‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’- এই স্লোগান ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটারদের মন জয় করে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি সোমবার ক্ষমতা গ্রহণ করবেন তিনি। কিন্তু ক্ষমতার মসনদে বসার আগেই নথিপত্রহীন অভিবাসীদের ঘুম কেড়ে নিয়েছেন তিনি। ঘোষণা দিয়েছেন- নথিপত্রহীন অভিবাসী তাড়াতে তিনি সেনাবাহিনী ব্যবহার করবেন। আরো কঠোর ভাষায় বলতে গেলে - তাদের ওপর ক্র্যাকডাউন বা ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারেন রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ট্রাম্পের এই ঘোষণার পর ধরপাকড় এড়াতে নথিপত্রহীন অভিবাসীরা আগেভাগে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছেন। নিউইয়র্ক সিটি এখনো নথিপত্রহীন অভিবাসীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসাবে বিবেচিত। কিন্তু ট্রাম্পের সঙ্গে সিটি মেয়র এরিক অ্যাডামসের যে সখ্যতা, তাতে অদূর ভবিষ্যতে সেই নিরাপদ আশ্রয়স্থলও হাতছাড়া হতে পারে। ফলে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন নথিপত্রহীন অগণিত অভিবাসীরা।
এদিকে শপথের পর সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অবৈধ অভিবাসীদের বিতাড়িত করার পরিকল্পনার কথা নিশ্চিত করেছেন ট্রাম্প। ১৮ নভেম্বর সোমবার এ পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে জাতীয় জরুরি পরিস্থিতি জারি করবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বতর্মান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বর্তমান শাসনামলে মেক্সিকোর সীমান্ত পেরিয়ে রেকর্ডসংখ্যক অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছে। এ নিয়ে অনেক আগে থেকে চটে ছিলেন ট্রাম্প। সীমান্ত পেরোনো ঠেকাতে নিজের প্রথম মেয়াদে মেক্সিকো সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণের কাজও শুরু করেছিলেন। এবারের নির্বাচনে তাঁর অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল, যুক্তরাষ্ট্রকে অবৈধ অভিবাসীমুক্ত করা।
ট্রাম্পের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে রক্ষণশীল একজন অধিকারকর্মী লিখেছিলেন, অবৈধ অভিবাসীদের বিতাড়িত করার প্রকল্পে বাইডেন হস্তক্ষেপ করেছিলেন। তা আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে ‘জাতীয় জরুরি পরিস্থিতি জারি ও সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহারের’ প্রস্তুতি নিয়েছেন ট্রাম্প। পরে ওই পোস্ট শেয়ার করে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘সত্যি’।
৫ নভেম্বর মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে বড় ব্যবধানে পরাজিত করেন ট্রাম্প। আগামী ২০ জানুয়ারি সোমবার হোয়াইট হাউসে ফের প্রত্যাবর্তনের আগেই নিজের প্রশাসন গোছানোয় মন দিয়েছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছেন অভিবাসন বিষয়ে কট্টরপন্থী হিসেবে পরিচিত টম হোম্যানকে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ অবৈধভাবে বসবাস করছেন। ট্রাম্প যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী নথিপত্রহীন অভিবাসীদের তাড়ানো শুরু করেন, তাহলে তা সরাসরি প্রায় ২ কোটি পরিবারের ওপর প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অতিসম্প্রতি নিউইয়র্কে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের একটি সমাবেশে ট্রাম্প বলেন, ‘আমার দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিন থেকেই আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিতাড়ন কর্মসূচি চালু করবো। আমরা অপরাধীদের জেলখানায় পাঠাব এবং যত দ্রুত সম্ভব আমাদের দেশ থেকে বের করে দেব।
ট্রাম্প ইতোমধ্যে তাঁর প্রশাসনে অভিবাসন ইস্যুতে কঠোর অবস্থানের ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়েছেন। সাউথ ডাকোটার গভর্নর ক্রিস্টি নোয়েমকে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সেক্রেটারি পদে মনোনীত করা হয়েছে, যা সিনেটের অনুমোদনের অপেক্ষায়।
সাবেক অ্যাক্টিং ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই) পরিচালক টম হোম্যানকে ‘বর্ডার জার’ পদে নিযুক্ত করা হয়েছে। কীভাবে বাস্তবায়ন হবে বিতাড়ন? টম হোম্যান গণবিতাড়নের ক্ষেত্রে প্রথমে অপরাধী ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ অভিবাসীদের ওপর জোর দেবেন বলে জানিয়েছেন। তবে পুরো পরিবারকেও একসঙ্গে বিতাড়ন করা হতে পারে বলে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন।
