যা ২ হাজারের মাইলফলক স্পর্শ করেছে। তাই কাক্সিক্ষত সংস্কারের আগে নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ক্ষমতার হাতবদল ঘটলে এবং কালেভদ্রে নতুন স্বৈরাচারের গোড়াপত্তন ঘটলে তার সমূল উৎপাটনে প্রাণহানির সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয় বলে বিশিষ্টজনদের ধারণা। এমনতর বাস্তবতায় ও বাংলাদেশে নিত্য-নতুন দানবের উত্থানের খবরে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, কাক্সিক্ষত বিজয়ের সুফল লাভে আর কত প্রাণহানি চাই!
৫৩তম বিজয় দিবসে ঠিকানার পক্ষ থেকে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের বীর শহীদ, বিশেষত ১৪ ডিসেম্বরের বর্বরোচিত হামলায় নিহত জ্ঞানসাধক, বুদ্ধিজীবী এবং মহান শহীদদের আত্মার চিরপ্রশান্তি, সম্ভ্রমহারা মা-বোনদের প্রতি গভীর সহমর্মিতা, জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের সুস্বাস্থ্য এবং শুভানুধ্যায়ীদের সামগ্রিক কল্যাণ কামনা করছি।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক।