Thikana News
০৬ জুলাই ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ০৬ জুলাই ২০২৪

আহমদ ছফা : মনন ও সাহিত্যবোধ

আহমদ ছফা : মনন ও সাহিত্যবোধ
এবিএম সালেহ উদ্দীন

(গত সপ্তাহের পর)

তিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকার কর্তৃক বাকশাল গঠনের প্রকাশ্য বিরোধিতা করেছিলেন। বাকশালের বিরুদ্ধে লেখেন এবং ঘরে ঘরে গিয়ে বাকশালে যোগদানে নিষেধ করেন। একপর্যায়ে তখনকার সরকারদলীয় ক্যাডারদের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হন এবং তাঁকে প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হয়। এই সময় অধ্যাপক কবির চৌধুরী ও ড. আনিসুজ্জমান, ড. আহমদ শরীফসহ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর কথায় আহমদ ছফা ঢাকা ছেড়ে কুমিল্লায় চলে যান। সেখানে তিনি কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে (বার্ড) যোগদান করেন। এখানে নিরিবিলি পরিবেশে জার্মান কবি গ্যাটে রচিত ‘ফাউস্ট’ অধ্যয়ন ও অনুবাদ শুরু করেন। অনুবাদসাহিত্যে তাঁর মনোনিবেশের সুউজ্জ্বল গভীরতার প্রকাশ পেয়েছে।

তেমনি কবিতায়ও আহমদ ছফার সদর্প বিচরণ ছিল। কবিতার মানদণ্ডে সেগুলো শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। তার রচিত কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ রয়েছে। এ ছাড়া তার বেশ কিছু গান ও গীতিনাট্য আছে। আগেই উল্লেখ করেছি, আহমদ ছফা ১৯৭০ সালে জার্মান সাহিত্যিক গ্যেটের ফাউস্ট অনুবাদ শুরু করেন। সৃজনশীল প্রকাশনার পথিকৃৎ বাবু চিত্তরঞ্জন সাহা কর্তৃক তার প্রকাশনা সংস্থা মুক্তধারা থেকে বিখ্যাত ‘ফাউস্ট’ অনুবাদগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
১৯৭৬ সালে ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ একটি সুদীর্ঘ প্রবন্ধ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের হাজার বছরের বিবর্তন বিষয়ে বিশ্লেষণপূর্বক বাঙালি মুসলমানের পশ্চাদগামিতার কারণ অনুসন্ধান করেছেন। বাংলা সাহিত্যের পণ্ডিত ও প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জমান এবং বুদ্ধিজীবী সলিমুল্লাহ খানসহ আরও অনেকে আহমদ ছফার ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ (১৯৮১) প্রবন্ধ সংকলনটিকে বাংলা ভাষায় রচিত শতাব্দীর ‘সেরা দশ চিন্তার বইয়ের’ একটি বলে মনে করেন।
আহমদ ছফার রচিত প্রতিটি উপন্যাসই সৌকর্যময়। সৃজনে বিষয়বস্তু এবং শিল্পশৈলীতে অনন্য। বাংলার মানুষের শিল্প-সাংস্কৃতিক ও আর্থসামাজিক অনুষঙ্গে প্রতিটি উপন্যাসের চরিত্র সৃষ্টির যথার্থ পারঙ্গমতাও অসাধারণ।