ট্রাম্প তাঁর প্রচারণার সময় ন্যাশনাল গার্ডকে এই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর জন্য একটি মৌলিক পরিবর্তন আনবে, কারণ সাধারণত তারা দেশের অভ্যন্তরীণ আইন প্রয়োগের সঙ্গে জড়িত থাকে না। তিনি আরও প্রস্তাব করেছিলেন যে, মেক্সিকো সীমান্তে হাজার হাজার বিদেশি সেনা মোতায়েন করা হতে পারে। বিতাড়নের ব্যয় ও প্রভাব বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আনুমানিক ১ কোটি ১০ লাখ অভিবাসী বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই বসবাস করছেন। এই বিতাড়ন কার্যক্রমে প্রতি বছর বিলিয়ন ডলার ব্যয় হতে পারে বলে আমেরিকান ইমিগ্রেশন কাউন্সিল ধারণা দিয়েছে।
এছাড়া, বিতাড়ন কর্মসূচি অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। এতে করে রাজস্ব কমে যাওয়ার পাশাপাশি শ্রমবাজারে সংকট সৃষ্টি হতে পারে। ক্যালিফোর্নিয়ায় কৃষি খাতের ওপর এই পরিকল্পনার সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে সম্প্রতি এ বিষয়ক প্রতিবেদন করেছেন এবিসি নিউজের মার্থা র্যাডাটজ। ম্যানুয়েল কুনহা জুনিয়র, প্রেসিডেন্ট অফ দ্য নিসেই ফার্মার্স লিগ, বলেন, ‘যদি আমার শ্রমিকশ্রেণিকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তবে খাবার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। দেশের খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ধসে পড়বে এবং কার্যত পুরো দেশ স্থবির হয়ে যাবে।’ ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নীতিতে একটি বড় পরিবর্তন আনতে পারে, যার প্রভাব দেশের অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থায় গভীরভাবে অনুভূত হবে।
বিশেষজ্ঞ এবং আইনজীবীরা বলছেন, ট্রাম্প যে মাত্রায় ইমিগ্রেশন ক্র্যাকডাউনের রূপরেখা দিয়েছেন তা আইনি এবং লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ বাড়াবে। কিন্তু এসব পাত্তা দিচ্ছেন না ট্রাম্প। তিনি স্টেট ন্যাশনাল গার্ড কর্মীদের ফেডারেলাইজ করার এবং অভিবাসন প্রয়োগের জন্য তাদের মোতায়েন করার পরিকল্পনা বর্ণনা করেছেন, যার মধ্যে অংশ নিতে অস্বীকারকারী গভর্নরদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ রিপাবলিকান শাসিত রাজ্যগুলি থেকে প্রতিবেশী রাজ্যগুলিতে সৈন্য পাঠানোর বিষয় অন্তর্ভুক্ত করছেন। এমনকী নথিপত্রহীন অভিবাসীদের আটক রাখতে তাঁবু নির্মাণের পক্ষেও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
নির্বাচন-পরবর্তী তার প্রথম সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প এনবিসি নিউজকে বলেছিলেন- নথিপত্রহীন অভিবাসীদের বিতাড়ন করা ছাড়া তার কোনো বিকল্প পথ খোলা নেই। ট্রাম্প বিভিন্ন সময়ে দাবি করেছেন যে তিনি কমপক্ষে ১৫ মিলিয়ন, এমনকি ২০ মিলিয়নেরও বেশি নথিপত্রহীন অভিবাসীকে বিতাড়ন করবেন।
নিউইয়র্কে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নথিপত্রহীন অভিবাসী রয়েছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে কয়েক মিলিয়ন নথিপত্রহীন অভিবাসী রয়েছেন। ট্রাম্পের এই ঘোষণা তাদের সবার জন্য কী আতঙ্কের? - এ প্রতিবেদক এই প্রশ্ন করেছিলেন ইমিগ্রেশন ও অ্যাক্সিডেন্ট বিশেষজ্ঞ অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরীকে। উত্তরে তিনি বলেন, শুধু ট্রাম্প নয়, নথিপত্রহীন অভিবাসীদের মধ্যে যারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত এবং দেশ ত্যাগে (ডিপোর্টেশন) আদালতের আদেশ রয়েছে, তাদের জন্য ওবামা প্রশাসনও কঠোর ছিল। সেই আইন বাইডেন প্রশাসনেও বিদ্যমান। অর্থাৎ এ ধরণের নথিপত্রহীন অভিবাসীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো সরকার আতঙ্কের কারণ। তবে যারা কখনো অপরাধ করেননি তারা গ্রেপ্তার হলে আদালতের কাছে আশ্রয় চাইতে পারেন।
ভবিষ্যতে গ্রিনকার্ডধারীদের কোনো সমস্যা হবে কীনা জানতে চাইলে অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরী বলেন, গ্রিনকার্ডধারীদের টাচ করতে পারবে না সরকার। তবে কেউ অব্যাহত অপরাধ সংঘটিত করলে তিনি গ্রিনকার্ড কীভাবে অর্জন করেছেন তা বিদ্যমান আইনে তদন্ত হতে পারে। এমনকী যারা নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন তাদের বেলায় সেটি প্রযোজ্য হতে পারে।
অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরীর বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর ট্রাম্পের প্রথম টার্গেট হবে নথিপত্রহীন অভিবাসীরা। অপরাধের সঙ্গে যুক্ত এবং আদালতের নির্দেশে বিতাড়নের আদেশপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই তার চার বছরের শাসনামল শেষ হয়ে যাবে।
তার মতে, যারা অপরাধ করবেন না তাদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। অতএব, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে কোনো প্রকার অপরাধের সঙ্গে জড়িত না হওয়ার পরামর্শ দেন এই অভিজ্ঞ ইমিগ্রেশন অ্যাটর্নি।