কাজী রুহুল আমীন
১৩৪২ থেকে ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দ, ইলিয়াস শাহের রাজত্বকাল। ১৩৫৭ খ্রিস্টাব্দে, তার শাসনামলেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঙ্গরাজ্যসমূহ একত্রিত করে প্রথম একক স্বাধীন বাংলা রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ঢাকা, বাংলার প্রথম রাজধানী। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে মুঘল শাসনামলে বাংলা (পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ), বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, ত্রিপুরা- সম্মিলিত প্রদেশকে প্রথম ‘সুবে বাংলা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। অন্য কথায় বৃহত্তর বাংলার সূচনা, অর্থাৎ বৃহত্তর বাংলার সুপ্রভাত!... কলিকাতা নয়, বরং সহস্র বছর ধরে বৃহত্তর বাংলার রাজধানী ঢাকা, তার পরিচয় ও পরিচিতি অতিপ্রাচীন, প্রসিদ্ধ, ঐতিহ্যময় এবং ঐতিহাসিক!...
১৪৯৩ থেকে ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দ, আলাউদ্দিন হোসেন শাহের রাজত্বকাল। তার শাসনামলেই মূলত বাংলা ভাষাকে প্রথম ‘রাজকীয় ভাষা’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এক কথায় বৃহত্তর বাংলা, রাজকীয় বাংলা ভাষার গুরুত্ব তাৎপর্যপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক। তাই প্রাচীন প্রবাদ রয়েছে- What Bengal thinks today, British thinks tomorrow অর্থাৎ আজ বাংলা যা ভাবছে, বৃটিশ ভাবছে আগামীকাল!
বাঙালি জাতির আদি পথচলা ১৮০ থেকে ৩২০ খ্রিষ্টপূর্ব, অর্থাৎ মৌর্য্য সাম্রাজ্য থেকেও প্রাচীন। বাংলা ভাষার গঠনমূলক পথচলা চর্যাপদ থেকে শুরু। বাংলা ভাষা ৩,৫০০ বছরের বেশি প্রাচীন। বাঙালি জাতির ইতিহাস ইলিয়াস শাহ সাম্রাজ্য, মুঘল সাম্রাজ্য, বৃটিশ সাম্রাজ্য থেকেও অনেক প্রাচীন। ১৬২২ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বৃটিশরা পাক-ভারত উপমহাদেশ শাসন করে। তদানীন্তন পাক-ভারত উপমহাদেশে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং শহীদ হোসেন শহীদ সোহওয়ার্দী। এরা বাঙালি!...
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষে বৃটিশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। ফলে ১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত- দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের দুটি অংশ- পশ্চিম পাকিস্তান, ভারতের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। পূর্ব পাকিস্তান, ভারতের পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত। পশ্চিম পাকিস্তানে আঞ্চলিক ভাষা- পাঞ্জাবি, উর্দু, সিদ্ধ, বেলুচি, ইত্যাদি। পূর্ব পাকিস্তানে সামগ্রিক ভাষা বাংলা! চট্টগ্রাম, সিলেট, নোয়াখালী কিঞ্চিত আঞ্চলিক ভাষার স্বরধ্বনী আছে। কিন্তু গোটা পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্র কিংবা জাতীয় ভাষা নিরঙ্কুশ বাংলা। বলা বাহুল্য পাকিস্তান স্বাধীন হবার পর তদানীন্তন পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লর্ড কার্জন হলে এসে দ্ব্যর্থ কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন,Urdu, and only Urdu shall be the state language of Pakistan!
পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা মাতৃভাষা বাংলা রক্ষা করার জন্য প্রতিবাদ, মিছিল করে। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নূরুল আমিন গুলি করার নির্দেশ দিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত এতে শাহাদাৎ বরণ করেন। সেদিন ছিল ১৯৫২ সাল, ৮ই ফাল্গুন (২১শে ফেব্রুয়ারি)। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদের আগুন জ্বলে উঠলো।
আব্দুল গাফফার চৌধুরী লিখলেন-
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো
একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি!’
