যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ড. ইউনূসের কথাবার্তা চূড়ান্ত ছিল আগেই। সেই দৃষ্টে ক্ষমতা গ্রহণও হয়। ক্ষমতা নেওয়ার পর কী হবে বা হতে পারে, দিয়ে রাখা হয়েছিল সেই ধারণাপত্রও। তা এখন অক্ষরে অক্ষরে ফলছে। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি, তিনি এখনো বাংলাদেশের বৈধ প্রধানমন্ত্রী, যেকোনো সময় চট করে চলে আসবেন- এ ধাঁচের অস্বাভাবিক কথামালাকে স্বাভাবিকভাবে নেওয়ার তাগিদ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। সামনে এ ধরনের কথা ও কিছু উল্টাপাল্টা কাজ হবে, সেই প্রস্তুতিও রাখতে বলা হয়েছে। সবশেষে মার্কিন ম্যাসেজে ইউনূসের ধীরগতি আরও যা বলার ড. ইউনূসকে বলে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা। একদম উত্তেজিত হতে বারণ করে যাওয়া হয়েছে। ক্ষমতাপাগল বিএনপি কথা রাখবে না, নতুন কথা বলবে-সেই বার্তাও দেওয়া হয়েছে। তা-ও ফলতে শুরু করেছে।
আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন- এ কথায় এখন অটল নেই বিএনপি। এত দিন দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সংস্কারের জন্য যত সময় দরকার তত অপেক্ষা করবে দলটি। এখন বলছে অন্য কথা। দুই মাসের মধ্যেই সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দেওয়া সম্ভবই কেবল বলেনি; আরও কিছু কথা যোগ করে বলা হয়েছে, সংস্কার করবে নির্বাচিত সরকার। তাদের কথার মাঝে এই বিস্তর ফারাকের ফের বোঝা কঠিন হয়ে পড়েছে আরও কিছু কারণে। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিএনপির মনোজাগতিক বিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শেখ হাসিনার পতন আন্দোলনে বিএনপির অবদানকে যেন খাটো করে দেখা না হয়, সেই আহ্বানও জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আহ্বানটি প্রধানত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের প্রতি। আর এখন পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের মূল অভিভাবক ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।
শিক্ষার্থীদের মনঃকষ্টের অন্যতম কারণ সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনে সংস্কারের নামে বিএনপির পছন্দের রদবদলের ব্যাপকতা। দীর্ঘদিনের বঞ্চিতরা পদ-পদায়নে বেশি সুবিধা পাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বঞ্চিত ট্যাগ লাগিয়ে পুলিশ এবং প্রশাসনের সুবিধাভোগী তথা আওয়ামী লীগের একান্ত সহযোগী তথা শেখ হাসিনাকে টানা সময় টিকিয়ে রাখার ভূমিকা পালনকারী কিছু ব্যক্তিও পদ-পদায়ন হাসিল করে নিচ্ছেন। যাদের কারও কারও ২০১৪, ১৮, ২৪ সালের নির্বাচনে ছিল দানবীয় ভূমিকা। বিএনপির কয়েক নেতা এবং পুলিশ ও জনপ্রশাসনের কিছু লোক এ কাজে অর্থনৈতিক মওকা হাতাচ্ছেন বলে তথ্য-সাবুদ আছে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের কাছে। আবার বৈষম্যবিরোধী নেতাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধেও পদ-পদায়ন-বদলি ইত্যাদিতে বসে থেকে কাজ আদায়ের অভিযোগ আছে। গোটা বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্যান্য উপদেষ্টার জন্য বিব্রতকর। যা বলার মতো নয়, আবার অবিরাম সহ্য করার মতোও নয়। যেখানে এখন যাবতীয় কাজ আবর্তিত হওয়ার কথা সংস্কার নিয়ে, সেখানে যত কাণ্ডকীর্তি সুবিধা হাসিল নিয়ে। ডিসি নিয়োগ নিয়ে সচিবালয়ে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছে। প্রজ্ঞাপন জারি করে তা আবার আরেক প্রজ্ঞাপন দিয়ে বাতিলও করতে হয়েছে।
এতে সংস্কার আর মুখ্য থাকছে না। এ রকম সময়েই ঢাকা সফর করে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাই-প্রোফাইল টিম। বহুল আলোচিত ডোনাল্ড লুও ছিলেন এই টিমে। তারা ড. ইউনূসসহ অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গেও একান্তে কথা বলেছেন। দিয়ে গেছেন স্পেশাল কিছু বার্তাও। সেই বার্তাদৃষ্টে স্লো-স্টেডি এগোচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। নানা সংস্কারের পাশাপাশি বিশেষভাবে চলছে নির্বাচন-ব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন এবং সংবিধান সংস্কারের কাজ। কমিশনও করে দেওয়া হয়েছে এসব কাজে এক্সপার্টদের দিয়ে। তাদের রিপোর্ট দেওয়ার পর শুরু হবে মূল কাজ বা অ্যাকশন, যা মোটেই বিএনপির দাবিমতো দু-তিন মাসের কাজ নয়। বিপ্লবের মাধ্যমে গঠিত ইউনূস প্রশাসনকে একসঙ্গে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ ও প্রত্যঙ্গের অসুখ সারাতে হবে। একই সঙ্গে জনগণকে সঙ্গী করে আন্তর্জাতিক শক্তিকে আস্থায়ও রাখতে হবে। এ সংস্কার বড় কঠিন কাজ। আবার এ সংস্কার বরবাদের নানা আয়োজনও চলছে সমানে। সময়টা বড় সঙিন। এ সময়টা উতরাতে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি শক্তিগুলোর ভূমিকা আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম প্রধান অংশীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৭২ সাল থেকে ইউএসএইড প্রায় ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্য দিয়েছে বাংলাদেশকে। অবকাঠামোগত উন্নয়নেও সহায়তা করেছে। সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোও। যুক্তরাষ্ট্র পুনরায় বাংলাদেশ পুনর্গঠন এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য এগিয়ে এসেছে, যেমনটি এসেছিল বিগত স্নায়ুযুদ্ধের সময়। নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের যেমন বাংলাদেশকে প্রয়োজন, তেমনি বাংলাদেশকেও প্রয়োজন মার্কিনিদের। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধিদলের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বর্তমান সময়টি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ইতিহাসের এক তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত বলে উল্লেখ করেন। ছাত্রদের নেতৃত্বে সংঘটিত বিপ্লবকে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশে নতুন আশা-জাগানিয়া যুগের সূচনা নামে। তিনি দেশ পুনর্গঠন, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চেয়েছেন। জবাবে মার্কিন প্রতিনিধিদল ড. ইউনূসের নেতৃত্বের প্রশংসার পাশাপাশি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা করতে পারলে ওয়াশিংটন আনন্দিত হবে বলে জানায়। বাদবাকিটা এখন যার যার বুঝে নেওয়ার বিষয়।