আহমদ ছফার ‘অঙ্কার’ (১৯৭৫) বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিসংগ্রামের সর্বোত্তম সাহিত্যের বহিঃপ্রকাশ।
শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে রচিত ‘গাভী বৃত্তান্ত’ (১৯৯৫) বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাসের মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়া ‘পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ’ (১৯৯৬) উপন্যাসে আহমদ ছফা ঢাকা শহরের পার্কের বৃক্ষরাজির পুষ্পোদ্যান, ফুল, পাখি, বৃক্ষ-লতার রূপসুন্দর প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের নিজস্ব স্বকীয়তার বর্ণনার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। এ ছাড়া বাংলা সাহিত্যের কতিপয় বিদগ্ধ কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীকে নিয়েও আহমদ ছফার রচনা রয়েছে। শিল্পী এস এম সুলতানের জীবনাচার নিয়ে তাঁর বেশ কয়েকটি প্রবন্ধে যে অনুপম বর্ণনা করেছেন, তা প্রশংসনীয়। সুলতানের শিল্পবোধ ও বিশাল শিল্পকর্ম সম্পর্কে আহমদ ছফা যেভাবে মূল্যায়ন করেছেন, তেমনটি কেউ করেছেন বলে আমার জানা নেই। তিনি সুলতানকে মনে করতেন একজন সত্যিকার পূর্ণায়ত মানুষ হিসেবে। যাঁর শিল্পকর্মে মানুষ ও প্রকৃতির বিষয় সুউজ্জ্বলরূপে ফুটে উঠেছে। একসময় তিনি চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেলেন। চরিত্রগত অবয়ব ও জীবনাচারে দুজনই ছিলেন অবিবাহিত, বোহেমিয়ান ও ভবঘুরের মতো। ধন-সম্পদের প্রাচুর্য ও বৈষয়িক মোহ-বিবর্জিত নির্লোভ মানুষ ছিলেন তিনি।

আহমদ ছফা অকপটে বলতেন, ‘শিল্পী এস এম সুলতান ছিলেন মানবতা ও প্রকৃতিপ্রেমী দার্শনিক। বাংলার মাটির প্রতীক ও বাংলার খাঁটি মানুষ। আমাদের চারপাশে ঘিরে থাকা খুঁটিনাটি সমস্যাগুলোই ছিল তার শিল্পের উপাত্ত। শিল্প-সংস্কৃতির জগতে তাকে সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসেনি।’
আহমদ ছফা মনে করতেন, এই বাংলায় সুলতানকে আরও বেশি দরকার। জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানরাও বড় শিল্পী, ভদ্রলোক। তবে খেটে খাওয়া মানুষের কাছে শিল্পের জায়গা করে দিতে হলে সুলতানদের কোনো বিকল্প নেই বলেই তিনি বিশ্বাস করতেন।

এ প্রসঙ্গে আহমদ ছফা নিজেই বলেছেন :

‘আমি মনে করি, আমার স্বীকৃতি নিয়ে পশ্চিম বাংলা কী বলতে চায়, সেটা আমার লুকআউট নয়। আমি পৃথিবীর গন্ধ এবং স্বাদ বুঝি। তুমি দেখবা আমি যখন আমেরিকায় যাবো তখন ওখানেও ঝড় তুলবো। তখন ওখানকার পণ্ডিতদের সাথে দেখবে আমি কীভাবে মিশে গেছি। সুলতানের বিশালত্ব চিন্তা করো, ৭৬-এর আগে এই জায়ান্ট কোথায় ছিল? কেউ তাকে আবিষ্কার করলো না কেন? এই আমি যাকে প্রেজেন্ট করেছি, আরেকজন লোক আসুক তো এমন।’
বাংলাদেশের সমসাময়িক কালের বিশিষ্ট পণ্ডিত জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক প্রসঙ্গে রচিত ‘যদ্যপি আমার গুরু’ স্মৃতিধর্মী গ্রন্থ লিখেছেন তিনি। সাহিত্যের সকল শাখায় অবাধ বিচরণ ছাড়াও তিনি পত্রিকা সম্পাদনা ও দেশের স্বার্থে অসংখ্য রাজনৈতিক প্রবন্ধ এবং উপলক্ষের লেখা লিখেছেন।

বাংলা সাহিত্যে আহমদ ছফার রচনাবলি এক অমূল্য সম্পদ। নিজের সাহিত্যকর্ম ও চিন্তাদর্শন নিয়ে তিনি উল্লেখ করেন :
‘আমি জাতি হিসেবে বাঙালি মুসলমানের অপূর্ণতা, অক্ষমতা এবং অসহায়তার দিকটাই তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। বাঙালি মুসলমানরা এ দেশের মাটির আসল সন্তান। তারা প্রভুত্বকামী আর্যদের সঙ্গে যেমন সম্পর্কিত নয়, তেমনি আগ্রাসী তুর্কি, তাতার, ইরানী, তুরানীদেরও কেউ নয়। শুরু থেকেই বাঙালি মুসলমান একটা নির্যাতিত মানবগোষ্ঠী।’
বাংলা সাহিত্যে আহমদ ছফার মেধা ও মননের তীক্ষèতার কারণেই বোধ হয় এমএ পাস করার পূর্বেই অধ্যাপক কবির চৌধুরীর (বাংলা একাডেমির তৎকালীন পরিচালক) মাধ্যমে নিয়ম ও প্রটোকলের বাইরে আহমদ ছফা বাংলা একাডেমিতে তিন বছরের জন্য (পিএইচডি) ফেলোশিপ প্রোগ্রামের জন্য মনোনীত হন। কারণ হলো, সৃজনে, মননে এবং সৃষ্টিশীল সাহিত্যকর্মে আহমদ ছফার ঈর্ষণীয় যোগ্যতা। আর যোগ্যতার সুসম ব্যবহার হলেই সাফল্যের মসৃণ হয়।

ছফা ভাই তাঁর প্রতি কবির চৌধুরী স্যারের অসামান্য অবদানের কথা একদিন আমাদের এক ঘরোয়া আসরে গল্পের ছলে বলে ফেলেছিলেন। আশির দশকে আমার তরুণতম ছাত্রজীবনে ছফা ভাইয়ের অসাধারণ জীবনচরিত সময়ের স্মৃতিগুলো যেন একেকটি সাহিত্য উপাখ্যান। তারপর নিউইয়র্কে একই ছাদের নিচে টানা তিন মাস।
স্মৃতিকে সঙ্গে করেই মানুষের বসবাস। ছফা ভাইয়ের সঙ্গে স্মৃতিসমূহ আমাদের চারপাশ ঘিরে আছে। সেই স্মৃতি সাহিত্যে, মননে, সৃজনে এবং আমাদের যাপিত জীবনের পরতে পরতে।

আহমদ ছফার সাহিত্য রচনা পাঠ করলে কখনো মনে হতো যেন স্রোতের বিরুদ্ধে বিবেকী সন্তরণ, যা পাঠ করলে মানুষকে ঘোরমুক্ত করে তোলে। অবক্ষয়ী সমাজ আলোর পথ দেখতে পারে। মানুষের মাঝে মানবিক আদর্শ ও বিবেকবোধ জাগ্রত করতে পারে।
ব্যক্তিগতভাবে সাদাসিধে সরল জীবনযাপনকারী আহমদ ছফা ছিলেন নিরন্ন মানুষের প্রতিভূ। সাহিত্যের আবেগ ও আদর্শে তাঁকে দুঃখী মানুষের বন্ধু এবং সঙ্গী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। শিক্ষিত যুবসমাজের আগামী দিনের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে তিনি অনেকের কাছে তারুণ্যের প্রতীক।
স্বাধীনতার পর আহমদ ছফার কিছু লেখা নিয়ে ঢাকা ও কলকাতার সাহিত্যাঙ্গনে তুমুল আলোড়ন ও হইচই শুরু হয়ে যায়। কেননা সাহিত্যে তিনি কোনো গোঁজামিল পছন্দ করতেন না। তিনি যা ভাবতেন, অকুণ্ঠচিত্তে লিখতেন এবং সেই অনুপাতে নিজের জীবনেও প্রতিফলিত করার জন্য দৃঢ় থাকতেন।

আহমদ ছফার ওপর আঠারো শতকের ইয়ং বেঙ্গল প্রতিষ্ঠাতা ক্ষণজন্মা কবি ও বুদ্ধিজীবী হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর প্রভাব ছিল। যিনি তৎকালীন সময়ে ভারতীয় রাষ্ট্র ও সমাজে চেপে থাকা মানববিদ্বেষী কুসংস্কার, যেমন সতীদাহসহ এ ধরনের ভয়ংকর প্রথার মূলোৎপাটনের পক্ষে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ডিরোজিওর মানবতাবাদী আন্দোলন ভারতবর্ষে ক্ষিপ্রতর ও জোরদার হয়েছিল। আহমদ ছফার মাঝেও সে রকম একটা উজ্জ্বল চেতনার নিদর্শন দেখা যায়। চিন্তা ও দর্শনে সামাজিক অবক্ষয় দূষিত রাজনীতিমুক্ত সুশীল সমাজ বিনির্মাণের পথে তিনি ছিলেন সক্রিয়। তাঁর মাঝে ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা ও হীনম্মন্যতা ছিল না।