সালাম, জব্বার, বরকত, রফিক বুকের তাজা রক্ত ঢেলে পবিত্র মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষা করলেন। বাংলা পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো। রেডিও-টেলিভিশনে বাংলা সংবাদ প্রচারিত হতে লাগলো।
বলা বাহুল্য প্রবাসে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা থেকে নিয়মিত বাংলা সংবাদ প্রচারিত হতে লাগলো। সরকার কবীর উদ্দিন ভয়েস অব আমেরিকা থেকে বাংলা সংবাদ পাঠ করতেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯০টি ভাষায় গবেষণা এবং চর্চা করা হয়। বাংলা তাদের অন্যতম! গোটা বিশ্বে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র বলতে বিশ্ববাসী বাংলাদেশকেই জানেন!
পশ্চিম পাকিস্তানে চারটি প্রদেশ। পূর্ব পাকিস্তানে একটি প্রদেশ। সমগ্র পাকিস্তানে মোট পাঁচটি প্রদেশ। পূর্ব পাকিস্তানে পাটজাত দ্রব্য, কৃষিজাত দ্রব্য, সিরামিকজাত দ্রব্য, চা, ওষুধ ইত্যাদি থেকে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার একটি সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেতো! পাকিস্তানে সড়ক-মহাসড়ক ঢেলে সাজানো হলো। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ করাচিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিধায়, তিনি পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতেই করলেন। ষাট দশকে পাকিস্তানি জেনারেল ফিল্ড মার্শাল আইউব খান সামরিক আইন জারি করে ১০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামবাদে স্থানান্তরিত করেন। ইউরোপীয়ান স্টাইলে সড়ক, মহাসড়ক, নতুন রাজধানী ঢেলে সাজালেন! অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান বঞ্চিত-অবহেলিত বয়ে গেলো! পাঁচ প্রদেশকে ন্যায্য এবং সমতার ভিত্তিতে একইভাবে গড়ে তোলার জন্য ‘ছয় দফা’ আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানে জোরদার হলো। মূলত এই আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নিলো। দাবি উঠলো, পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন দিতে হবে। সুদীর্ঘ ২২ বছর ধরে পাকিস্তানি সেনা ক্ষমতায় বসে ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টো নির্বাচনের স্বপক্ষে দাবি তুলনে। তদানিন্তন পাকিস্তানের জেনারেল ইয়াহিয়া খান সমগ্র পাকিস্তানে ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন দিলেন। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয় এবং নিরঙ্কুশ বিজয়ী হয় পূর্ব পাকিস্তানের শেখ মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগ। ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন! জুলফিকার আলী ভুট্টো এতে বেঁকে বসলেন!
শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ ওয়ালী খান, গফ্ফার খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রমুখের সঙ্গে আলোচনা করেন সরকার গঠণ নিয়ে। জুলফিকার আলী ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানে এলেন। আলোচনা দীর্ঘ করলেন। অন্যদিকে অতি গোপনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনী, নৌবাহিনী যুদ্ধজাহাজ ভর্তি করে পূর্ব পাকিস্তানে নোঙর করে। ভয়ঙ্কর পাকিস্তানি জেনারেল টিক্কা খানকে নিয়ে আসে পূর্ব পাকিস্তানে। টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানে টিক্কা খান সড়ক তৈরি করেন। টিক্কা খান ঘোষণা দিলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ চাই না, বাংলাদেশের মাটি চাই!’
প্রবীণ জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিত্তরে বললেন, “টিক্কা খান, বাংলাদেশের মাটিতে তোমার ‘কাবাব’ বানানো হবে!”
২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। ছয় দফা আন্দোলন, রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে পৈশাচিক ধর্ষণ কার্যক্রম চালানো হয়। রাজনৈতিক আন্দোলন স¦াধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। মওলানা ভাসানী বললেন, মুজিব, ছয় দফা নয়। এক দফা, স্বাধীনতা!’ তদানীন্তন রেসকোর্স (বর্তমানে সোহওয়াদী উদ্যান) ৬০ লক্ষ জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন, ‘...এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম! এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম!’...
বাংলাদেশ নিয়মিত সৈন্য বাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলস, বাংলাদশ মুক্তি বাহিনী সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। লক্ষাধিক তাজা প্রাণ বির্সজন দেয় মুক্তিযুদ্ধে। প্রায় সুদীর্ঘ কৌশলগত মুক্তিযোদ্ধার কাছে পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনী পরাজয় বরণ করে ৯ মাস পরে! এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশিরা বিশ্বে নতুন মানচিত্র স্থাপন করে, বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র!...
বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। তেমনি পৃথিবীও প্রতিদিন পরিবর্তন হচ্ছে। সহস্র কোটি বছর পূর্বে যেখানে উত্তাল জলরাশি ছিল, আজ সেখানে ভূ-স্তর সৃষ্টি হয়েছে। ঠিক তেমনি, সহস্র সহস্র কোটি বছর পূর্বে জলরাশি থেকে জেগে ওঠা ব-দ্বীপ থেকে আজকের বাংলাদেশ! ব-দ্বীপের অধিবাসীদের ‘বঙ্গাল’ বলা হতো, ‘বঙ্গাল’ থেকে ‘বাঙালি’। ‘বাঙালি’ থেকে আজ ‘বাংলাদেশি’!
ঠিক তেমনি, বঙ্গালাদের ছিল গোত্রীয় ভাষা। গোত্রীয় ভাষা থেকে আঞ্চলিক ভাষা। আঞ্চলিক ভাষা থেকে জাতীয় ভাষা। জাতীয় ভাষা থেকে আন্তর্জাতিক ভাষা। আন্তর্জাতিক ভাষা থেকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত ভাষা। একটি জাতির পরিচিতি এবং ভাষা একটি সুদীর্ঘ প্রক্রিয়া। শতাব্দী শতাব্দী ধরে, সহস্র-কোটি বছর ধরে পথচলার পরে, একটি জাতি এবং তার ভাষা আপন পরিচিতিতে ভাস্বর হয়ে ওঠে! আপন সত্ত্বায় বিকশিত হয়। নিজস্ব পরিচয়ে পরিচিত হয় গোটা বিশ্বে!
১৩৪২ সাল। ইলিয়াস শাহের রাজত্বকাল। ১৩৫৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, ত্রিপুরা নিয়ে সম্মিলিত প্রদেশ গড়া হয় প্রথম বৃহত্তর স্বাধীন বাংলা রাজ্য। ঢাকা বাংলার প্রথম রাজধানী! ১৪৯৩ সাল। আলাউদ্দিন হোসেন শাহের রাজত্বকাল। মূলত তার শাসনামলেই বাংলা ভাষাকে প্রথম ‘রাজকীয় ভাষা’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। অন্য কথায় বাঙালি জাতি এবং বাংলা ভাষার ইতিহাস এবং ঐতিহ্য অতি প্রাচীন ও ঐতিহ্যময়, সে কথা বলাই বাহুল্য। বাংলা ভাষার প্রথম পদচারণা শুরু হয় প্রায় ৪০০০ বছর পূর্বে। গঠনমূলক পথচলা চর্য্যাপদ আমল, অর্থাৎ ৩,৫০০ বছর ধরে। সময়ের প্রেক্ষাপটে পৃথিবী বদলে গেছে। স্বাধীন একক স্বাধীন বাংলা রাজ্য হারিয়ে যায়। বলা বাহুল্য আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হারিয়ে যাওয়া একক স্বাধীন বাংলা রাজ্যের প্রতিচ্ছবি! ইংরেজি প্রাচীন প্রবাদ History repeats itself, অর্থাৎ ইতিহাস বারে বারে ফিরে আসে। গোটা বিশ্বে একমাত্র স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র বলতে বিশ্ববাসী বাংলাদেশকেই জানে!
প্রখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথিবীর ৯০টি ভাষায় চর্চা, গবেষণা, অনুশীলণ করা হয়, তন্মধ্যে বাংলা ভাষা অন্যতম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বে প্রথম বাংলা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বে বাংলাদেশের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে পরিচিত করেন। লন্ডন যাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অর্থাৎ স্ট্যাচু রক্ষিত আছে!
ভারত বর্ষে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃত ভাষা ১৭টি, তন্মধ্যে বাংলা ভাষা অন্যতম। ভারতের জাতীয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ভারতের জাতীয় সংগীত রচনা করেন। তিনি বিশ্বের দূর্লভ সম্মান নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। তিনি একজন বাঙালি। অমর্ত্য সেন (অর্থনীতিতে) নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। তিনি একজন বাঙালি। সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে হলিউডে ‘অস্কার’ দুর্লভ সম্মান অর্জন করেন। তিনি একজন বাঙালি। বিশ্বে ১০০টির উর্ধ্বে অন্তর্জাতিক স্বীকৃত ভাষা, তন্মধ্যে বাংলা ভাষার স্থান সপ্তম! তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, ভারতবর্ষে কোনদিন বাঙালি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে?