সব যুগেই ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতাবানদের ঘিরে থাকে স্তাবকের দল। সেই স্তাবকদের বলা হয় ‘ইয়েসম্যান’ বা ‘জি হুজুর’। এরা মনিবের চারপাশে হাত কচলায় আর মনিবের যেকোনো কথা তা যত দেশবিরোধী হোক, ‘ইয়েস স্যার, জি স্যার, এর চেয়ে ভালো হয় না স্যার বলে লেজ নাড়ায় ন্যাড়া কুকুরের মতো। এই সব স্তাবকের দল নেতা বা নেত্রীকে এমনভাবে তোলা দেয় যে, তাদের এক নায়ক বা স্বৈরাচারের পথে হাঁটা ছাড়া আর পেছনে ফেরার পথ থাকে না। তখন এই সব শাসকেরা জি হুজুরদের ইয়েস স্যার ছাড়া আর কোনো কথা শুনতে ভালো লাগে না। তখন তারা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে গণতন্ত্রের কথা মুখে বললেও তাদের মনে আর গণতন্ত্র জায়গা পায় না। এইসব জি হুজুরের দ্বারা এমনভাবে পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ে যে আর সেই চক্রভেঙে বের হয়ে আসার ক্ষমতা রাখে না। ধাপে ধাপে তারা এতটাই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন যে, তারা তখন নিজেদের ছাড়া আর কাউকে মানুষ ভাবতে পারে না। কোনো মানুষ তারা মর্যাদা দিয়ে, সম্মান দিয়ে কথা বলতে পারে না। সবাইকে তখন অবহেলা, অবজ্ঞা এবং অসম্মানের চোখে দেখে। মানুষকে তারা আর মানুষই ভাবতে পারে না।
তখন কেউ বুঝতে না পারলেও কিংবা বুঝতে না চাইলেও আস্তে আস্তে তখন পতন ঘনিয়ে আসে এবং একসময় বর্ষায় পদ্মার ভাঙনের মতো তাদের পায়ের নিচে আর মাটি খুঁজে পায় না। এসবের দৃষ্টান্ত খুঁজতে বেশি দৃঢ় দৃষ্টি মেলতে হয় না। নিজ দেশের দিলে তাকালেই অনেক এক নায়ক এবং স্বৈরাশাসকের দৃষ্টান্ত চোখে পড়বে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হলো। কিন্তু বাঙালিরা পশ্চিমাদের হাত থেকে স্বাধীনতা পেল না। এক দেশের নাগরিক, একধর্মের মানুষ হয়েও বাঙালিরা স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙালিদের দ্বারা চরম শোষণ, নিপীড়ন, বৈষম্যের শিকার হতে থাকে পূর্বে পাকিস্তানের বাঙালিরা। তারা পূর্ব পাকিস্তানকে তাদের উপনিবেশে পরিণত করে এবং ব্রিটিশদের চেয়েও নিষ্ঠুর নির্মম দমন-পীড়ন এবং শোষণের শিকার হন। তারা আমাদের ভাষা কেড়ে নিতে চায়। তারা ১৯৫৪ সালে ভোটের বিজয় ছিনিয়ে নেয়। এরপর বাঙালিদের মতো সংগ্রাম, কত আন্দোলন, জীবন বিসর্জন, কিছুতেই তাদের সামনে যায় না। অবাঙালিরাই তখন বাঙালিদের সামনে মৃর্তিমান ব্রিটিশ যেন।
কিন্তু বারবার তো ঘুঘু ধান খেয়ে পার পেয়ে যেতে পারে না। ১৯৭১ এ পশ্চিমারা বাংলার কাদা-মাটিতে আটকে যায়। বাঙালিদের গাম্বুরা মার খেয়ে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। বর্ষা বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাকিস্তানি চৌকস সেনারা অস্ত্র-গোলাবারুদ ফেলে, জাঙ্গিয়া-শান্তালুজ ছেড়ে জান বাঁচাতে দৌড়ে পালায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালিরা তখন দুর্বার। কারও তখন কোনো সাধ্য নাই বাঙালিদের সেই অগ্রযাত্রার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অবশেষে পৃথিবীর ইতিহাসে একটি নতুন দেশের অভ্যুদয় বাংলাদেশ। নতুন দেশ, নতুন পতাকা, নতুন জাতীয়তা, নেয়ার দৃঢ় প্রত্যয় মানুষের মনে।
কিন্তু আবার সেই ইয়েস স্যার, জি স্যারের আছড়। মানুষের সব উদ্দীপনা, সব প্রত্যয়, সব প্রতিজ্ঞা বেলুন ফুটো হয়ে বাতাস বেরিয়ে যাওয়ার মতো সব উদ্দীপনা শেষ হয়ে যায়। ইয়েসম্যানদের তোষামোদির পরিণতি তখন শাসক জনগণের কথা ভুলে যায়। জনগণের কল্যাণ ভাবনা মাথা থেকে দূর হয়ে যায়। তখন জনগণ তার শত্রু পক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। তখন তার রাস্তাপানের দিকে। তখনই সে দাঁড়ায় ধ্বংসের কিনারে। টের পান না কখন পার ভেঙে তার পতনের পথ তৈরি হয়। এক দিন সামান্য বাতাস বা ক্ষীণ স্রোতেই রাজ্যপাট ভেঙে পড়ে। এসব দৃষ্টান্ত সামনে থাকলেও ক্ষমতার দম্ভে সব ভুলে থাকে। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা ইতিহাস ভুলে যায়। আইয়ুব, এহিয়া, জিয়া, এরশাদ সবার ক্ষেত্রে একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। কিন্তু বড় মিয়ারা সব বিস্মৃত হয়ে দিবা স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকেন।
শেখ হাসিনাও ইয়েসম্যান দ্বারা পরিহত হয়ে ছিলেন। বাস্তব ভুলে ক্ষমতার ফ্যান্টাসিতে শত্রুমিত্র ভুলে বাঘের পিটে সওয়াব হয়েছিলেন। পরিণতি যা হওয়ার তাই হয়েছে। জাপানি সংবাদ মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে নিয়ে এখন একটা প্রতিবেদনই প্রকাশ করেছে নিক্কেই এশিয়াতে। গণতন্ত্রে যে সাধারণ মানুষই দেবতা সে কথা ভুলে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি দেবতা বানাতে চেয়েছিলেন তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। দেবতাদেরও যে যেখানে সেখানে অধিগ্রহণ হয় না সে কথাও ভুলে গিয়ে সব করেছেন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর অনুসারিরা তাঁর কন্যার নেতৃত্বে। দেশে রাজনীতি ছিল না, রাজনৈতিক কোন কর্মসূচি ছিল না। শুধু বন্দনা আর বন্দনা। কোন বিষয়ে জনগণকে কোন কৃতিত্ব দেয়া হয়নি। এ নিয়ে একটি মজার গল্প আছে যে, যুদ্ধের সময় কচুর পাড়ে পালিয়ে থেকে যুদ্ধ জয়ের সব কৃতিত্ব এক ব্যক্তি খেতে গিয়ে কী রকম লজ্জায় পড়েছিলেন সেই গল্প।
যাই হোক, বাংলাদেশের মানুষ অনেকবার অনেকরকম ভাগ্য বদলের গল্প শুনেছেন। কিন্তু তারা যে তিমিরে ছিল, আজও সেই তিমিরেই আছে। ফ্যান্টাসির জগৎ আর বাস্তবজগৎ কিন্তু এক নয়। সাধারণ মানুষের ভাগ্য বদলের অঙ্গীকার সব শাসক ভুল না যায়।