কবি হিসেবেও আহমদ ছফা সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁর কবিতাগুলো যত বেশি পড়া যাবে, তাঁর ভেতরকার সাহিত্যমনস্ক চিন্তা-চেতনা সম্পর্কে জানার পথ সহজতর হবে। ‘কবি ও সম্রাট’ তাঁর সৃষ্টিশীলতার অনন্য দীর্ঘ সংলাপ কাব্য। 
সেটিকে একটি সুদীর্ঘ কাব্যনাটক হিসেবেও বিচার করা যায়। কবিতার ফরম্যাটে নাট্যচরিত্রের ঢংয়ে কবিতাটির মূল্যমানকে উচ্চকিত করেছে। তেমনি ‘বস্তি উজার’, ‘লেলিন ঘুমোবে এবার’সহ বেশ কয়েকটি দীর্ঘ কবিতা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

‘শুধু একটি শব্দের জন্য’ শিরোনামে কবিতার কটি লাইন এমন :
‘আমি গগনে মেঘ দেখামাত্র মেঘের অংশ
হয়ে গেলাম। বৃক্ষ দেখে বৃক্ষের আকার
ধারণ করলাম। যখন নদীর সান্নিধ্যে এলাম
ছলছল ধ্বনিতে বয়ে যাওয়ার আবেগ আমার
বুকের ভেতর তরঙ্গ সৃষ্টি করল। তারপরে
যখন আকাশের অভিমুখে দৃকপাত করলাম,
দেখলাম ঘুঙুর পরা নক্ষত্ররা একে একে
আমার প্রাণে এসে প্রাণের চেরাগ জ্বালিয়ে তুলছে।’
তেমনি ‘কবি ও সম্রাট’ গীতিনাট্যের প্রধান চরিত্র ‘মির’ তকির মতো তিনি বলেন :
‘মির :
জাঁহাপনা, খাকসার নালায়েক নাচিজ বান্দা
জন্মগুনাহগার, সবিনয়ে শ্রীচরণে নিবেদন রাখিÑ
আমার সহজ বাক্যে না নিন গোস্তাকি।
সম্রাট :
মির তকি মির, শশকের মতো শুধু ডানেবামে হেলো
নিজস্ব বয়ানটুকু মুকতসর বলো।’
‘বেতারে খবর ঝরে’ নামক কবিতায় তিনি জানান দেন :
‘সেই ঘৃণ্য দানবের নগ্ন বর্বরতা
ভিয়েতনাম সইবে না, সইবে না দুনিয়ার সংগ্রামী সেনানী।
আফ্রো’শিয়ার গহীন গহনবন, ফেনিল সমুদ্রতীরে।
মরুভর বুক কুঁড়ে অযুত নিযুত কণ্ঠ
বাতাসের হৃৎপিণ্ড চিরে চিরে কয়,
আদিম বর্বর তেজ বলদীপ্ত অহিংস হৃদয়
হিংসায় হিংসায় আজ নব পরিচয়।
তাই ধমনীর শেষে লালে, লিখে যাবো
সংগ্রামের রক্তাক্ত আকর।’
আহমদ ছফার মননশীল কাব্যসম্ভারের পূর্ণতা এমনই উজ্জ্বল।
জল্লাদ সময় (১৯৭৫) কবিতাটি প্রকাশিত পঁচাত্তরের কঠিনতম সময়ে তিনি লেখেন :
‘আমাদের এ সময় সুসময় নয়
জোয়ারে হিন্দোল দোলা, ভাটার মন্থর
চেনাজানা ভদ্র নদী ভেবে
যেজন ভালোভাবে ডিঙ্গা পৈতৃক বিশ্বাসে
জেনে রাখো সর্বনাশ সম্মুখে তোমার।’

