পাঁচ হাজার বছর আগে সুমের নামক মেসোপটেমিয়ার একটি অংশে বসবাসকারী লোকেরা কিউনিফর্মের সঙ্গে রেকর্ড রাখতে শুরু করেছিল। এটি ছিল লেখার প্রাচীনতম পদ্ধতি। কিউনিফর্মের আবির্ভাব হওয়ার প্রায় এক সহস্রাব্দ পর, এনহেডুয়ানা নামের একজন পুরোহিত এই লেখার পদ্ধতিটিকে একটি নতুন উপায়ে ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন। অর্থাৎ সুমেরীয়রাই প্রথম দূর-দূরত্বের বাণিজ্য যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে লেখার উদ্ভাবন করেছিল। লেখার প্রাচীনতম রূপটি ছিল পিকটোগ্রাফ বা চিত্রকল্প। পিকটোগ্রাফগুলো বস্তু, ধারণা বা ক্রিয়াকে উপস্থাপন করতে সাধারণ অঙ্কন বা প্রতীক ব্যবহার করত। এই পিকটোগ্রাফগুলো ভেজা কাদামাটিতে ছাপিয়ে তৈরি করা হতো, যা পরে শুকানো হতো এবং অফিশিয়াল বাণিজ্যিক রেকর্ডে পরিণত হতো। প্রাচীন যুগে পিকটোগ্রাফ ব্যবহারের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন কাজে তথ্য বা লেখা সংরক্ষণ করা। পিকটোগ্রাফের মাধ্যমে শিল্প, ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান, ও অন্যান্য বিষয়ে মূল্যবান তথ্য এবং জ্ঞান সংরক্ষণ করা হতো। প্রাচীন সময়ে স্তম্ভ, শিল্পকলা, অঙ্কিত রস্ম, মসজিদ, মন্দির, স্তূপ, গোমটি, ছাতা, স্মৃতিস্তম্ভ, ছবি ইত্যাদির উদ্দেশ্যে পিকটোগ্রাফ ব্যবহৃত হতো।
যা-ই হোক, তারপর আসে আইডিওগ্রাফিক রাইটিং সিস্টেম, যা নির্দিষ্ট শব্দের পরিবর্তে ধারণা বা বিষয়বস্তু প্রতিনিধিত্ব করতে প্রতীক বা অক্ষর ব্যবহার করত। প্রাচীন মিসরীয় হায়ারোগ্লিফ লিখন পদ্ধতির একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তারপর একে একে সিলেবিক লেখা, বর্ণানুক্রমিক লেখা আরও বহু কিছু আবিষ্কার হয়। সেই সঙ্গে আসে প্রি-পেন্সিল, গ্রাফাইট, গ্রাফাইট পেন্সিল, মডার্ন পেন্সিল। অবশেষে এখন আমরা লিখি কিবোর্ড চেপে। আধুনিক ফোনের স্পিকারে কণ্ঠ দিলেই এখন লেখা টাইপ হয়ে যায়।
লেখার এই টুকিটাকি ইতিহাস লেখক-কবি সবার জানা। যা জানা নেই বা প্রায়শই ভাবতে গিয়ে বিব্রত হতে হয়, তা হলো একজন লেখক বা কবি প্রথম কবে তার গল্প, প্রবন্ধ বা কবিতাটি লিখেছিলেন। আমি কবে জন্ম নিয়েছি, সে প্রশ্নের জবাব দেওয়া সহজ। তবে কবে থেকে লেখালেখি শুরু করি বা প্রথম কবিতা কবে লিখেছিলাম, তা বলা মুশকিল। সহজ করে বলতে গেলে, আমি সেই মুহূর্ত থেকে লিখতে শুরু করেছি, যখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে শব্দের একটি শক্তি রয়েছে, যা বিশ্বকে আকার দেয়, আবেগকে জাগিয়ে তোলে এবং মানুষের অভিজ্ঞতার সারমর্মকে ক্যাপচার করে।
