কাওসার পারভীন চৌধুরী
নরম পর্দার ফাঁকে জানালা গলিয়ে যতদূর চোখ যায়Ñ কী এক বর্ণিল নিস্তব্ধতার ভেতরও বুঝি সীমাহীন সৌন্দর্য্য চোখ জুড়ায়।
রাতের আমেরিকা। প্রকৃতির ঋতুর বৈচিত্র্যে চারিদক যখন অপূর্ব সবুজাভে সুশোভিত, ‘এ ফ্রন্ট ইয়ার্ড ইজ এ গেইট অব মাইন্ড’Ñ আমেরিকানরা বুঝি এ কথাটা অক্ষরে অক্ষরে পালণ করে। তাই প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনে জানালায়-দরজায় শোভিত কী অসাধারণ ফুলেল সামগ্রী। অভিনব দৃষ্টিনন্দন শোপিস। বাড়ির সামনে বাগান ভর্তি বর্ণিল ফুল। আর বাইরে কী মায়াময় প্রকৃতির সবুজাভের সারি পথের দুই প্রান্তে।
সুদীপা জানালার পর্দার ফাঁকে দৃষ্টি গলিয়ে যেন ঠিক চাঁদের ধায় মুখোমুখি দাঁড়ায়। ঠিক এই সময়ে সম্মুখস্থ রাস্তা দিয়ে সাঁই করে একটি গাড়ি চলে যায়। হয়তো সদ্য বয়স আঠার অতিক্রম করা কোন মাতাল যুবক। অবাধ স্বাধীনতার জীবনকে হাতে পেয়েছে মাত্র। দেহভরা যৌবন অচিন্তনীয় আবেগী মন। ঘরের কোন টান নেইÑ মায়া নেই। পরিবারের ছায়া নেই, শাসন করারও কেউ নেই। তাই বুঝি আজ অবাধে বিকট শব্দে গান বাজিয়ে খুচরো আনন্দে জীবনকে উপভোগ করছে।
হয়তো কোন অপরিণত বয়স্কা সিঙ্গেল মাদারের অনাকাক্সিক্ষত সন্তান সে। কেউ তাকে ফেলে গেছে কোন স্বেচ্ছাসেবী অরফান প্রতিষ্ঠানে। ওরাই এভাবে কেউ কেউ অকারণে বেহিসাবে জীবনটা ফুরিয়ে ফেলে।
এরপর মধ্যবয়সে এসে আর খুঁজে পায় না বেঁচে থাকার কোন সুমসৃণ হিসেবী পথ। কঠিন শীতার্থে জুবুথুবু হয়ে আশ্রয় নেয় খোলা আকাশের নিচে পথে-প্রান্তওে, রেলের বগিতে কিংবা কারো বাড়ির সিঁড়িতে।
আবার কেউ বা সারাদিন কাজ করে রাত গভীরে বাড়ি ফিরে অগাধ ক্লান্তিতে। কঠিন দুর্গম জীবনের পথ বেয়ে চলে মগজের পরতে পরতে ভাঁজ খুলে আহরণ করে তত্ত্ব-উপাত্ত্ব। অবাধ স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে গড়ে। সঠিক পূর্ণ চিন্তা-ধারায় মগজ আর পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে সংযোজন করে কোন গবেষণাগারে কিংবা মহাকাশকেন্দ্রে। এভাবে বেঁচে থাকে আমৃত্যু পৃথিবীজুড়ে বই-পুস্তকে। মানুষের মননে।
ঐ দূরে চোখ যায় এবার সুদীপার। আকাশ-ছোঁয়া বিল্ডিং সারি সারি যেন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদিতার প্রতীক হয়ে বুক টান করে দাঁড়িয়ে।
জানালা ঘেঁষে সংলগ্নেই হাসপাতাল। এই রাত গভীরেও কটকটে আলো জ্বলছে ভেতরে। নব্বই ফুরিয়ে যাওয়া ক্রনিক রোগে আক্রান্ত কোন বৃদ্ধা এখনো বুঝি বিছানায় শুয়ে শুয়ে থেকেও বেঁচে থাকার প্রহর গুণে।
হায় জীবন!