রাষ্ট্র ও সমাজে ব্যক্তিগত চাহিদা কিংবা কোনো লোভনীয় চাতুর্যের ফাঁদে পা দিতে অনেক বিদ্বজ্জনকেও দেখা যায়। কিন্তু আহমদ ছফা ছিলেন তার সম্পূর্ণ উল্টো। কোনো লোভ ও স্পর্শকাতর স্বার্থপরতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। সাধারণত মানুষের স্বভাব যেমন থাকে, সেসব উতরে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অন্য রকম চরিত্রের একজন মনুষ্যত্ববোধের পূর্ণায়ত মানুষ। আচার-ব্যবহার, চাল-চলন ও স্বভাব-চরিত্রের মধ্যে অনেকটা নজরুল, নিটসে, ডিরোজিও এবং ইয়েটসের প্রভাব পরিলক্ষিত। চিন্তা-চেতনায় প্রকৃতি ও প্রাণিকুলের প্রতি গভীর অনুরাগ ও গুরুত্বশীল এবং সর্বোপরি মানবীয় গুণাবলির একজন রোমান্টিক মানুষ। তিনি ছিলেন স্বার্থবিরোধী বিত্তবৈভবের প্রতি উদাসীন একজন সাদামাটা মানুষ। মানুষের কল্যাণ চিন্তাই ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম আদর্শ। চিন্তা-চেতনায় আপাদমস্তক একজন খাঁটি বাঙালি।

তাঁর রচিত উপন্যাসের মধ্যে ‘পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ’, ‘গাভী বৃত্তান্ত’, ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’, ‘আলাতচক্র’, ‘সূর্য তুমি সাথী’, ‘অঙ্কার’, ‘একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন’ এবং ‘মরণবিলাস’। কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘জল্লাদ সময়’, ‘লেনিন ঘুমোবে এবার’, ‘বস্তি উজাড়’, ‘দুঃখের দিনের দোহা’, ‘একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা’ ও ‘আহমদ ছফার কবিতা’ (কাব্যসমগ্র) বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এ ছাড়া অনুবাদগ্রন্থ ‘ফাউস্ট’, ভ্রমণকাহিনি ‘চৎড়ংঢ়বপঃরাব এবৎসধহু’, গল্পগ্রন্থ ‘নিহত নক্ষত্র’, ‘দোলা আমার কনকচাঁপা’ (ছোটদের), প্রবন্ধের বইয়ের মধ্যে ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’, ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’, ‘বাংলা ভাষা : রাজনীতির আলোকে’, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’, ‘বাঙালি মুসলমানের মন’, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ’, ‘আহমদ ছফার নির্বাচিত প্রবন্ধ’, ‘রাজনীতির লেখা’, ‘আনুপূর্বিক তসলিমা ও অন্যান্য স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ’, ‘নিকট ও দূরের প্রসঙ্গ’, ‘সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’, ‘শতবর্ষের ফেরারি : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়’, ‘শান্তিচুক্তি ও নির্বাচিত নিবন্ধ’, ‘আহমদ ছফার প্রবন্ধ’, ‘রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক প্রবন্ধ’, ‘বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র’, ‘আমার কথা ও অন্যান্য প্রবন্ধ’, ‘উপলক্ষের লেখা’ এবং ‘সংকটের নানান চেহারা’। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে নিয়ে স্মৃতিধর্মী বই ‘যদ্যপি আমার গুরু’। এ ছাড়া ‘সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস’ গ্রন্থ এবং আহমদ ছফার বেশ কিছু সাক্ষাৎকার নিয়ে একটি বড় সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের জনজীবনের দুর্ভোগ, রাজনৈতিক, সামাজিক অস্থিরতা ও রাষ্ট্রীয় অনাচারবৃত্তির প্রতিবাদে সংবাদপত্রে তাঁর সমকালীন লেখাগুলো ছিল একেকটা তিরের মতো। স্বাধীনতার পর ‘দৈনিক গণকণ্ঠে’র প্রধান সম্পাদক থাকাকালে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ নামে ধারাবাহিক কলাম লেখার মধ্য দিয়ে আহমদ ছফার মেধা, মনন ও সৃজনে তীক্ষè বুদ্ধিমত্তার উজ্জ্বলতর দিকটি প্রকাশ পায়।

