Thikana News
০৪ জুলাই ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪

যে কোনো সংকটে আজও রবীন্দ্রনাথের আশ্রয় খুঁজি

যে কোনো সংকটে আজও রবীন্দ্রনাথের আশ্রয় খুঁজি
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের প্রতি অপার ভালোবাসা জানিয়ে গেছেন বলেই কী তিনি বিশ্বকবি? অথবা তাঁর কবিতায় ও গানে যে অমৃত রচনাবলীর সম্ভার দিয়ে সমৃদ্ধ করে গেছেন বাঙালি জাতীয় জীবন তথা বিশ্ব-মানব-সমাজে, সেই কারণেই তিনি কী কবিগুরু নামে অভিহিত- এইগুলো সব যথার্থ প্রশ্ন যদিও তার সঠিক বিশ্লেষণ নেই। কবির কাজ যখন এক ধরণের সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়া (অর্থাৎ বিজ্ঞানের ভাষায় ক্যাটালাইসিস্)- অর্থাৎ মানবজনমের প্রতিদিনের রোজনামচার অগোচরে যে নীরব সুন্দর কাজটি চলছে তাকে উন্মোচন করা। তখন আরও একটি বিজ্ঞানের জন্ম দেয়- সেটা হলো স্পর্শকাতরতা। মূলতঃ এর মাঝ দিয়ে অন্য একটি স্নায়ু স্পন্দিত হয়। জীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গে সেই কথাগুলো ছড়িয়ে থাকে অপরূপ এক নান্দনিক অনুভূতিতে। যার ঝংকারে জীবন খুঁজে পায় নবারুণ নবালোক। এই যে রিজোনেন্স- অর্থাৎ এক তারের ব্যথা, হাসি-কান্নার দোল্- একই সুরে গ্রন্থিত অন্য একটি তারকে স্পর্শ করে যায়- তখন কবি হন স্রষ্টা। 
তখন চলার পেেথর প্রতিটি দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষে, কায়-ক্লেশে, অন্যায়-অপবাদে, বিরহে-ভালোবাসায় জীবন খুঁজে পেতে চায় বেঁচে থাকার প্রশমিত সুর। রবীন্দ্রনাথ তার মরমী চিন্তা আর দর্শন দিয়ে এবং তার সঙ্গে নিখিলের সুর ও সঙ্গীতকে সংযোজন করে- জীবনের উদ্বোধনের পথটি দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। সেই কারণেই কী আমরা রবীন্দ্রনাথের  আশ্রয় খুঁজি।
এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিশ্বনন্দিত বিজ্ঞান আইনস্টাইনের মন্তব্যটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। তিনি বলছেন- ‘প্রয়োজন আর অন্ধকার থেকে উঠে আসা মানুষগুলো অস্তিত্বের জন্য কী ক্লান্তিকর লড়াই করছে। আপনি গভীর ধ্যানমগ্নতায় ও সৌন্দর্যের কারুকার্যতার মধ্য দিয়ে মুক্তির সন্ধান করেছেন। ফলে মানবতার সেবা করে গেছেন। সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন একটি সুশান্ত উৎসাহ ও জীবনীশক্তি।’ উল্লেখ্য যে, আইনস্টাইন যে উৎসাহ ও শক্তির কথা বলছেন- সেটি আমাদের প্রতিদিনের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমাজে ও সংসারে প্রতিদিনের অন্বেষা। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় সেটা হচ্ছে এক ধরনের মুক্তি। যার মূলে রয়ে গেছে সেই জীবনাশক্তির অন্বেষা।
এখানে ‘বিজ্ঞান’ কিছুটা সংযোজিত হতে পারে। কবিতা হয়তো পুরোপুরি বিজ্ঞান নয়। কিন্তু ভাষার বিজ্ঞান তো নিঃসন্দেহে। বিজ্ঞান যেমন খুঁজে বেড়ায় অদৃশ্যমানকে দৃশ্যমান করতে এবং বাস্তবে রূপ দিতে- কবিতাও তেমনি কখনো আকাশে, কখনো বা মেঘের অন্তরালে- কখনো অন্তহীন নদীর জলে- কখনো বা প্রখর তপন তাপের দহন জ্বালায়- কিছু ছন্দোময় শব্দের উপকরণ খুঁজেছে। যার সমীকরণ হলো মানব জীবনের প্রতিদিনের সংগ্রাম এবং উপঘাতকে আনন্দময় করে তোলা। এবং একজন গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন কবির দ্বারাই সেটা সম্ভব। জগৎবিখ্যাত দার্শনিক ব্রাট্রান্ড রাসেল- এই দৃষ্টিকে আরো একধাপ নিয়ে গেছেন তাঁর সুচারু দর্শন দিয়ে। উনি বলছেন- “বিজ্ঞানও মাঝে মাঝে জ্ঞানের সীমারেখা টানে। কিন্তু বিজ্ঞান ভাবনাকে এবং ভেতরের অনুভূতিকে (ইমাজিনেশন) সীমাবদ্ধ রাখতে পারে না। তাই যখন কবি বলেন- ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি’- সেটা শুধু প্রাণেশ্বরই অনুসন্ধান নয়। কবি চাইছেন এই জগৎ সংসারের আরো ভেতরে যেতে। আরো জানতে। যার নির্যাস তিনি ভাষার ডালিতে সাজিয়ে প্রার্থনার প্রদীপকে সঞ্জীবিত করবেন।” 
