Thikana News
২১ নভেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

যেভাবে সাজানো হচ্ছে ট্রাম্পের নতুন মন্ত্রিসভা ও পররাষ্ট্রনীতি

যেভাবে সাজানো হচ্ছে ট্রাম্পের নতুন মন্ত্রিসভা ও পররাষ্ট্রনীতি
ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে ফক্স নিউজের হোস্ট ও সাবেক সেনাসদস্য পিট হেগসেথকে মনোনীত করার পরই বর্তমান ও প্রাক্তন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা তাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করেন। এক জন কমান্ডার বলেন, 'এটা একট হাস্যকর সিদ্ধান্ত,' আরেক জন বলেন, 'এট রীতিমতো দুঃস্বপ্ন'। স্পষ্টভাবে তারা কোনো পক্ষপাতমূলক মন্তব্য করেননি; বরং তারা এমন কমান্ডার যারা ট্রাম্প ও বহিডেন উভয়ের অধীনে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তাদের সমালোচনা ব্যক্তিগত নয়, হেগসেথ সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু বলেননি তারা। তাদের মূল উদ্বেগ হলো ট্রাম্প এই নিয়োগ এবং অন্যান্য জাতীয় নিরাপত্তা পদে এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ করছেন, যাদের লক্ষ্য হচ্ছে, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের এবং স্থায়ী পরিবর্তন আনা।

একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল আমাকে বলেছিলেন, 'প্টোগন পরিচালনা বা জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত প্রক্রিয়া চালানোর কাজে গুরুতর কোনো অভিজ্ঞতা লাগে না, তবে আমি আশা করছি নতুন নেতৃত্ব হয়তো এমন কিছু সমস্যার সমাধান করতে পারে, যেগুলো দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে। এখানে যে সাধারণ বৈশিষ্ট্যটা দেখা যাচ্ছে তাহলো অনুগত্য। এক্ষেত্রে আনুগত্য প্রয়োজন, তবে অন্ধ আনুগত্য বিপজ্জনক। এ পর্যন্ত যতগুলে ঘোষণা এসেছে, তাতে মনে হচ্ছে আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে চলে যেতে পারি, যেখানে এক জনের সিদ্ধান্ত অসংখ্য হাত নিয়ন্ত্রণ করছে। আর আমি বিশ্বাস করি, এক জন ব্যক্তি ভিন্নমতের সমাবেশ ঘটিয়ে একটা কাজ যত ভালোভাবে করতে পারে, এককভাবে কখনোই তেমন করতে পারবে না।'

২০২৪ সালের নির্বাচন, যেটা আগের নির্বাচনের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। এমনকি বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকেও প্রভাবিত করতে পারে। ট্রাম্প বহুবার বলেছেন যে, তিনি 'আমেরিকা ফার্স্ট এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চান, যার অর্থ হলো ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশি সম্পৃক্ততা হ্রাস করতে চান। ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে যে চুক্তিগুলো আমেরিকার স্বার্থের বিরুদ্ধে যাচ্ছে বলে মনে করেন সেগুলো পুনর্গঠন করা হতে পারে, যা দীর্ঘদিনের দ্বিদলীয় দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ বিপরীত।

ইউক্রেনের জন্য নতুন উদ্বেগ জন্য নতুন এই দৃষ্টিভঙ্গি নিকট ভবিষ্যতে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির জন্য কী অর্থ বহন করবে? ট্রাম্পের প্রাক্তন শীর্ষ উপদেষ্টারা আমাকে আমার সাম্প্রতিক বই, 'দ্য রিটার্ন অব গ্রেট পাওয়ার'-এ বলেছেন, এই প্রতিষ্ঠিত দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ট্রাম্প ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা বন্ধ করে দিতে পারেন।

ট্রাম্পের প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন আমাকে বলেছিলেন, 'আমি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হলে খুবই চিন্তিত থাকতাম। কারণ যদি সবকিছু চুত্তির মাধ্যমে হয়, তবে শান্তি আনতে ইউক্রেনের আরো ১০ শতাংশ ভূখণ্ড রাশিয়াকে দিয়ে দিতে তিনি আপত্তি করবেন না।'