কবিতা লেখার শুরুর সময়টা ছিল যখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। তখন আবোলতাবোল যা-ই লিখতাম, তা-ই ছিল কবিতা। প্রতিটা অক্ষর শব্দের ব্যবহারে আবেগ ছিল উপচে পড়ার মতো। বলা যায় জলতরঙ্গ। অবুঝ বয়সে সম্ভবত সবাই কোনো কারণ ছাড়াই দুঃখী হতে চায় কিংবা একটা দুঃখ দুঃখ ভাব শিশুদের আনন্দ দেয়। আমাকেও দিত। দুঃখী হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। নিজেই খুঁজে নিতাম দুঃখ। তারপর সেই দুঃখবোধ থেকে লিখে ফেলতাম অন্ত্যমিলের ছয় বা আট লাইনের কবিতা। খুঁটে খুঁটে বের করা দুঃখগুলো ছিল হাস্যকর। এই যেমন, মা কেন আজ দেরিতে খাবার দিল; আমার ঈদের পোশাক আছে, বন্ধুরা কেন কিনতে পারে না আমার মতো দামি সুন্দর পোশাক; ভালো লাগছে না স্কুলে যেতে, তবু মা কেন জোর করে স্কুলে পাঠাল; বন্ধু কেন আজ আমাকে সময় দিল না, কেন অন্য বন্ধু তার প্রিয় হয়ে গেল... ইত্যাদি ইত্যাদি। নগরবাউল জেমস তার প্রিয়তমার জন্য বিষাদের সুরে গেয়েছিলেন তার ‘অনন্যা’ গানটি। কিন্তু আমি তখন প্রেম বুঝি না, সুর বুঝি। তাই গানটি শুনে কল্পনা করতাম আমার মাকে, ভাবতাম মা মরে গেলে কী হবে? সেই কাল্পনিক কষ্ট যোগ করতাম জেমসের গানে আর বিরহ বিষাদে ভরা তার গিটারের টান ও কণ্ঠে। তারপর কেঁদে বুক ভাসাতাম আর মাকে নিয়ে কবিতা লিখতাম। মাকে নিয়ে সে কবিতার প্রথম দুটো লাইন ছিল, ‘মা মা গো! তুমি ছাড়া আমি শূন্য/ তুমি আছো বলেই আজ আমি ধন্য।’ বাকিটা আর না-ইবা বললাম! অবুঝ বয়সের আবেগ আড়ালেই না হয় থাকুক।
আজ একটা সময়ের পর প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছি। জীবনের অভিজ্ঞতায় দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। জ্ঞান বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বকে আরও জটিলতার সঙ্গে জানতে পেরেছি। আজ আবেগের চাইতে বাস্তবতাই মূল্য রাখে বেশি। আজকের এই দিনে শৈশব-কৈশোরের আবেগ আর কাজ করে না। এখন জীবনের অঙ্ক মেলাতে গিয়ে যখন হিমশিম খাই, বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে প্রতিটা দিন যখন লড়াই করে বাঁচতে হয়, যখন চারপাশের নৃশংসতা, বৈষম্য, শ্রেণিবিভাজন আর অরাজকতা-অমানবিক দৃশ্যগুলো রাতের ঘুম হারাম করে দেয়, সমাজ-সহমর্মিতা আর সৌহার্দ্যরে বদলে বুকে চেপে বসে মুখের ওপর বমি উগড়ে দেয়, তখনই কবিতার অক্ষর আর শব্দেরা মাথায় কিলবিল করে ওঠে।
আমি আসলে কেন লিখি-এর সঠিক পূর্ণ ব্যাখ্যা দেওয়া মুশকিল। হেমিংওয়ে, গার্সিয়া কিংবা জীবনানন্দের মতো কাব্যিক তুখোড় ভাষায় আমি এর জবাব দিতে পারব না। দিতেই হবে কেন? জগতে এমন কিছু প্রশ্ন থাকে, যার কোনো সঠিক উত্তর আমরা দিতে পারি না। যেমন আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আপনি আপনার মা-বাবা বা সন্তানকে কতটা ভালোবাসেন, আপনি সঠিক কোনো জবাব বা বিশ্লেষণে যেতে পারবেন না। কবিতা কেন লিখি-এই প্রশ্নটাও অনুরূপ। মানুষ শুধু মুখ দিয়ে খাদ্য গিলে বাঁচে না, মানুষের মনের খোরাকও লাগে। জীবজগতের