লেখক-সাহিত্যিকদের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালোবাসা। তাদের স্বার্থে তিনি সর্বদা ছিলেন উদার। বিশেষ করে, নবীন ও তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের ভালো লেখা প্রকাশ করার জন্য তিনি সব সময় প্রেরণা দিতেন। তিনি নিজের অর্থে অনেক তরুণ মেধাবী লেখকের বই প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের প্রথম বই ‘নন্দিত নরকে’ আহমদ ছফার উদ্যোগে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। শুধু তা-ই নয়, হুমায়ূন আহমেদের পুরো পরিবার শহীদ মুক্তিযুদ্ধ পরিবার হিসেবে তাদের প্রতি আহমদ ছফার বিরাট ভূমিকা ছিল। এ প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ ও মুহাম্মদ জাফর ইকবালের লেখায় উল্লেখ আছে। ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালের একটি প্রবন্ধের মূল বিষয় ছিল আহমদ ছফা। তিনি (জাফর ইকবাল) অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী ও আবেগময় লেখাটিতে তাদের প্রতি ছফা ভাইয়ের অবদানের কথা উল্লেখ করেছেন। আহমদ ছফার জীবনবোধের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি সময়ের মানুষের সঙ্গে একাত্ম হতে পারতেন। তাঁর ভেতরকার মানবিক গুণাবলির উজ্জ্বল দৃষ্টান্তসমূহ অনির্বাণ হয়ে আছে। তাঁর রচনাবলির সবকিছুই সব সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক। আমাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যগাথা সংস্কৃতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য তাঁর রচনাসমূহ সকল সময়ের জন্য উপযোগী এবং তিনি তার ওপর সারা জীবন কাজ করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায় তরুণ কবি আবুল হাসানের পুনর্ভর্তি হওয়া দরকার ছিল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য। কিন্তু আবুল হাসানের হাতে তখন কোনো টাকাপয়সা ছিল না। আহমদ ছফা বিষয়টি জ্ঞাত হওয়ার পর নিজের বইয়ের ‘রয়্যালিটির’ সম্পূর্ণ টাকা আবুল হাসানের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাকে পুনর্বার ভর্তির জন্য। ছফা ভাইয়ের জীবনে এ রকম অনেক উদাহরণ রয়েছে।

স্বাধীনতার পর আধুনিক ও রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদের সরকারি ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। তখন কবি খুব অসুস্থ ছিলেন। আহমদ ছফা বিষয়টি জানতে পেরে প্রশাসনের ওপর খেপে যান। বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম কবি অসুস্থ, অথচ কোনো এক অজানা অজুহাতে সরকারের তরফ থেকে টাকা প্রদান বন্ধ থাকবেÑএটা আহমদ ছফা মেনে নিতে পারেননি। তিনি সহজে তা মেনে নেওয়ার মানুষ ছিলেন না। তিনি বিষয়টি নিয়ে হইচই শুরু করে দিলেন। প্রকাশ্য প্রতিবাদ করলেন। অবশেষে সরকারের তরফ থেকে কবি ফররুখ আহমেদের জন্য টাকা প্রদানের পুনর্ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
১৯৭৫ সালে তখনকার তরুণ কবি নির্মলেন্দু গুণকে অজ্ঞাত কারণে আর্মি গ্রেপ্তার করে রমনা থানাহাজতে নিয়ে গিয়েছিল। আহমদ ছফা সেই খবরটি পাওয়া মাত্র নির্মলেন্দু গুণকে ছাড়িয়ে আনার জন্য থানায় ছুটে গিয়েছিলেন। তিনি গুণকে ছেড়ে দিতে থানার ওসির সঙ্গে বাগ্্বিতণ্ডা পর্যন্ত করেন। সাত দিনের মধ্যেই কবি নির্মলেন্দু গুণ ছাড়া পান।

