Thikana News
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশ : সারা বিশ্বের বিস্ময়

বাংলাদেশ : সারা বিশ্বের বিস্ময়


মাত্র ৩৬ দিনের আন্দোলন। জনতার ধাক্কা। ১ জুলাই শুরু, ৫ আগস্ট সব শেষ। দুনিয়ার মানুষ অদ্ভুত এক আন্দোলন প্রত্যক্ষ করল। ভোজবাজির মতো শুরু এবং শেষ। এক দিন আগেও কেউ বুঝতে পারল না, অথচ এক দিন পরই বালির বাঁধের মতো মাটিতে লুটায়। নিজের রাজ্য-মন্ত্রী, পারিষদবর্গকে ছেড়েছুড়ে রাজার পলায়ন। কোনো দল নেই, জন নেই। সঙ্গী নেই, সাথি নেই। নিঃসঙ্গ, একা। সঙ্গী সেই বোন। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, সেটাও আগস্ট মাস। বঙ্গবন্ধুকে যে মাসে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, সেই আগস্ট মাসেই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার দেশ ছেড়ে করুণ পলায়ন।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫। সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন পুত্র, দুই পুত্রবধূসহ পরিবারের প্রায় ১৯ জন সদস্য-সদস্যাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এমন নির্মম ঘটনার মধ্য দিয়ে যে পরিবর্তন আসে, তাকে দেশের মানুষ স্বাগত জানায়। আবার পরিবর্তন, আবার হত্যাকাণ্ড। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাকের হাত ঘুরে মেজর জিয়ার ক্ষমতা গ্রহণ এবং ১৯৮১-তে পুনরায় প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যা করে একই নাটকের মতো বিচারপতি সাত্তারের হাত ঘুরে লে. জে. এরশাদের হাতে এসে ক্ষমতা কিছুটা থিতু হওয়া। কিন্তু এসব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে, এত রক্তক্ষরণের পরও মানুষের যে ন্যূনতম প্রত্যাশা, গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষা, জীবনচলার জন্য সামান্যতম স্বস্তি মেলেনি। মানুষকে শুধুই বঞ্চিত করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে ক্ষমতাধররা কেবল চালাকি আর শঠতাই করে গেছে।
১৯৪৭ থেকে এ-যাবৎকাল পর্যন্ত মানুষ কেবল লড়াই দেখেছে। কিন্তু না পেয়েছে রাজনৈতিক মুক্তি, না পেয়েছে অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তির স্বাদ। সাধারণ মানুষের সঙ্গে এত চালাকি, এত ধোঁকাবাজি বিশ্বের আর কোনো দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের করতে দেখা যায়নি। পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলার মানুষকে ঠকায়নি, সে দৃষ্টান্ত নেই। দুর্ভাগ্যের বিষয়, কেউ কথা রাখেনি। সবাই সাধারণ মানুষের রক্ত মাড়িয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পরই তারা মানুষের কথা ভুলে গেছে। সুযোগসন্ধানীরা নিজেদের ভাগ্য গড়তে কোনো সুযোগই হাতছাড়া করেনি। শাসন পাল্টেছে, শাসক পাল্টেছে কিন্তু সুযোগসন্ধানী কখনোই বঞ্চিত হয়নি। তারা তাদের ভাগ্যতরী পূর্ণ করে প্রতিটি পটপরিবর্তনকে কাজে লাগিয়েছে। মানুষ দেখেছে কীভাবে স্বরাজ পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে ভাগ্যবানদের ভাগ্য পাল্টায়। ভাগ্যবানরা আসলে সব সময় ক্ষমতাসীনদের ক্ষমাদৃষ্টি লাভ করে, তাদের সব পাপ ধুয়েমুছে যায়। কিন্তু গরিবদের পাপের ঘানি টানতেই হয়।
সাধারণ ভাগ্যহত মানুষ তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের সামান্য আশ্বাস পেলেই আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তেও কোনো রকম ভয় পায় না। ১৯৪৭-এ জিন্নাহ সাহেবরা বাঙালিদের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা বললেন। ভাষার পার্থক্য লুকিয়ে ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধের কলা দেখালেন। কিন্তু বেলা শেষে ১৯৪৭-এ পাকিস্তান হলে বাঙালিরা কলা পেল ঠিকই, তবে সবই কাঁচকলা আর বিচিকলা। পশ্চিমারা পেল শবরী আর সাগর কলা। যেটুকু বাকি থাকল, সেটুকু পুষিয়ে নিতে থাকল বুটের শক্তি কাজে লাগিয়ে। মুসলমান-মুসলমান ভাই-ভাই স্লোগানের মানে বুঝিয়ে দিতে থাকল পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানের উপনিবেশ বানিয়ে। বাঙালিদের ওপর এহেন জুলুম-অত্যাচার ছিল না, যা তারা করেনি।
অবশেষে তারা আঘাত হানল বাঙালির মায়ের ভাষা বাংলা ভাষার ওপর। এবার জিন্নাহ বললেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ আর কত অত্যাচার সইবে বাঙালি? বাঙালিরা পাল্টা গর্জন দিয়ে জানিয়ে দিল, ‘না, বাংলাই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ বাংলার আকাশে-বাতাসে তখন একই আওয়াজ, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। অবশেষে ভাষার দাবিতে আমাদের রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বার জীবন দিলেন। কিন্তু ছিনিয়ে আনলেন বাংলা ভাষার অধিকার। বাঙালিরা সব সংগ্রামে বুক চিতিয়ে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লড়াই করে বুকের রক্তে মাটি ভিজিয়েছে। কিন্তু বড় ভাগটা পেয়েছে বাংলার চতুর শেয়ালে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শেষ লড়াই হলো ১৯৭১-এ। ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিলেন। দুই লক্ষাধিক মা-বোন সম্ভ্রম হারালেন। বেশুমার ঘর-বাড়ি জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গেল। মানুষ মাথায় হাত দিয়ে পথে বসে গেল, কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষের স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। পাড়ভাঙা মানুষের চোখে যে গভীর অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে, সেই হতাশা নিয়ে তারা তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে। সে হতাশা আর কাটে না।
সদ্যগত গণ-আন্দোলনেও কত মানুষ জীবন দিল। কত মানুষের স্বপ্ন বুকের রক্তে ভেসে গেল। এবারও সমাজ বদলের, মানুষের ভাগ্য বদলের এত বড় গণ-আন্দোলনে সাফল্য এসেছে জীবনঘনিষ্ঠ প্রতিশ্রুতির জন্য। রাষ্ট্র সংস্কার করতে তারা আমাদের কোমলমতি ছেলেমেয়েদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, দেশের মানুষকে যত স্বপ্ন দেখিয়েছে, তা কি এবারও পূর্ণতা পাবে? আসলে আমরা কত কিছু সংস্কারের কথা বলি, কিন্তু বিবেক সংস্কারের কথা শুনি না। মানুষের মানবিকতাকে উন্নত করার কথা বলি না। এসব ছাড়া কোনো দিন কোনো উন্নত জাতি, উন্নত রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এবারের গণ-অভ্যুত্থানেও যদি আমরা নিজেদের বিবেক-বুদ্ধির যথার্থ উন্নতি করতে ব্যর্থ হই, তবে এবারের সাফল্য লাভের সম্ভাবনা কতটা দেখা যাবে, তা নিয়ে কেউ যদি সংশয় পোষণ করেন, তবে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না।
আমরা প্রার্থনা করিÑএবার যেন আমরা ব্যর্থ না হই।
 

কমেন্ট বক্স