কেউ কেউ অকারণে জীবন ফুরায়, আর কেউ বা কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েও প্রাণপণে বেঁচে থাকার জন্য স্বপ্ন সাজায়।
কলিংবেলের শব্দে সুদীপা এবার সচকিত হয়। এই মধ্যরাতে নিশিতা ঘরে ফেরে সবে।
নিশিতা আবাল্য সঙ্গী সুদীপর। বাংলাদেশে সংসার, ছেলে-মেয়ে-স্বামী রেখে নিউইয়র্কের ফোবানা সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছে কোন এক সরকারি কর্মকর্তার সাথে।
রোজ বেরিয়ে যায় সেই সাত সকালে, ফিরে এই মধ্যরাতে।
সুদীপা সব বোঝে, কিন্তু না বোঝার ভান করে থাকে। দু’দিন পরেই চলে যাবে নিশিতা, তাই আর কিছু বলে না।
সুদীপা দরজা খুলে দিতেই খিলখিল বাঁধভাঙা হাসিতে ফেটে পড়ে নিশিতা।
-আরে এই রাত-দুপুরে ভুল করে পাশের বাড়ির গেটে গিয়ে কলিংবেল টিপতে শুরু করেছি! তোদের এরিয়ার সবগুলো বাড়ির ডিজাইন এক রকম। একই কালার, শেড, দরজা-জানালাÑ এমন কি বাইরের গেটখানাও একই রকম! পরে এক বিদেশি ভদ্রলোক এসে দরজা খুলে বলেÑ রং এন্ট্রেস, মে বি নেক্স ডোর। দেখতো কী কাণ্ডটাই না করলাম! আসলে ড্রাইভারটাই ভুল করেছে সঠিকভাবে নম্বরটা না দেখেই আমাকে ও বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়েছে।
-ড্রাইভার কেনো! তোর সচিব আসেনি আজকে?
সুদীপার এ কথায় দপ করে যেন নেভে যায় নিশীতা! বলে
-সচিবের বউ-পোলাপান এসেছে আজ বাংলাদেশ থেকে। লং-আইল্যান্ডে বাড়ি কিনেছে। পোলাপান ভর্তি করবে আমেরিকায়। আজ দুপুরে আমাকে লং-আইল্যান্ড নিয়ে গিয়েছিল বাড়ি দেখাতে। ছবির মতোন বিরাট বাড়ি। সামনে বাগান, গাছ-গাছালি। বউয়ের নামে সব।
বলেই মুখটা অসম্ভব রকমের ভোঁতা করে ফেলে নিশিতা।
সুদীপা প্রসঙ্গ পাল্টাতে চায় এবার। বলে
-চল ভাত খাবি। কয়েক রকমের ভর্তা করেছি আজ, সাথে সালমন ফিস ও অক্টোপাশ। তোর তো একবেলা ভাত না হলে চলে না।
নিশিতাও পাল্টে যায় এবার পূর্বের অভিব্যক্তি থেকে। বলে
-আসলেই তোদের আমেরিকার ফার্মের মুরগি আর পাউরুটি দিয়ে কী যেন বার্গার-স্যান্ডউইচ আর কীসব হাবিজাবি শাক-পাতা-সবজি, আমার গা গুলিয়ে আসে। সুস্বাদু মনে করে একটা কেক নিয়েছিলাম, তাও কাঁচা স্ট্রবেরি দিয়ে মাখানো। ওয়াক্!
- এখানে আমেরিকানরা ক্যালোরি হিসেবে করে খায়। তা ঘরে হোক, আর বাইরে হোক, কোন পার্টি অনুষ্ঠানে হোক। আমাদের বাংলাদেশের মতো ঘিয়ে ভাঁজা রোস্ট-পোলাও আর চিনির রসে ডোবানো রসগোল্লাও খায় না। আর অকারণে গজিয়ে ওঠা ভূড়ি কমানোর চিন্তায় দিন পাড় করে না। এঁদের চিন্তাধারা কোন কোন গবেষণা কেন্দ্রে কিংবা মহাকাশ কেন্দ্রে।
নিশিতা এবার বলে
- ইশ্, জন্ম থেকে যদি আমরা এ রকম আমেরিকানদের মতো সঠিক খাদ্যভাসে অভ্যস্থ হতাম!
বাকি জবাবটা এবার সদীপাই দিয়ে দেয়। বলে
-তাহলে নাসার মহাকাশ কেন্দ্র বাংলাদেশেই স্থাপিত হতো। নয় কি?