তারা বলেছিলেন, তাইওয়ানেরও একই উদ্বেগ থাকা উচিত। বাইডেন একাধিক বার তাইওয়ানকে চীনা আক্রমণ থেকে সামরিকভাবে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যা স্বশাসিত দ্বীপটির প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের কৌশলগত অনির্দিষ্ট অবহেলার অবসান ঘটায়। কিন্তু ট্রাম্পের প্রাত্তন শীর্ষ উপদেষ্টাদের কেউই বিশ্বাস করেন না যে ট্রাম্প বাইডেনের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন।

একইভাবে মার্কিন প্রতিরক্ষা চুক্তিও আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন উপদেষ্টা বলেছেন, ট্রাম্প ন্যাংটো থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন (যেমন তারা তার প্রথম মেয়াদে ক্ষণিকের জন্য এ ধরনের প্রচেষ্টা প্রত্যক্ষ করেছিলেন) অথবা কংগ্রেস দ্বারা পাশ করা নতুন আইন, যেট এমন একতরফা প্রত্যাহার কঠিন করলেও কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে ট্রাম্প ন্যাটোর আর্টিকেল ৫ অনুযায়ী অন্যান্য সদস্যদের সামরিকভাবে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি মেনে চলবেন না। ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প বক্তব্য দিয়েছিলেন, ন্যাটোতে যে দেশগুলো কম টাকা দেয়, সে দেশগুলোকে রাশিয়া যাই করুক না কেন, সেসব নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা থাকবে না। নির্বাচনের আগেই বোল্টন আমাকে বলেছিলেন, 'আমার মনে হয় ন্যাটে সত্যিকারের বিপদের সম্মুখীন হবে। কারণ ট্রাম্প সুযোগ পেলেই ন্যাটো থেকে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন।'

এটা বিশ্বজুড়ে অন্যান্য মার্কিন মিত্র দেশের জন্যও ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে, যার মধ্যে এশিয়ার দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের সাথে করা চুক্তিও রয়েছে। প্রথম মেয়াদে, ট্রাম্প কিম জং উনের মন রক্ষা করতে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বড় ধরনের সামরিক মহুড়া স্থগিত করেছিলেন, যেটা সিউল সামরিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখে। অক্টোবর মাসে, ট্রাম্প কোরীয় উপদ্বীপে
যুক্তরাষ্ট্রের চলমান সামরিক উপস্থিতিকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ১০ বিলিয়ন ডলার লোকসান বলে মন্তব্য করেছিলেন।

একটি নতুন পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা?
ইউরোপ ও এশিয়ার সামরিক কমান্ডার ও কূটনীতিকরা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নিলে সবাইকেই বিপজ্জনক পরিণাম ভোগ করতে হতে পারে। নিরাপত্তার অভাবে এশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলো নিজেদের পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে পারে। এ ধরনের পদক্ষেপ মার্কিন প্রতিপক্ষ রাশিয়া ও চীন (উত্তর কোরিয়া এবং যদি ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করে) তাদের নিজস্ব অস্ত্রাগার সম্প্রসারণ করতে উদ্বুদ্ধ করবে। অন্য অঞ্চলের দেশও যেমন-সৌদি আরব, মিশর, ভারতও একই কাজ করতে পারে। এবং এভাবে ট্রাম্প, যিনি প্রায়ই পারমাণবিক যুদ্ধের প্রতি তার গভীর ও যথেষ্ট শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবে একটি নতুন পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার সূচনা করতে পারেন।

যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা
দীর্ঘদিন ধরে চলা ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধে মার্কিন জনগণের সমর্থন অনেকটাই কমে গেছে। ইউক্রেনে সামরিক সহায়তার খরচ যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক প্রতিরক্ষা বাজেটের একটি ছোট অংশ হলেও অনেকের কাছে ইউক্রেনকে দেওয়া এ তহবিল চলমান গৃহস্থালি ব্যয় সংকটের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। তবে মার্কিন জনগণকে হয়তো বিশ্বব্যাপী একদল নতুন শক্তিশালী স্বৈরশাসকদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সমঝোতা করতে হতে পরে। অবশ্য পরবর্তী সময়ে এজন্য মূল্যও দেওয়া লাগবে। জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেন যে, শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক নিয়মাবলি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের এমন কিছু সুবিধা দেয়, যেগুলো মার্কিন জনগণ আপাতদৃষ্টিতে বুঝতে পারে না। যেমন-সার্বভৌম দেশের সীমানা রক্ষা, এশিয়া ও ইউরোপের স্বাধীন জাহাজ চলাচলের পথ, আন্তর্জাতিক বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বিক্রি, বৈশ্বিক বিমান চলাচল এবং বিদেশে পড়াশোনার সুযোগ। এগুলো এমন ধরনের সুবিধা, যা অতিরিক্ত প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকবে। 

সাবেক জয়েন্ট চিফস চেয়ারম্যান মার্ক মিলি আমাকে বলেন, 'এই ধরনের ব্যবস্থা আমাদের অনেক বড় বড় যুদ্ধ থেকে রক্ষা করেছে।' তিনি বলেন, 'এটা একমাত্র কারণ না হলেও অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম যে, গত আট দশকে বিশ্বে বড় ধরনের যুদ্ধ হয়নি। যদি এই ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে যায়, তাহলে প্রতিরক্ষা বাজেট দ্বিগুণ হয়ে যাবে এবং পৃথিবী আবার প্রাচীন যুগের মতো প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে ফিরে যাবে, যেখানে একমাত্র নিয়ম ছিল 'শক্তিমানরা যা ইচ্ছা তাই করবে, আর দুর্বলরা তাদের কপালে যা আছে তাই ভোগ করবে।'

পূর্বে দ্বিপাক্ষিক নীতিগুলো সব সময় নিখুঁত ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইউক্রেনে সম্পূর্ণ সফলতার পথে এখনো পৌঁছাতে পারেনি এবং তারা হয়তো যুদ্ধ শেষ করার জন্য ইউক্রেনকে কিছুটা ভূখণ্ড ছাড় দেওয়ার পরামর্শও দিয়েছিল। এটি এত দিন গোপন ছিল, কিন্তু এখন প্রকাশ্যে চলে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা এখন নিজেদের প্রস্তুত করছে এবং ইউরোপের অনেক কূটনীতিক আগে থেকেই এমন পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু না হলেও তারা আশা করছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের প্রভাব হ্রাস পাবে এবং এর ফলে তাদের বৃহৎ সামরিক ব্যয়ের দিকে

এশিয়াতেও দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে মার্কিন চুক্তি এখন আর চীনের বিরুছে তেমন শক্ত প্রতিরোধ তৈরি করতে পারবে না। ট্রাম্পের অধীনে সবকিছুই অশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে। যদিও তার প্রথম মেয়াদে কিম জং উনের সঙ্গে তিনি আলোচনা ছেড়ে চলে যান যখন কিম তার আশা অনুযায়ী সমঝোতা করতে হননি। কিন্তু এখান দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্পের কছে সবকিছুই সমঝোতা করে সমাধানের উপযোগী।

আমি যখন আমার বই নিয়ে আলোচনা করি, তখন শ্রোতাদের মনে করিয়ে দেই যে, আমর' দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য নিজেদের অনেক শ্রদ্ধা করি। গত আট দশক ধরে, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত নীতি ছিল। এটি শুধু আমেরিকান মূল্যবোধের অংশ নয়, বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থরক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
লেখক: জিম সিওটো, সিএনএনের প্রধান নিরাপত্তা বিশ্লেষক; সংগৃহীত।

ঠিকানা/এসআর

কমেন্ট বক্স