ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা থাকতে থাকতে, উজরা-লুরা যেতে না যেতেই ভারত থেকে উড়াল দিয়ে এলেন শীর্ষসেরা ব্যবসায়ী আদানি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করে নিজস্ব বিমানে ফিরে গেলেন তিনি। কী কথা হয়েছে তাদের মধ্যে কিছু জানিয়ে যাননি। কাছাকাছি সময়ে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা সম্মেলন করে জানিয়ে দিয়েছেন, তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেই আছেন, থাকবেন। ভবিষ্যতে তাকেই চান। তাকে যেন কেউ ক্ষমতাচ্যুত করতে না পারে বা কেউ ক্ষমতায় আসতে না পারে, এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখার কথাও দেন তারা।
দৃশ্যত বা বাহ্যত সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলা হলেও কে কেন ছুটে আসছেন, সব এখনো পরিষ্কার নয়। নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সময় বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। চরম আত্মতুষ্টিতে হেলেদুলে চলা সরকারগুলোও পড়েছে চরম অস্থিরতায়। একের পর এক অস্বস্তিকর অবস্থায় প্যাঁচিয়ে যাচ্ছে তারা। বাংলাদেশে এমনিতেই সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে ভিন্ন প্যাটার্নের আন্দোলন। প্রায় সব আন্দোলনকারী দলই কোনো না কোনো বিদেশি সংযোগে আগুয়ান। বিদেশি সংযোগ রাখছে সরকারও। তা অনেকটা চীন-ভারত-রাশিয়ার দিকে একতরফা, যা আগুনে ঘি ঢালার মতো বাংলাদেশকে এরই মধ্যে কূটনীতির কুরুক্ষেত্রে নিয়ে গেছে। কাঁচা শামুকে পা কাটার মতো ঢাকা-১৭ উপনির্বাচনে আলোচিত স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমকে মারধরের ঘটনার স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ঘটনার নিন্দা করেছে জাতিসংঘ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও।
ভূরাজনৈতিক চাহিদায় বাংলাদেশকে পেয়ে বসার বিদেশি পক্ষগুলো সাম্প্রতিক সময়ে যারপরনাই সোচ্চার-তৎপর। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য অংশীদারত্বমূলক নির্বাচন, শ্রমধিকার ও মানবাধিকার সমুন্নত না রাখার দুর্বলতায় যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছামতো চেপে ধরেছে বাংলাদেশকে। রপ্তানি বাণিজ্য প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে অনেকটা অসহায় সরকার। আসন্ন নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য এবং অংশীদারত্বমূলক করার উপদেশ দিয়ে গেছেন মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া। গুনে গুনে শব্দ দিয়ে তিনি বলে গেছেন, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সমৃদ্ধি ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্যপূরণে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং গণতন্ত্র সমুন্নত রাখা ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বাংলাদেশে এলপিজিসহ জ্বালানি তেল এবং কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ করার সময় সরকার ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করেনি নতুন স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হবে বা পৃথিবী আবার বিভক্ত হবে। যদিও বিদেশি গণমাধ্যম ২০১৭ সাল থেকেই চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধকে নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সূত্রপাত বলে অভিহিত করে আসছে। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া যখন ইউক্রেনে আক্রমণ করে, স্নায়ুযুদ্ধ তখন প্রকাশ্য রূপ নেয়। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ফলে জ্বালানি তেল আমদানিনির্ভর দেশগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চিন্তা বাদ দিয়ে তেল আমদানির কথা ভাবতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে ডলার সংকট বাড়তে থাকে। রিজার্ভ নিয়ে বড়াই করা বাংলাদেশকেও এ কারণেই আইএমএফের শরণাপন্ন হতে হয়। উন্নয়নের জন্য চীন ও রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে বাংলাদেশ একধরনের আপদে পড়লেও হাল ছাড়েনি।
প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রকে পাশ কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ডলারকে দুর্বল করার লক্ষ্যে রাশিয়ার রুবল, ভারতের রুপিতে বাণিজ্য করার জন্য সিদ্ধান্ত কার্যকর করে চলেছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বাড়াতে এবং মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভরতা কমাতে বিদ্যমান লেনদেন-ব্যবস্থার পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে রুপিতে লেনদেন শুরু করছে বাংলাদেশ। ব্রিকসের উদ্যোগে স্থাপিত নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-এনডিবিতে যোগ দেওয়ার চুক্তিতে অনুসমর্থনের প্রস্তাবও অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বকে পাশ কাটিয়ে ‘ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ শীর্ষক চুক্তি এবং ভারতীয় রুপিতে বাণিজ্যের কী ফল ভুগতে হয়, সেদিকে দৃষ্টি অনেকের। এ দৃষ্টিপাতের মাঝেই ইইউ, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও জার্মানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে মার্কিন দূতাবাসের শ্রম অ্যাটাচে লীনা খান বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন - বিজিএমইএ সদর দপ্তর পরিদর্শন করেছেন। শ্রমিকনেতা শহিদুল ইসলাম হত্যার পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্ত ও দোষীদের জবাবদিহির দাবি জানানো হয়েছে।
এর মাঝেও অর্থনীতিকে টপ প্রায়োরিটি সরকারের। ধকলটা অর্থনীতির দিক থেকে বেশি আসবে বলে নিশ্চিত সরকার, যা প্রকারান্তরে জগৎ শেঠদের কাছে আত্মসমর্পণের মতো। দেশীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এরই মধ্যে ব্ল্যাঙ্ক চেক আদায় করে নিয়েছে সরকার। ভারতীয় কিছু ধনকুবেরও আছেন সরকারের সঙ্গে। অনেকটা সঙ্গোপনে ঢাকায় এসে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিয়ে গেছেন ভারতের আদানি। গণমাধ্যমও জানতে পারেনি। নিজের টুইটার পেজ থেকে ছবিসহ বিষয়টি টুইট করে জানান ভারতের আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান গৌতম আদানি নিজেই। বলা হয়েছে, ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গোড্ডা জেলায় আদানি গ্রুপের নির্মিত ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুরোপুরি চালু হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাতে সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকায় আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির খাসবন্ধু আদানি। এর পূর্বাপরের ঘটনা ও রহস্য জানেন হাতে গোনা নির্দিষ্ট কয়েকজন। ভারতীয় হিতাকাক্সক্ষীর সমান্তরালে মার্কিন কিছু বিজনেস কমিউনিটিকে হাতে রাখতে চায় সরকার। এ চেষ্টার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি এক্সন মবিলকে দেওয়ার তোড়জোড়ও তুঙ্গে। উল্লেখ্য, তেল-গ্যাস উত্তোলনে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করতে ইতিমধ্যে উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তিও সংশোধন করেছে সরকার। এর উদ্দেশ্য-বিধেয়ও বেশ গভীরে।
                           
                           
                            
                       
     
  
 

 ঠিকানা রিপোর্ট
 ঠিকানা রিপোর্ট  
                                
 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                 
                                                     
                                                