অন্য প্রাণীদের সঙ্গে মানুষের তফাত এইখানেই। আমাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হচ্ছে সুকুমারবৃত্তির চর্চা। চিত্তের আনন্দের জন্য খোরাক জোগাড় করা। কেউ গান গেয়ে মনে আনন্দ পান, কেউ ছবি এঁকে, নাট্যচর্চা বা নৃত্যচর্চা করে আনন্দ পান। কেউ আবার পরনিন্দায় মনের খোরাক জোগান, কেউবা লেখার মাধ্যমে সৃজনশীল কিছু করে আনন্দ পান। সবশেষে ধারণায় আনতে পারি, আমি কবিতা লিখি মনের খোরাক জোগান দিতে। অর্থাৎ আত্মতৃপ্তির জন্য, মনের সন্তুষ্টির জন্য।
সবকিছু নিয়েই আমি লিখি। গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস লিখি। তবে কবিতা আমার প্রাণে অন্য রকম এক আন্দোলন তোলে। এই লেখালেখির কাজটা গিয়ে কখনো আমাকে কফির কাপে পড়ন্ত বিকেলের দৃশ্যমান চিত্রে হাঁপাতে হয় না। উপন্যাস বা শব্দভান্ডারের পাতা খুঁটে সাজাতে হয় না মনগড়া গল্প বা দুর্দান্ত একটি কবিতা। লেখার বিষয় বা উপকরণ জোগাতে গোধূলিলগ্নে সমুদ্রপাড়ে মন ভার করে বসে থাকতে হয় না। কিংবা বিশেষ কোনো কবির বিশেষত্বে মগ্ন হতে হয় না। সময় পেরিয়ে যাওয়া ফ্যাকাশে কাগজ হাতে; ম্যানহাটনের কলেজ ক্যাম্পাসে যাওয়ার পথে সেভেন ট্রেনের তৃতীয় বগিটিই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। জীবনকে বুঝে ওঠার পর থেকে আমার লেখালেখির শুরুটা ঠিক এমনই ছিল।
ছোট থেকেই দেখেছি, আমার বাবা প্রচুর বই পড়তেন এবং লিখতেন। তিনি ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ। এরও ঊর্ধ্বে তাঁর পরিচয় ছিল একজন ভাবুক মানুষ হিসেবে। তিনি ছিলেন একজন গীতিকার, লেখক, সুরকার, নাট্যকার, সংগীতশিল্পী ও মঞ্চ অভিনেতা। তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্রে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে গাওয়া ‘চিরদিন তোমাকে ভালোবেসে যাবো’ গানের লিরিক্স ও সুরের জন্য জাতীয় পুরস্কার জিতেছেন। বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্রের তালিকাভুক্ত সংগীতশিল্পী ছিলেন তিনি। তাঁর ‘প্রতিভা শিল্পী গোষ্ঠী’ নামে একটি সংগীত দল ছিল। আমার বাবা গামছা বা নকশিকাঁথা কাঁধে নিয়ে বটতলে বসে দিনমজুর আর সাধারণ জীবনযাপন করা মানুষগুলোর সঙ্গে বেহালায় সুর তুলতেন রোজ। এখন যদি আমি দাবি করি, আমার মধ্যে এই শিল্পসত্তা আমার পৈতৃকসূত্রে পাওয়া, তবে সেটা ভুল হবে না। আমার বাবাও এসব করতেন মনের খোরাক জোগাতে। তাই তাঁর লিখে যাওয়া পাঁচ হাজারের মতো গান, কবিতা, নাটকের অধিকাংশই এখনো অপ্রকাশিত।
আমিও লিখি মনের খোরাক জোগাতে। কখনো ‘কবি হব’-এমনটা ভাবনায় আনিনি। এই ভাবনাটাই অমূলক মনে হয় আমার কাছে। কবি কোনো পেশা বা অর্থ জোগানের মাধ্যম নয়। আজকের আন্তভাবনার অদল-বদল বলতে এটুকুই বুঝতে পারি।
