তার মাথায় জলধারা দেওয়া হচ্ছে। একটা মাটির পাতিলের তলায় ছিদ্র করে এক টুকরো কাপড়ের সলতে ঝুলিয়ে দেওয়া। পাতিলে পানি, সেই পানি সলতে বেয়ে তার কপালে পড়ছে। পাতিলটা মাথার উপর ঝোলানো। মা সন্তানের মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। জ্বর নামার কোনো লক্ষণ নেই। মায়ের চোখে ঘুম নেই। মাঝে মাঝে তিনি আঁতকে ওঠেন। সন্তানের নাকের কাছে হাত নিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস পরীক্ষা করেন। এই তো তার ‘কালামানিক’ শ্বাস ফেলছে! পাশে সন্তানের পিতার ঘুমে যেন কোনো ব্যাঘাত না ঘটে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হচ্ছে। অবশ্য পিতা মাঝে মাঝে উঠে পাতিলে পানি ভরে আবার শুয়ে পড়েন। সন্তানের অমঙ্গল আশঙ্কায় মা একটিবারও বালিশে মাথা রাখার ভরসা পান না। আজ সাত দিন হলো তারা গ্রামের বাড়িতে এসেছেন। নদী পার হয়ে প্রায় আড়াই মাইলের হাঁটাপথ। বাড়িতে আসার সময় হঠাৎ কালবৈশাখীর কবলে পড়েন সবাই। বাতাসের প্রচণ্ড আঘাতে মায়ের কোল থেকে তিন মাস বয়সী ছেলেটি ছিটকে পড়ে যায় রাস্তার পাশে ধানক্ষেতে! অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাকে পাওয়া যায়। তবে বেঁচে আছে কি না বোঝা যাচ্ছিল না। মায়ের আর্তচিৎকার আর বাতাসের গর্জন সব মিলে একাকার! ঝড়বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য অজানা এক বাড়িতে গিয়ে তারা ওঠেন। সেই বাড়িতে বাচ্চাটাকে জ্বলন্ত চুলার কাছে কোলে নিয়ে বসে একটু ওম দেওয়ার চেষ্টা করেন। হঠাৎ বাচ্চাটা নড়েচড়ে উঠলে মা চিৎকার করে ওঠেন, ‘ওইতো আমার কালামানিক বেঁচে আছে!’ তিনি তাকে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। তার কালামানিক চুকচুক করে দুধ টানছে, মায়ের বুকফাটা কান্না থামে, মুখে ফোটে একঝলক হাসি!
এত দিন হলো ছেলেটার জ্বর নামছে না। কবিরাজ বলে দিয়েছে, ওর খারাপ ধরনের ‘টাইফয়েড’ হয়েছে। সব সময় মাথায় জলধারা আর কপালে তুলসী পাতার রস দিতে হবে। বাবা-মা আল্লাহর কাছে সন্তানের প্রাণভিক্ষা চান। তাদের সন্তান যদি বাঁচে, তবে তাকে কোরআনে হাফেজ বানাবেন বলে ওয়াদা করেন। একসময় ছেলেটা বেঁচে যায়। তবে ছয় বছর বয়স অবধি তার পরপর সাতবার টাইফয়েড হয়। টাইফয়েড হলে সাধারণত শরীরের কোনো একটা অংশ অকার্যকর করে ফেলে। ছেলেটির দৃশ্যমান কোনো অঙ্গহানি না হলেও ডাক্তাররা বলে দিয়েছেন, এই ছেলের পড়ালেখা বেশি দূর এগোবে না! স্মরণশক্তি একেবারে কমে যাবে। টাইফয়েড ওর মেধা নষ্ট করে ফেলেছে! স্মরণশক্তি কমে যাওয়া ছেলেটি বাসায় পবিত্র কোরআন মুখস্থ করার চেষ্টা করে আর স্কুলেও যেতে থাকে। তবে এক পারা মুখস্থ করে যখন সামনে এগোয়, তখন পেছনের মুখস্থ করা অংশ বেমালুম ভুলে যায়। তার আর হাফেজ হয়ে ওঠা হয় না। স্কুলের পড়া মোটামুটি চলতে থাকে। শুধু অঙ্কটা কোনোভাবেই মাথায় ঢোকে না!
তার গায়ের রং কুচকুচে কালো। বাবা-মা, ভাইবোন কারও সঙ্গে মেলে না। বাসায় মেহমান এলে সবাই মাকে রসিকতা করে প্রশ্ন করে, এই ছেলে কোত্থেকে এল? মা তখন রহস্যের হাসি হেসে বলেন, ও আমাদের কুড়িয়ে পাওয়া ‘কালামানিক’! মায়ের কাছে সেই ছোট্টবেলার ঝড়ে পড়ার গল্প শুনে ছেলেটির মনে ক্ষীণ সন্দেহ হয়, তবে কি সে কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে? একটা ব্যাপারে খেয়াল করলে এর সত্যতা মেলে। বাসার অনেক কাজ শুধু তাকেই করতে হয়। এই যেমন শুক্রবারে ভাইবোন সবাই যখন ঘরে বসে টিভিতে পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি দেখছে, তখন তাকে যেতে হচ্ছে আটাকলে গম ভাঙাতে, ঘাড়ে করে প্রায় ১০ সের ওজনের টিন নিয়ে অনেক দূর হেঁটে যেতে হয়। বৃষ্টি এলে রোদে শুকোতে দেওয়া কাপড়, লাকড়ি, আচারের বয়াম এসব দ্রুত তাকেই তুলতে হয়। সন্ধ্যার সময় দরজা-জানালা বন্ধ করা, মশা তাড়ানোর জন্য ধুপ জ্বেলে সারা বাসায় ধোঁয়া ছড়ানো, হাঁস-মুরগি খোঁপে তোলা, ছাগল খোঁয়াড়ে গেলে তাকে ছাড়িয়ে আনা, সকালবেলা অঞ্জলির মার বাড়ি থেকে নাশতার জন্য মুড়ি কিনে আনাÑসব। অবশ্য মাঝে মাঝে তার পিতা খেপে যেতেন, বলতেন, কেন সে একা সব করবে, বাকিরা কোথায়? আজ থেকে আমি ওর সব কাজ করব। তখন ছেলেটির মন ভালো হয়ে যায়, নিজেকে কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে বলে মনে হয় না!
সে সব সময় রুটিন মেনে চলে। তার মা এ ব্যাপারে কঠিন। কড়া শাসনের মধ্যে সন্তানদের রাখেন। আসরের নামাজ পড়ে খেলতে যাওয়া, মাগরিবের আগে বাসায় ফেরা। রাত নয়টা পর্যন্ত স্কুলের পড়া, তারপর খাবার, তার এক মিনিট আগে বা পরে নয়!
বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে ডিসেম্বর মাস পুরোটাই স্কুল বন্ধ থাকে। শুকনো মৌসুম। খেলার মাঠের পাশে একটা ডোবা। সেই ডোবায় পানি অনেকটা কম। ছোট ছোট মাছ কিলবিল করে! পাড়ার ছেলেরা খেলা বাদ দিয়ে প্রায়ই মাছ ধরতে নামে। তারও খুব ইচ্ছে করে সেও মাছ ধরবে। কিন্তু মায়ের কড়া শাসন উপেক্ষা করার উপায় নেই! শিশুমন বাধা মানে না। একদিন সেও নেমে পড়ে। সবার মতো সেও অনেকগুলো মাছ ধরে ফেলে। টেংরা, পুঁটি, খৈলসা, টাকি, ভেটকি মাছ আরও কত! কখন যে মাগরিবের আজান হয়, খেয়াল থাকে না! তার বুক কেঁপে ওঠে! আজ নির্ঘাত মায়ের হাতে মার খেতে হবে! সারা গায়ে কাদা মাখা। দুরুদুরু বুকে বাসার গেটে এসে দেখে, মা বেত হাতে দাঁড়িয়ে! কোথায় ছিলি? রৌদ্রমূর্তি মায়ের প্রশ্ন! ‘ও, মাছ মারতে গেছিলা! বাসায় আসছিস কেন? মাউচ্ছা পাড়ায় যা’, বলেই মা তাকে নৃশংসভাবে বেত দিয়ে পেটাতে থাকেন।
মাকে তখন পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম মা বলে মনে হয় তার। সে যে কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে, আরও একবার প্রমাণ পায়! চিৎকার দিয়ে কাঁদতে থাকে, আর জীবনে এ কাজ করবে না বলে মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করে। বড় কচু পাতায় সযতনে জমা করে রাখা মাছ মা হেঁচকা টান দিয়ে নিয়ে বলেন, আমার ‘মাউচ্ছা পোলা’ তার মার জন্য মাছ মেরে আনছে! সব মাছ আমি বিড়ালরে খাওয়ামু! একসময় মারা বন্ধ হয়। সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কলতলায় গিয়ে গোসল করে। মাগরিবের নামাজ পড়ে পড়ার ঘরে গিয়ে ঝিম মেরে বসে থাকে। রাতে মা তাকে খেতে ডাকেন, কইরে আমার ‘মাউচ্ছা পোলা’, আয় খেতে আয়। তোর পড়ালেখার দরকার নাই, আমারে মাছ মাইরা খাওয়াইবি! মৎস্য মারিবে খাইবে সুখে। রান্নাঘরের মেঝেতে তাকে পাটি পেতে খেতে দেওয়া হয়েছে। সে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করল, তার প্লেটে ধোঁয়া-ওঠা ভাতের সঙ্গে মাছ ভাজি। বুঝতে পারে তারই ধরে আনা মাছ! চারদিক কেমন ম-ম করছে সেই ভাজা মাছের ঘ্রাণে! সাবধানে কাঁটা বেছে খাবি! তার মা তাকে বললে সে বলে, আমি এখন মাছের কাঁটা বেছে খেতে পারি, মা! কোনো অসুবিধা হয় না। বড় হয়েছি না! তার বুকে এখন ভরসার জল যেন ঢেউ খেলছে! সে কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে নয়, মায়ের ‘কালামানিক’, এটাই সত্য। আড়াল চোখে মা লক্ষ করলেন, তার ‘কালামানিক’ কী সুন্দর করে কাঁটা বেছে বেছে খাবার মুখে নিচ্ছে! এই দৃশ্য দেখে তার চোখ অশ্রুসজল হলো। কেন যে এত মারলাম? একবার ইচ্ছে করল ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে কিন্তু তা করলেন না, শাসনটা অটল থাকুক। তার ছেলে যে মার খাওয়ার কথা একেবারেই ভুলে গেছে, সেটা তিনি বুঝতেই পারলেন না!
‘কালা মানিকে’র বিশ্বাস, তার মা ছাড়া পৃথিবীর কেউ এত স্বাদের মাছভাজি করতে পারবে না! মায়ের হাতের সেই ভাজা মাছের ঘ্রাণ, স্বাদ আজও সে খুঁজে বেড়ায়। আজও সেই স্মৃতি মনে করে চোখ ঝাপসা হয়, নিজের অজান্তেই মন বলে ওঠে, ‘অন্তরে মা থাকুক মম ঝরুক স্নেহরাজি।’