সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের নথি নেই- গণমাধ্যমে এমন মন্তব্য করে যন্ত্রণা আমন্ত্রণ করে এনেছেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন। এ যন্ত্রণা আবার তাকেই পোহাতে হচ্ছে। অংশী বা শরিক হওয়ার মতো কেউ নেই। তিনি কোনো উদ্দেশ্য-বিধেয় ছাড়া এমন মন্তব্য করেছেন, তা মনে করার অবস্থা নেই। এই রাষ্ট্রপতি কম চতুর নন। তার নিয়োগকর্তা শেখ হাসিনা সেয়ানের ওপর সেয়ান। সব বুঝেই চুপ্পু ডাকনামের এই ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি করেছেন। হিসাবের বাইরে একচুলও কিছু করা হয়নি। এখানে হিসাবে সবাই পাকা। তাদের আশীর্বাদক প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের হিসাব আরও পাকা। নানা ঘটনার অনিবার্যতায় তখন কারও চাতুরী-সেয়ানামি কাজে লাগেনি। শেখ হাসিনাকে ঘিরে ভারতের দাবার গুটি এখন আরও ঘূর্ণমান। ভারত শিশুতোষ রাজনীতিকদের দেশ নয়। নতুন তরতাজা ঘোড়া না খুঁজেই রেসের বাতিল ঘোড়ার ওপর বাজি ধরার গ্যাম্বলিং তারা করে না। এর পরও রেসের বাতিল ঘোড়াকে আস্তাবলে সাজিয়ে রাখার পেছনে মিশন-ভিশন দুটোই আছে। এর মাঝে এক ফোঁটা ছিটিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন উপ-রাষ্ট্রদূত জন ডেনিলোভিজ। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রসহ রাজনৈতিক দলের সংস্কার প্রয়োজন। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত কেবল দলটির বর্তমান নেতৃত্বের হাতকে শক্তিশালী করবে এবং অভ্যন্তরীণ সংস্কার প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করবে।’
আওয়ামী লীগে শেখ পরিবারের বাইরে নতুন নেতৃত্বের উত্থান ঘটতে পারে এবং হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য ছুড়েছেন তিনি। এক্স বার্তায় তিনি আরও লিখেছেন, ‘জুলাই ও আগস্টে সংঘটিত অপরাধসহ অতীতের অপরাধের জন্য ব্যক্তিদের জবাবদিহি করতে হবে। স্বৈরাচারের শিকারদের ন্যায়বিচার অবশ্যই প্রাপ্য। দেশকে অবশ্যই তাদের ত্যাগকে স্বীকার করতে হবে, যারা চূড়ান্ত মূল্য দিয়েছিলেন। জনগণের প্রয়োজন স্বাধীনভাবে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ।’
শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি- এই দাবি তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় আরও আগেই করে রেখেছেন। এখন বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমে দাবি করার মাঝে রাষ্ট্রপতি চুপ্পু সেটি নিশ্চিত করেছেন। এখন আবার শেখ হাসিনার প্রবাসী সরকার গঠনের চেষ্টার কথা বেশ চাউর। এর মধ্যে গভীর রাতে এবং কোর্ট আঙিনায় ফ্যাসিবাদ সমর্থকদের মিছিল-মিটিংয়ের খবর সামাজিক গণমাধ্যমে ছড়ানো হচ্ছে। যার মাঝে দেশে আরেকটি অরাজক পরিস্থিতি তৈরির নমুনা স্পষ্ট। এর বিপরীতে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার তোড়জোড়ও ব্যাপক। এরই মধ্যে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আরও ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ১৮ নভেম্বরের মধ্যে তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজিরের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ৩৯ বছর পর যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল, আইনজীবী প্যানেল এবং তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়। যেই ট্রাইব্যুনালের রায় কার্যকর করে অনেককেই ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।
৩৯ বছরের পুরোনো ঘটনা নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ পরিচালনার সময় সাক্ষ্য-প্রমাণের অপ্রতুলতার কারণে বিচারকাজ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। অপরদিকে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মাত্র দুই মাস পর বিচারকাজ পরিচালনার সময় তথ্য, উপাত্ত, আলামত, সাক্ষ্য-প্রমাণের কোনো অভাব দেখছে না এখনকার রাষ্ট্রপক্ষ। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পলায়নের পর চরম সংকটে পড়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। ‘পতন ও সংকটের ধরন ভিন্ন’ হলেও এবারের সংকট দলটিকে পঁচাত্তরের মতো ‘ছন্নছাড়া’ অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। আবার দলটি ভুল স্বীকার বা সংশোধনের বার্তাও দিচ্ছে না। উপরন্তু তারা সব ঠিক করেছে বলেই দাবি করছে।
ফ্যাসিস্ট যেমন নিজের পতন কখন হবে তা বুঝতে পারে না, ঠিক তেমনি ফ্যাসিস্টের অনুসারীরাও নিজেদের পতন সম্পর্কে আগেভাগে বুঝতে পারে না। ফ্যাসিস্ট কখনো পদত্যাগ করে না, হয় সে আত্মহত্যা করে, নিহত হয় অথবা পালায়। ফ্যাসিবাদের জন্মদাতা বেনিটো মুসোলিনি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিনগুলোর একসময়ে অর্থাৎ এপ্রিল ২৮, ১৯৪৫-এ উত্তর ইতালির গিউলিনো ডি মেজেগ্রা গ্রামে একটি ইতালীয় সংক্ষিপ্ত আদালতের রায় অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হন। এর দুই দিন পর নাৎসি জার্মানির ফ্যাসিস্ট বার্লিনের ফুহরেরবাঙ্কারে রিভলবারের গুলিতে আত্মহত্যা করেন।
শেখ হাসিনা পালিয়েছেন, তবে তা এড়িয়ে বলা হচ্ছে, তিনি পদত্যাগ করেননি। তিনি সফরে গেছেন, তাও বলছেন না। ছড়ানো হচ্ছে সাইডলাইনের পুরোনো কথা নতুন করে, যার রিহার্সাল করেছেন রাষ্ট্রপতিও। আবার অবস্থা বেগতিক দেখে কথা ঘুরিয়ে ফেলেছেন। তিনি এমন কথা বলেছেন বা বলেননি, তা স্পষ্ট না করে বলছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগকেন্দ্রিক মীমাংসিত বিষয়ে নতুন করে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি না করতে। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণের দাবিতে বঙ্গভবন ঘেরাও হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহর ভাষায় : সন্ত্রাসী ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ও ফ্যাসিবাদের দোসর রাষ্ট্রপতি চুপ্পুর পদত্যাগের দাবিতে ছাত্র-জনতার গণজমায়েত।’২২ অক্টোবর মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে বঙ্গভবনের সামনে অবস্থানকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সারজিস আলম গণমাধ্যমকে জানান, আগামী দুই দিনের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি চূড়ান্ত করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি- জাতির উদ্দেশে এমন ভাষণের পর রাষ্ট্রপতি এখন কেন ‘নথি’ নেই মন্তব্য করে কাউর বাধাচ্ছেন, তা তারা একটু বেশি করেই জানেন। যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন এর আগে গণভবন চেনা মাহফুজ, আখতার, নাহিদ, আসিফ, নুসরাত, আকরাম, আরিফ, জাহিদ, তুষার, উমামা, হাসনাত, সারজিস, নাজিফা, আবু বকর, তরিকুল, সানজানারা। তাদের চোখ এখন বঙ্গভবনের দিকে, যাদের পয়দা করতে একটি জনগোষ্ঠীর দশকের পর দশক লেগেছে।