তবে হ্যাঁ, যে কারণেই লিখি না কেন, সাহিত্য যে চর্চার বিষয়, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। সাহিত্য-পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধিতে আবেগ ও ভাবনার জগতে মগ্নতার বিষয়। সাহিত্যের অভ্যাস-সমষ্টিগত একাগ্রতা ও ঐক্যতার মতো কিছু একটাও, কেননা ভাবনার আদান-প্রদান আমাদেরকে নতুন ও ভিন্ন কিছু শিখতে ও জানতে সাহায্য করে। কবিতা বা গল্প কিংবা উপন্যাস, যা-ই হোক না কেন, সবই সৃষ্টির যন্ত্রণার মতন লেখকের চিন্তায় জেগে থাকে। শুধু কলমে-কাগজে কিংবা কিবোর্ড-মনিটরে উগরে দিলেই সে যন্ত্রণার উপশম সম্ভব। আর সেই উপশমিত যন্ত্রণাই হলো সাহিত্য। সাহিত্য চর্চার বিষয় হলেও এর পেছনের মূল সত্যিটা হলো নিজের চিন্তায় সাহিত্যের অবস্থান। সাহিত্য যদি কারও ভেতর না থাকে, তাহলে চর্চার প্রশ্ন আসবে কোথা থেকে। রফিক আজাদ যেমন বলেছেন, ‘বনকে বিন্যস্ত করে, তবেই উদ্যান।’ উদ্যান হতে হলে আগে তো বন থাকতে হবে। সাহিত্য হলো সেই বিন্যস্ত বন, যাকে উদ্যান বলা হয়।
সাহিত্যে থাকে দর্শন। থাকে মনস্তত্ত্ব। ব্যক্তি, জীবন, জীবনের ঘটনা, পরিস্থিতি, সমাজ-রাষ্ট্রকে অন্তর্দৃষ্টিতে উপলব্ধি করতে হলে দরকার মনস্তত্ত্ব। আর সেগুলোকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে শৈল্পিক রূপ দিতে গিয়ে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণে দরকার দর্শন। কবিতায় নন্দনতত্ত্বের ভূমিকা অপরিসীম, যা দর্শনের একটি শাখা। প্রকৃতির সৃষ্টি, সৌন্দর্য ও শিল্পের শিল্পকে মধুরাদি রস আস্বাদন ও দর্শনের মাধ্যমে বিচার করে। নন্দনতত্ত্ব, দর্শনের নিজস্ব ক্ষেত্র যা নান্দনিকতা থেকে বেরিয়ে আসে এবং এটি নান্দনিক মূল্যবোধ পরীক্ষা করে। নন্দনতত্ত্ব এক সুগভীর চেতনা। অনন্য উপলব্ধি নন্দনতত্ত্বের অন্তরাত্মায় সুন্দরের রূপময় উপস্থিতি দেয়, ভাবের সুগভীর পরিপূর্ণতা দেয়। শিল্প মানবমনের আনন্দিত উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ ঘটায় এবং সেই শিল্পকে সৌন্দর্যের নানান দৃষ্টিকোণ থেকে পরীক্ষা বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার নামই ‘নন্দনতত্ত্ব’। নন্দনতত্ত্বের সেই ‘আনন্দিত উপলব্ধি’কে সৌন্দর্যের সঙ্গে মঙ্গলভাবনা ও মানবীয় গুণগুলোতেই ‘সুন্দরের অভিমুখী’ করে তোলা যায়। কাজেই সাহিত্যের রস আস্বাদনে নন্দনতত্ত্বের ব্যবহার রয়েছে। প্রকৃতির শিল্পকে অ্যারিস্টটল প্রথম যোগ্য করে তোলেন, যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং আধ্যাত্মিক জগতের মধ্যে শূন্যতা পূরণ করে। অ্যারিস্টটলীয় নন্দনতত্ত্ব রচনা, আবেগের হ্রাস এবং নির্বাচনের ধারণাকে দেখায়। একইভাবে কবিতা বা চিত্রকলার যেকোনো পারফরম্যান্সের মধ্যে সংক্ষিপ্ত দৃষ্টিভঙ্গিও টানে। ফরাসি কবি আর্থার রিমবোঁদ ‘কবি’ শব্দের লিখিতভাবে সারাংশ প্রদান করেছেন, ‘একজন কবি দর্শনীয় মাধ্যম হিসেবে নিজেকে লেখায় ফুটিয়ে তোলেন। তিনি একটি দীর্ঘ, সীমাহীন এবং পদ্ধতিবিহীন, অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় সকলের অবতীর্ণ হয়ে কবিতা রচনা করেন। সকল স্তরের ভালোবাসা, দুঃখ-বেদনা, উন্মত্ততা-উন্মাদনার মাঝে নিজেকে খুঁজে পান তিনি।’