দু’জনেই হেসে ফেলে।
-চল খাবি চল। একটু পরে আবার আমার কাজে বেরুতে হবে।
সুদীপ তারা দেয় নিশিতাকে।
আচমকা নিশিতার চোখ পরে বাইরে। অবাধ জোছনার অদ্ভুত মাদকতা রঙিন পর্দার ফাঁকে চাঁদের আলো ছড়িয়ে রয়েছে সুদীপার ড্রেসিং টেবিল আর ওয়াড্রোবজুড়ে।
ফুলদানির এক পাশে সুদীপার মৃত স্বামীল ছবি। বহু আগের, প্রায় পনেরো-বিশ বছর। বেশ যত্ন করে রেখেছে সুদীপা।
ঘরদোর এই ছোট্ট পরিসরে প্রতিটি জিনিসে বুঝি যত্নে প্রাণময়তার প্রকাশ পায় সুদীপার।
নিশিত প্রশ্ন করে
-এতো রাতে তুই জেগে কী করছিল?
-আজ যে জোছনা, তাই চাঁদ দেখছি। ফুল দেখছি, আর বসন্তকে উপভোগ করছি।
নিশিতা অবাক হয়। বলে
-এই বয়সেও তোর এসব ভালো লাগে! আমার কখন যে রাত, কখন যে দিন, চাঁদ, কি বৃষ্টিÑ সব ভুলেই গেছি। ছোট্টবেলায় যখন কবিতা লিখতাম, তখন এসব ভালো লাগতো।
-আমার এখনো চাঁদ-বৃষ্টি-কবিতা ভালো লাগে। আমি কাজ আর কাজের বাইরে এসব নিয়েই থাকি। চাঁদের দিকে তাকিয়ে, একটা ফুলের দিকে তাকিয়ে আমি আজও ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাড় করে দিতে পারি মহানন্দে!
-আমি পারি না কেনো সুদীপা!
-তুই? তুই-তুই তো আর তোর মাঝে নেই! তুই হারিয়ে গেছিস কোন এক জটিল জীবনের আবর্তে।
আচমকা নিশিতার মোবাইল ফোনটি বেপরোয়াভাবে বাজতে থাকে। যেনো নিশিতাকে রিসিভ করতেই হবে। না করলে উপায় নেই। নিশিতার মুখেভঙ্গি দেখে আঁচ করতে পারে সুদীপা।
-কে, সচিব?
নিশিতা চোখ নাড়ে কিন্তু মুখখানিতে অসম্ভব রকমের কালো ছায়া নামে। সুদীপা ইচ্ছে করে কিচেনের দিকে চলে যায়, কিন্তু কর্ণ তার সজাগ। -না না, তোমার বউ-পোলাপান নিয়ে কিছু বলতে পারবো না। আর আমার স্বামী-সংসার? আমার আট মাসের বাচ্চাটাকে রেখে তোমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য আমাকে ছুটতে হয়েছে দেশ-বিদেশে। এতোগুলো বছর আমি মুখ বুঝে সহ্য করেছি...
হয়তো টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে জ্বালাময়ী বক্তব্যের বিষাক্ততায় নিশিতা এই ক্ষণে উত্তাল হয়ে উঠে, চেঁচিয়ে উঠে সে
-হ্যাঁ হ্যাঁ, ফোবান সম্মেলনে আমার পার্টিসিপেন্ট, জামানোর ডমেন ডেভোলপমেন্ট সেমিনারে পার্টিসিপেন্ট সবগুলি তোমার অবদান। দেশ-বিদেশের অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত আমার জীবন। কিন্তু আমার মন একটা মিথ্যা সম্পর্কে কাটিয়ে দিলাম সারাটা জীবন। সবাই আমার হাতে পুরস্কার তুলে দেয়, কিন্তু পেছনে কী বলে গালি দেয়, জানোÑ ‘খানকী’!
বলতে বলতে বেদিশায় কান্নায় ভেঙে পরে নিশিতা। বেসামলে হাত থেকে সশব্দে পরে যায় মোবাইলটি।
সুদীপা ছুটে এসে পাশে দাঁড়ায়। অঝোরে কাঁদছে নিশিতা।
মাটিতে আঁচড়ে পড়া মোবাইলটি তুলে নিতে গিয়ে অপর প্রান্তের শব্দ কানে বাজে সুদীপার
-তুই তো খানকীই মাগী...!