রবীন্দ্রনাথ সেই সঞ্জীবনী মন্ত্রটি দিয়ে গেছেন তাঁর অপার সৃষ্টিকর্মে। হয়তো অনেক সময়ে মনে হতে পারে- এগুলো সব প্রার্থনার সঙ্গীত। মনে হতে পারে- অতৃপ্ত প্রেমের সঙ্গে তিনি সমপ্রার্থী হয়েছেন। অথবা বিশ্বের অপরূপ সৃষ্টিময়তাকে আরো সুন্দরের তুলি দিয়ে সাজিয়েছেন। কিন্তু সবকিছুর গভীরে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে- পৃথিবীর সব রূপ, রস, গন্ধ তিনি বিজ্ঞানীর মতো আহরণ আর আবিষ্কার করেই থেমে থাকেননি। তিনি বিলিয়ে দিয়েছেন সবার মাঝে সেই ধ্রুব সত্যটি- ‘মানুষকে শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হতেই হবে।’ 
রবীন্দ্রনাথে আমরা যে দুঃখজয়ের গান শুনি- এখনো যে উদ্দীপ্ত হই- তার বীজ এখানেই। সত্যাশ্রয়ী বলেই তিনি মানুষের সেই অপার শক্তিকে জাগ্রত করতে সচেষ্ট হয়েছেন। মুক্তি ‘বৈরাগ্য সাধন’ দিয়ে নয়- মুক্তি নিহিত আছে আলোর রাজ্যে। সেই আলোর সন্ধান প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। যখন শুনি সেই অমৃত ধ্বনি- ‘আলোকেরই ঝর্নাধারায় ধুইয়ে দাও’- জীবন তখন সচেষ্ট হয় অন্ধকার তিমিরকে জয় করতে।
সমালোচক আবু সায়ীদ আইয়ুব রবীন্দ্রনাথকে সাম্যের কবি বলে অভিহি করেছেন। কেউ বলেছেন ঋষি- কেউ বা বলেছেন সৌন্দর্যের কবি। মূলতঃ তাঁর সৃষ্টিময়তার সঙ্গে কেউ ‘সংগ্রামী’ ধ্যান-ধারণাটি তুলে ধরেননি। এবং সেটা সঙ্গতও নয়। সংগ্রামী চেতনায় রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাসটি ছিলো ভিন্নতর। এবং সেই বিশ্বাসকে অবলম্বন করেই তিনি মহিমামণ্ডিত করে গেছেন বাংলা ভাষাকে, তথা বাঙালি জাতীয় জীবনকে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বাংলার রেনেসাঁর পাশাপাশি নজরুল ও জীবনানন্দ বা পল্লীকবি জসীমউদ্দীন যেমন স্মরণীয়- তেমনি বিস্ময়কর আদান রবীন্দ্রনাথের। ‘ভাঙ্গ ভাঙ্গ কারা’- এই আত্মার-শেকল-মুক্তির গান নিয়ে তিনি ‘সংকোচের বিহ্বলতাকে’ আঘাত করেছেন। বৈশাখের দহনে যখন সমস্ত বিশ্ব তৃষিত মরুর মতো আর্ত- তখন তিনি গেয়ে উঠেন এই প্রখর তাপ বৎসরের আবর্জনাকে পুড়িয়ে ‘শুদ্ধ হোক ধরা’। এটাও কবির এক সংগ্রামী বিশ্বাস। তেমনি বিশ্বাস ছিলো জীবনের অন্তিম ধ্যানে। জীবন ফুরাবেই। প্রেম আসবে- চলে যাবে নীরবে। কিন্তু বেঁচে থাকতে হবেই। বিরহ-দহন দিয়ে নয়- প্রেমের জোয়ার দিয়ে। যে প্রেম এই বিশ্বভুবনে ছড়িয়ে আছে পাতায় পাতায়। সেই আলোর নাচন দিয়ে বিশ্বসভায় দৃপ্তচিত্তে প্রতিদিনের পথচলাকে দীপ্ত করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাইতো তিনি প্রতিদিনের কবি। অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর তাঁর ‘মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে বলে গেছেন- ‘তিনি তাঁর কল্পনাশক্তি ও অনুভবের সমুদয় উষ্ণতা দিয়ে মানুষকে ভালোবাসতেন এবং মনে করতেন যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মানুষের আত্মশক্তি অপেক্ষা উন্নততর আর কিছু নেই।’ 
মানবজাতিকে যিনি এতো ভালোবাসেন- তাঁর কাছে প্রেরণা চাইবো- সেটাই হয়তো বিশ্বকবি বা কবিগুরুর জন্য হবে যথার্থ প্রতিদান।

কমেন্ট বক্স