প্রকৃতির সৌন্দর্য আমাকেও মুগ্ধ করে নানা উপায়ে। প্রকৃতির সৌন্দর্য অন্বেষণ করি বলেই নিজের প্রতি, অন্যদের প্রতি এবং বিশ্বের প্রতি আমার উপলব্ধি বাড়ে, চারপাশের সঙ্গে গভীর সংযোগ গড়ে তুলতে সুযোগ করে দেয়। প্রকৃতি আমার আত্মদর্শনকে রোজ একটু একটু করে শাণিত করে, আমার সৃজনশীলতাকে উদ্দীপিত করে এবং জীবনকে কেবল সুখের যাত্রা না ভেবে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে ‘সৌন্দর্য, অন্ধকার আর গভীরতা’কে অর্থপূর্ণ করে তোলে। এটাই দর্শন, যা প্রকৃতির মাঝে গভীরভাবে লুকিয়ে থাকে। কবি কেবল সেটা খুঁজে বের করেন উপলব্ধিতে।
প্রকৃতি আর নন্দনতত্ত্ব প্রসঙ্গে কিছু কবির কথা উল্লেখ না করলেই নয়। যেমন উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ! তিনি রোমান্টিক আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, যিনি তাঁর ‘Lines Composed a Few Miles above Tintern Abbey’ কবিতায় প্রকৃতির পুনরুদ্ধারের ক্ষমতা নিয়ে কথা বলেছেন। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংযোগ সম্পর্কে বলেছেন। ওয়ার্ডসওয়ার্থের এই কবিতায় তিনি মানুষের আত্মার ওপর প্রকৃতির পুনরুদ্ধারকারী শক্তি অন্বেষণ করেছেন। প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর সংযোগের অনুভূতি তাকে কীভাবে মানবতার সঙ্গে আরও সংযুক্ত বোধ করতে সাহায্য করেছে, সে কথাই বলেছেন। তিনি মনের অবস্থার সংবেদনকে বৈপরীত্য করেছেন, যখন তিনি তৃণভূমি এবং পর্বতমালার বিপরীতে থাকা দুঃসাহসিক অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে হতাশাজনক এবং অস্থির অবস্থায় থাকেন।
জন কিটস, যিনি সংবেদনশীল এবং প্রাণবন্ত কবিতার জন্য পরিচিত, প্রায়ই বিশ্বের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অন্বেষণ করতেন। তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘Ode to a Nightingale’-এ তিনি প্রকৃতির সৌন্দর্যের অতীন্দ্রিয় এবং নিরবধি গুণের কথা তুলে ধরেছেন। এই কবিতাটি মূলত দুটি ভিন্ন ধরনের সৌন্দর্যের মধ্যে সম্পর্ক অন্বেষণ করে; মানবজাতির দ্বারা নির্মিত শিল্পের জগৎ এবং প্রকৃতির দ্বারা সৃষ্ট সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যময় জীবন।
এমিলি ডিকিনসন কার না প্রিয়! তাঁর রহস্যময় শৈলী, প্রকৃতি এবং প্রকৃতির দ্বৈততা আমাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। ডিকিনসনের ‘A Bird Came Down the Walk’ এর মতো অনেক কবিতায় তিনি প্রাকৃতিক বিশ্বের জটিল বিবরণ এবং পর্যবেক্ষকের ওপর এর প্রভাব ক্যাপচার করেছেন। ‘A Bird Came Down the Walk’ কবিতাটি শুরু হয় যখন তিনি হাঁটতে হাঁটতে একটি পাখি আবিষ্কার করেন। তিনি পাখির দিকে তাকিয়ে আছেন, পাখিটি একটি কীট খুঁজে পায় এবং কীটকে ধরে কামড় দেয় এবং খেয়ে ফেলে। এই কবিতার মূল বিষয়বস্তু হলো প্রকৃতির দ্বৈততা কতটা সুন্দর এবং একই সঙ্গে এটি কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। নান্দনিকতায় তিনি প্রকৃতির সুন্দর এবং অসুন্দর ফুটিয়ে তুলেছেন নিজ শৈলীতে।
পার্সি বিইশ শেলি আরেক রোমান্টিক কবি, যিনি তাঁর ‘To a Skylark’ এর মতো রচনায় প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। মূলত ‘To a Skylark’ এর থিম প্রকৃতি এবং মানুষের আত্মা। স্কাইলার্ক সুখের প্রতীক, যা প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। মানব আত্মা বিশুদ্ধ সুখ অর্জন করতে পারে না কিন্তু স্কাইলার্কের মাধ্যমে এটি অনুভব করতে পারে। শেলি স্কাইলার্ককে তার নিরবচ্ছিন্ন সুখ এবং তার পরিস্থিতি নির্বিশেষে আনন্দের সঙ্গে গান গাওয়ার দক্ষতার জন্য প্রশংসা করেন। তিনি পাখির কাছ থেকে শিখতে চান কীভাবে দুঃখ ও উদ্বেগ থেকে মুক্ত হয়ে এমন নির্মল এবং অবিচ্ছিন্ন সুখ অর্জন করা যায়।
একই সংযোগ আমরা দেখতে পাই রবার্ট ফ্রস্টের কবিতায়। ফ্রস্টের কবিতা প্রায়শই গ্রামীণ জীবন এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যের সঙ্গে তাঁর গভীর সংযোগকে প্রতিফলিত করে। ‘Stopping by Woods on a Snowy Evening’-এ তিনি শীতের দৃশ্যের একটি প্রাণবন্ত ছবি এঁকেছেন, প্রকৃতির শান্ত ও নির্মল সৌন্দর্যের ওপর জোর দিয়েছেন। কবিতাটি একটি শান্ত সন্ধ্যায় তুষারময় বনে সেট করা হয়েছে। ফ্রস্ট জঙ্গলকে সুন্দর, অন্ধকার এবং গভীর হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা তাঁর আত্মদর্শনকে প্রতিফলিত করে। এই কবিতা দ্বারা প্রদত্ত প্রধান বার্তাটি হলো আমাদের চারপাশে দৃশ্যমান এমন কোনো মনোমুগ্ধকর জিনিসের প্রতি আমাদের প্রলুব্ধ হওয়া উচিত নয়, যা আমাদের সময়কে ধরে রেখে দায়িত্বগুলো থেকে বিচ্যুত করে। বরং সময় শেষ হওয়ার আগে বা মৃত্যুর আগে আমাদের সকলের দায়িত্ব-কর্তব্যগুলো পালন করে যাওয়া উচিত। এই কবিতাটি প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং বিস্ময় উপলব্ধি করতে গিয়ে সময়ের বিষয়টা টেনেছে। কবি মাঠের ওপর তুষারপাত দেখে অভিভূত হন এবং উপভোগ করতে থেমে যান। অথচ তাকে এগিয়ে যেতে হবে, কারণ তার দায়িত্ব রয়েছে এবং ঘুমানোর আগে তাকে মাইল পাড়ি দিতে হবে। কবিতাটিতে প্রকৃতির সুন্দর, অন্ধকার এবং গভীরতায় কবি ফোকাস করেছেন। একেই বলে নন্দনতত্ত্ব, যা দর্শনের একটি শাখা।