আরেক মেধাবী ও প্রতিবাদী তরুণ কবি ছিলেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। তিনি তাকে খুব স্নেহ করতেন। রুদ্র যখন পাকস্থলীর আলসারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন, ছফা ভাই তাঁকে নিয়মিত দেখতে যেতেন। রুদ্রকে দেখে তার সঙ্গে সময় দিতেন এবং ফিরে আসার সময় রুদ্রের বালিশের নিচে টাকাভর্তি খাম রেখে আসতেন। শুধু তা-ই নয়, তার আগে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর প্রথম কবিতার বই ‘উপদ্রুত উপকূল’ ছফা ভাইয়ের খরচে প্রকাশিত হয়। রুদ্রর জীবন উপাখ্যান ও তসলিমা নাসরীনের সঙ্গে বিবাহ পর্বসহ অনেক কিছুতেই আহমদ ছফার প্রত্যক্ষ অবদান রয়েছে। তিনি রুদ্রর পড়ার খরচসহ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তেমনই অকালপ্রয়াত তরুণ ছড়াকার বাপ্পী শাহরিয়ারসহ অনেকের বই প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আহমদ ছফা সাহায্য করেন। মেধাবী তরুণ কবিদের সাহিত্যজগতে পরিচিত করেন। অকালপ্রয়াত মেধাবী তরুণ কবি রকিবুল হক ইবনের প্রথম কাব্যগ্রন্থের ওপর প্রেরণাধর্মী একটি ভূমিকাও লিখে দিয়েছিলেন।

আহমদ ছফা লেখক-সাহিত্যিকদের স্বার্থে তাদেরকে একটি প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার প্রত্যয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম লেখক শিবির প্রতিষ্ঠা করেন। এই শিবিরে কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসসহ অনেক বিদগ্ধ কবি-সাহিত্যিক যোগদান করেছিলেন। এ ছাড়া তিনি সাহিত্য আসরের ব্যবস্থা করেছিলেন। নিয়মিতভাবে সেসব সাহিত্য আড্ডা জমে উঠেছিল। ড. আহমদ শরীফ, রনেশ দাশগুপ্ত, আলাউদ্দীন আল আযাদ, কাজী সিরাজ, মুহম্মদ নুরুল হুদা, সরদার ফজলুল করিম, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সন্তোষ গুপ্ত, আবদুল হালিম, সৈয়দ আকরম হোসেনসহ অনেকেই সাহিত্য আসরে যোগ দিতেন। এ ছাড়া মাঝে মাঝে কবি শামসুর রাহমান ওইসব সাহিত্য আড্ডায় যোগ দিতেন।

বাংলা সাহিত্যের অনেক খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকের মতে, মীর মশাররফ হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলামের পরে জনপ্রিয় গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি মুসলমান জনপ্রিয় সাহিত্যিক হলেন আহমদ ছফা। তাঁর রচনায় আমাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবোধ ও বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে। প্রকৃতির কাজে মানুষের অংশগ্রহণ হয় যেমন তার প্রবৃত্তি, অভ্যাস ও সমাজ সংস্কারের প্রয়োজনে; তেমনি দর্শনে, বিজ্ঞানে, শিল্প-সাহিত্যে, সংস্কৃতি ও সভ্যতার ঐতিহ্যকে ধারণ করেই আহমদ ছফা তাঁর সাহিত্য রচনা করেছেন।

বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় রয়েছে আহমদ ছফার বিচরণ ও মননের ছাপ। তাঁর মেধা, মননচিন্তা, দর্শন ও সাহিত্যাদর্শের প্রতিটি শাখায় প্রেম, বিরহ, দ্রোহ, বেদনাবোধ, প্রকৃতি ও মানবকল্যাণের দিকনির্দেশনা বিদ্যমান। তাঁর কর্মজীবন, শিল্পবোধ ও সাহিত্য ইতিহাসের অবিস্মরণীয় অংশ হিসেবে অক্ষয় হয়ে থাকবে। সব দিক দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বাতাসের মুক্ত সাহিত্যাদর্শের ঔজ্জ্বল্যেই আহমদ ছফা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় ও অনির্বাণ হয়ে থাকবেন।

(২৮ জুলাই আহমদ ছফার মৃত্যুদিবস উপলক্ষে লিখিত)

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

কমেন্ট বক্স