সুদীপা ইচ্ছে করে সুইচ টিপে বন্ধ করে ফোনটা। তারপর আলতো হাত রাখে নিশিতার মাথায়।
জীবনের খরতাপে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে সুদীপার এতটুকু স্নেহাস্পর্শে বিগলিত হয়ে ওঠে নিশিতা।
বাঁধভাঙা জোয়ারের মতা সে অকপটে বলে যায় নিজের ক্লেদাক্ত জীবন কাহিনী। সেই ফ্রকপরা ছোট বালিকাটির মতো আগে সৎ মায়ের সংসারের গল্প। আর এখন নিজের অথর্ব স্বামী আর সন্তানের স্বপ্নময় ভবিষ্যতের গল্পÑ সবটুকুতে জুড়ে থাকে নিশিতার অনৈতিক আর কষ্টের দগদগে জীবন।
সুদীপার গভীর মায়া হয় নিশিতার প্রতি। সে কঠিন গলায় জানান দেয়
- তুই আর দেশে ফিরে যাবি না নিশু?
এ কথায় বিকৃত শব্দে হেসে উঠে নিশিতা।
- তাহলে সচিব আমাকে পেলে মেরেই ফেলবে। তার অনেক ব্যাংক একাউন্ট আমার নামে। যেগুলো দিয়ে সে বিদেশে টাকা পাচার করে।
-তুই সব ছেড়ে দিবি। আমেরিকায় কেউ তোকে মারতে পারবে না। এখানে তুই এসাইলাম নিবি। আমার কাছে থাকবি। বৈধ কাগজপত্র বানাবি, তারপর কাজ করবি। একটা শুদ্ধ জীবন তুই উপভোগ করবি। তোর সংসারটা তুই শুদ্ধভাবে চালাবি।
-কিন্তু যে নারী একবার খারাপ পথে যায়, সে কি ফিরতে পারে?
-কেন নয় নিশিতা! মানুষ যদি ক্যানসার সারভাইড করে পুনরায় জীবন শুরু করতে পারে, তাহলে সৎ আর অসৎÑ এ বায়বীয় শক্তিটি থেকেও মানুষ সুন্দর-সঠিক পথে এসে পুনরায় জীবন চালাতে পারবে না!
-কিন্তু, সমাজ?
-সমাজ মানুষের সৃষ্টি। দোষ করেছিস দু’জনে। তুই আর সচিব। সে পুরুষ বলে সে নির্দ্ধিধায় গলায় টাই ঝুলিয়ে বুক টান করে ঘুরে বেড়াবে, আর তুই নারী বলে সমস্ত অপবাদ মাথায় নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরবি? কেনো? তোর জীবনটা একান্তই তোর। তুই কিভাবে খরচ করবিÑ এটা সম্পূর্ণই ডিপেন্ড করছে তোর উপর। আগে বেহিসাবে নিজেকে খরচ করে ফেলেছিস ভুল করে। এখনোতো বাকি আছে কিছু। এবার সঠিকভাবে খরচ কর। ধর তোর কোন জটিল রোগ হয়েছিল, ক্যানসারÑ তুই সারভাইড করে গিয়েছিস। কিংবা আরো সহজ করে বলিÑ ভুল করে, কিংবা শখ করে তুই একটা দামি শাড়ি কিনে ফেলেছিস অর্ধেক জীবনের দামে। এবার খচরে কিছু বাকি রয়েছে জীবনের অংশ, তা দিয়ে আস্তে আস্তে খরচ করে সুন্দর করে জীবনটা আবার সাজিয়ে নে। যতটুকু খারাপ কাজ করেছিস, তার থেকে বেশি করে ভালো কাজগুলো শুরু কর এবার।
ছোট ছোট ভালো কাজের মধ্য দিয়ে এবার ফিরে আয় নিজের মধ্যে। ঠিক তখনই দেখবি আবারো তোর চাঁদ-বৃষ্টি-কবিতা ভালো লাগবে। দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনার শঙ্কামুক্ত জীবন পেলে যতটা পারিস জীবনে এসে একটা পবিত্র ফুলের দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারবি?
জীবনের কোন এক পরিক্রমায় একজন হাত কাটা, পা কাটা মানুষ যেমন অবলীলায় পুনরায় হাত-পা ছাড়া জীবনটাকে চালিয়ে যায় স্বপ্নরাঙা করে। তেমনি তুই আবার জীবন সাজাবি এখানে তোর একাকীত্ব নিয়ে।
একটা স্বচ্ছ সাবলীল একাকীত্বকেও খন্ড জীবন চিত্রে সাজানো যায়। প্রাণভরে নিজের একাকীত্বটাকেও উপভোগ করা যায়। যদি হয় সেই একাকীত্বটা সাবলীল, স্বচ্ছ।