মেরি অলিভারের কাজ প্রাকৃতিক জগতের জন্য গভীর উপলব্ধি দ্বারা প্রভাবিত। তাঁর ‘Wild Geese’ এর মতো কবিতাগুলোতে তিনি পাঠকদের প্রকৃতির সঙ্গে মেলামেশা করতে এবং এর স্বাচ্ছন্দ্য খোঁজার জন্য অনুরোধ করেন। মানুষ যখন নিজেদের ক্ষুদ্র সংগ্রামের দিকে মনোনিবেশ করে, অলিভার উল্লেখ করেন, প্রাকৃতিক জগৎ অনায়াসে এগিয়ে চলে, যেখানে মুক্তভাবে একঝাঁক গিজ গজিয়ে যায়। কবিতাটি প্রকৃতির মহিমাকে প্রকাশ করে এবং মানুষকে মনে করিয়ে দেয়, সর্বোপরি, তারা বিশাল এবং অর্থবহ কিছুর অংশ। ‘Wild Geese’ দৈনন্দিন জীবনের উত্তেজনা এবং চ্যালেঞ্জগুলোকে দৃষ্টিকোণে রাখতে দেখায়। তিনি লক্ষ করেন, লোকেরা তাদের প্রতিকূলতা একসময় ভালোর দিকে যাবে বলে মনে করেন এবং তিনি এটাও লক্ষ করেন, প্রত্যেকে অনিবার্যভাবে সময়ের সঙ্গে হতাশা বা একাকিত্ব অনুভব করতে পারে। আমরা জীবনের উদ্দেশ্য এবং অর্থ খোঁজার চেষ্টা করি। কিন্তু তবু আমরা নিজেদের সঙ্গে পুরোপুরি সন্তুষ্টি অনুভব করি না, সর্বদা স্থানচ্যুতির অনুভূতি অনুভব করি। তিনি পাঠককে বলেন, আপনি যখন হতাশা অনুভব করেন বা পূর্ণ না হওয়ার অনুভূতি অনুভব করেন, তখন প্রকৃতির দিকে মনোনিবেশ করুন, গিজগুলোতে মনোনিবেশ করুন। এখানেই দর্শন চলে আসে। এমন বহু কবি-লেখক প্রাকৃতিক জগতের বিভিন্ন দিক থেকে পাওয়া সৌন্দর্য, অনুপ্রেরণাকে বাকপটুভাবে তুলে ধরেছেন তাঁদের কবিতায়। যদিও কবিতায় দর্শন অনেকের কাছে স্বীকৃত নয়। কেন নয়, এর উত্তর হতে পারে, তারা দর্শন এড়িয়ে যেতে চান। অবশ্য কবিতায় দর্শন থাকতেই হবে, তা-ও নয়। তবে থাকলে সে কবিতা হয়ে ওঠে আরও অর্থবহ। কবিতায় যখন থাকে মানুষের অভিজ্ঞতা, অস্তিত্ব ও জীবনের রহস্য, চেতনা, নৈতিকতা এবং বাস্তবতার প্রকৃতি সম্পর্কে মৌলিক প্রশ্ন, তখন অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি ও অন্তর্দৃষ্টিতে সেগুলোকে অন্বেষণ করতেই দর্শনের দরকার হয়। তা ছাড়া কবিতা আত্মদর্শন, বিমূর্ত ধারণা এবং আবেগ নিয়ে কাজ করে, আর দর্শন এই ধারণাগুলোকে আরও সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে কবিতায় প্রকাশ করতে ভাষা এবং ধারণা দেয়।
পড়াশোনা আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করে নিঃসন্দেহে। সাহিত্যচর্চা মানেই পড়া, উপলব্ধি করা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা। সে অর্থে পড়তে হয়। কবির কবিতায় থাকে দর্শন, নন্দনতত্ত্ব, থাকে সায়েন্স, মনস্তত্ত্বÑপড়াশোনা না করলে সেসব বোঝা মুশকিল। কেবল কবি হওয়ার জন্য নয়, বরং নিজের ভাবনা ও আবেগকে সঠিক উপায়ে প্রকাশ করার জন্য এসবই আমাদের চর্চায় রাখতে হয়।
যদি লুইপা প্রসঙ্গ টানি, যিনি ছিলেন একজন প্রবীণ বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য ও চর্যাপদের কবি, উনি যা আবিষ্কার বা সৃষ্টি করে গেছেন, পৃথিবী কি আজকের দিনটা পর্যন্ত সেখানেই আটকে আছে? না, নেই। লুইপা থেকে আজকের এইচ বি রিতা পর্যন্ত ধারাবাহিক পাঠ এ জন্য প্রয়োজন, সাহিত্যের বিভিন্ন রচনা, অধ্যায় পড়ার মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন শৈলী, বিষয় এবং ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটাতে পারি। প্রতিটা ব্যক্তি তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, অভিজ্ঞতা, উপলব্ধিতে ভাব, ভাবনা, শব্দভান্ডার, বাক্যাংশ সাহিত্যিক ডিভাইসে বিস্তৃত পরিসরে উন্মোচন করেন। এই প্রকাশ আমাদেরকে মানব অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বোঝার জ্ঞানকে প্রসারিত করে, নিজেদের কাজে নতুন ধারণা এবং কৌশল অন্বেষণ করতে সুযোগ দেয়। কাজেই অন্য কবিদের রচনা পড়াও সাহিত্যচর্চার একটি অংশ, যা আমাদেরকে লেখার বিভিন্ন পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করতে, বিভিন্ন ফর্ম তৈরি করতে এবং শৈলী নিয়ে ভাবতে সাহায্য করে। সেই সঙ্গে আমাদের নিজস্ব লেখায় তাদের সঙ্গে অনুরণিত উপাদানগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে দেয়। অতীত ও সমসাময়িক কবিদের রচনা পড়ে একজন কবি এই ঐতিহ্যের অংশ হয়ে ওঠেন। যা-ই হোক, কবিতার যাত্রার শুরু থেকেই আবেগ, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির ভূ-প্রকৃতিতে গভীর বিবর্তন ঘটেছে। শুরুতে হয়তো আমার কবিতাগুলো বিশুদ্ধতা এবং নির্বোধতায় ঠাসা ছিল, যা বিশ্ব সম্পর্কে কম পরিশীলিত উপলব্ধি এবং এর জটিলতার প্রতিনিধিত্ব করে। তবে যাত্রার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতার সূক্ষ্মতাগুলোর প্রতি ধীরে ধীরে জাগ্রত হয়েছে প্রেম, বিরহ, ক্ষতি, দ্রোহ, আকাক্সক্ষা, যা স্থিতিস্থাপকতার মতো অনুভূতিগুলোর গভীর অনুসন্ধানের পথ তৈরি করে। লেখালেখির দীর্ঘ যাত্রাজুড়ে আত্মদর্শন, আত্মসচেতনতা এবং বিকাশের সময়কালের সঙ্গে সঙ্গে আমার অভ্যন্তরীণ চিন্তাধারায় পরিবর্তন হয়েছে। যখন আমি অস্তিত্বের সমস্যা নিয়ে লড়াই করছি এবং অস্তিত্বের বুননে অর্থের সন্ধান করছি, তখন আমার লেখায় নিজ পরিচয়, উদ্দেশ্য এবং স্বত্বের থিমগুলো কিন্তু উদ্ভূত হয়ে যাচ্ছে; যা আমরা অতীতের বহু বিখ্যাত কবির লেখায়ও খুঁজে পাই। এখানে ব্যক্তিগত বৃদ্ধির পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তৃতিও হতে পারে। কারণ একজন কবি মানুষের দুঃখ, আনন্দ এবং আন্তসম্পর্কের বিস্তৃত বর্ণালিতে আবদ্ধ হোন। এই অভ্যন্তরীণ রূপান্তরগুলো যেকোনো কবির লেখার জগতে একটি অদম্য চিহ্ন রেখে যায়, ভাবনার গভীরতা, সত্যতা এবং আবেগের অনুরণন করে। প্রতিটি কবিতা কবির বিকশিত চেতনার একটি স্ন্যাপশট বলা যায়, যা জীবনযাত্রার জোয়ার-ভাটা ও প্রবাহকে তার সমস্ত সৌন্দর্য এবং জটিলতায় ধারণ করে।