শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নিয়ে লেখক আহবাব চৌধুরী খোকনের ‘জিয়াউর রহমান অনন্য রাষ্ট্রনায়ক’ বইটি পড়ে আনন্দ পেলাম। বইটি অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৪-এ উৎস প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। ৩৫০ টাকা মূল্যের ৮০ পৃষ্ঠার বইটির অনন্যসুন্দর প্রচ্ছদ এঁকেছেন দেশের সুপরিচিত প্রচ্ছদশিল্পী মোস্তাফিজ কারিগর। লেখক আহবাব চৌধুরী খোকন ২০টি শিরোনামে শহীদ রাষ্ট্রপতির কর্মময় জীবনের নানা দিক পাঠকের সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। শিরোনামগুলো হচ্ছে পদ্মফুলের মতো বর্ণিল ছিল জিয়ার জীবন (পৃষ্ঠা-৯), জিয়াউর রহমান যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন (পৃষ্ঠা-১৩), মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক ও রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধা (পৃষ্ঠা-১৭), ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর ও জিয়ার উত্থান (পৃষ্ঠা-২০), বিএনপির জন্ম ও রাজনীতিতে জিয়ার অভিষেক (পৃষ্ঠা-২২), বাংলাদেশি সংস্কৃতির জাগরণে শহীদ জিয়ার অবদান (পৃষ্ঠা-২৬), যুবসমাজ ও শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে জিয়া (পৃষ্ঠা-২৯), নারী সমাজের ক্ষমতায়নে জিয়ার অবদান (পৃষ্ঠা-৩৩), আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নে জিয়ার অবদান (পৃষ্ঠা-৩৬), কৃষি বিপ্লবের জনক জিয়া (পৃষ্ঠা-৩৯), মুক্ত তথ্যপ্রবাহ উন্মুক্ত করেছিলেন জিয়া (পৃষ্ঠা-৪৩), শিক্ষাক্ষেত্রে জিয়ার যুগান্তকারী পদক্ষেপ (পৃষ্ঠা-৪৭), স্বনির্ভর বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা (পৃষ্ঠা-৫০), একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক (পৃষ্ঠা-৫৪), শহীদ জিয়ার ১৯ দফা ও তুলনামূলক মূল্যায়ন (পৃষ্ঠা-৫৭), দূরদর্শী ও বিচক্ষণতায় জিয়া (পৃষ্ঠা-৬১), বহুদলীয় গণতন্ত্রের রূপকার জিয়া (পৃষ্ঠা-৬৫), বিশ্বনেতাদের চোখে জিয়া (পৃষ্ঠা-৬৮), আমার স্মৃতিতে জিয়া (পৃষ্ঠা-৭১) ও আরেকজন জিয়াউর রহমান চাই (পৃষ্ঠা-৭৫)।
লেখক আহবাব চৌধুরী তার এসব শিরোনামের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জীবনের নানা দিক তুলে ধরেছেন তার অসাধারণ রচনাবলির মধ্য দিয়ে। আমরা তার বইটি পাঠ করে একজন জিয়াউর রহমানের শৈশব ও কৈশোর, ছাত্রজীবন, সৈনিক জীবন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকাসহ জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি দেশের উন্নয়নে তার নানা পদক্ষেপের সচিত্র প্রতিবেদন খুঁজে পাই। একজন সচ্চরিত্র, দেশপ্রেমিক ও মানবিক গুণের অধিকারী জিয়াউর রহমানের জীবনপাঠ করে, বিশেষ করে এই সময়ের তরুণ নাগরিকেরা উপকৃত হবে বলে আমি মনে করি। যদিও আমি মনে করি, জিয়াউর রহমানের আরও অসংখ্য কর্মকাণ্ড রয়েছে, যা এই সীমিত আয়োজনের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণভাবে উঠে আসেনি। তবে লেখক আহবাব চৌধুরী খোকন তার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে একজন সফল রাষ্ট্রনায়কের কর্মময় জীবনের যতটুকু তুলে পাঠকের নজরে উপস্থাপন করেছেন, সেটিও অতি মূল্যবান এবং গুরুত্ব বহন করে নিঃসন্দেহে। তা ছাড়া এই বৈরী সময়ে লেখক আহবাব চৌধুরী খোকন ও প্রকাশক মোস্তফা সেলিমের এই সাহসী উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। এখানে দুটি রচনার অংশবিশেষ মুদ্রিত হলো :
১. রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে দেশে কর্মহীন যুবসমাজ ও শ্রমজীবী মানুষ সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে। আজকের রফতানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প জিয়াউর রহমানের শাসনামলে প্রথম যাত্রা শুরু করেছিল। এখন এই শিল্প বাংলাদেশ নারী শ্রমিকদের কর্মসংস্থানে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে। ১৯৭৮ সালের ৪ জুলাই বাংলাদেশি উদ্যোক্তা নুরুল কাদের খান দক্ষিণ কোরীয় শিল্পগ্রুপ দেইউ-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে প্রথম শতভাগ রফতানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা ‘দেশ গার্মেন্টস’ প্রতিষ্ঠা করেন। উভয়পক্ষে গৃহীত চুক্তি অনুযায়ী আঙিনা ১৩০ জন তরুণ-তরুণীকে দক্ষিণ কোরিয়া পাঠিয়ে এজন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। সেখান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দেশে এসে তারা তৈরি পোশাকশিল্পের কাজ শুরু করে। প্রথম এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশে তৈরি পোশাকশিল্পের ভিত রচিত হয়েছিল। দক্ষিণ কোরিয়া শিল্পগ্রুপ দেইউ-এর তৎকালীন চেয়ারম্যান কিম উ-চুং এর সঙ্গে দেশ গার্মেন্টসের মালিকের যোগসূত্র স্থাপনে স্বয়ং জিয়াউর রহমান নিজে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তৈরি পোশাকশিল্প স্থাপনে শিল্প উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে তিনি এলসি প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি ১৯৭৮ সালে তৈরি পোশাকশিল্পের বিকাশের জন্য সর্বপ্রথম স্পেশাল বন্ডেড ওয়্যারহাউস স্কিম চালু করেছিলেন। এই স্কিম চালুর ফলে রফতানিকারকরা সরাসরি শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির সুযোগ পায়। বর্তমানে এই শিল্প দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে সর্বাধিক ভূমিকা পালন করছে। শিল্প-কারখানায় উৎপাদন বাড়াতে তিনি সরকারি কল-কারখানায় তিন শিফট প্রথা চালু করেন। ফলে বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। তিনি শিল্প-কারখানায় শ্রমিকদের জন্য ওভারটাইম প্রথা চালু, বেতন-ভাতা বৃদ্ধি এবং ছুটি ও বোনাসের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ট্রেড ইউনিয়ন ব্যবস্থা অধিক হারে স্বীকৃতি পেয়েছিল তাঁর শাসনামলে। (শিরোনাম : যুব সমাজ ও শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে শহীদ জিয়ার অবদান)
২. দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়নে জিয়াউর রহমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন। তিনি ভারত, জাপান, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া, ইরান, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, মিসর, কুয়েত, সিরিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, যুগোস্লাভিয়া, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, রুমানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশ সফর করে এসব দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হন। ১৯৭৮ সালে জাপানের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বাংলাদেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নির্বাচন করে এবং ১৯৭৭ থেকে জোট নিরপেক্ষ ব্যুরোর সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৭৯ সালে জেরুজালেম কমিটিতে মন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপ্রধান উভয় পর্যায়ে বাংলাদেশের নির্বাচন এবং তায়েফে ১৯৮১ সালে ইসলামি শীর্ষ বৈঠকে ৩ সদস্য ব্যুরোর সদস্য নির্বাচন এবং অন্যান্য বিশটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। দক্ষিণ এশিয়ার ৭টি রাষ্ট্রকে একত্রিত করে আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য গঠিত হয় ‘সার্ক’। সদ্য স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের জন্য নিঃসন্দেহে এটি একটি বিরল সম্মান। বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে জিয়াউর রহমানের গৃহীত পদক্ষেপ ছিল অত্যন্ত সুচিন্তিত। তাঁর কূটনৈতিক বুদ্ধিমত্তার কারণে অল্প সময়ের মধ্যে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তিনি নিজে মুসলিম বিশ্বের জনপ্রিয় নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় তাঁকে একমাত্র মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মনোনীত করা হয়। দুই পরাশক্তির দ্বন্দ্বে বিশ্ব যখন বিভক্ত, তখন তার অবস্থান ছিল নিরপেক্ষ। ১৯৭৯ সালে তেহরানে মার্কিন কর্মকর্তাদের বন্দি করা হলে একটা ভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। কূটনৈতিক কর্মকর্তাদের আটক করা হয়। এ সময় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। (শিরোনাম : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নে জিয়াউর রহমানের সাফল্য)
তা ছাড়া এই গ্রন্থের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হচ্ছে মুখবন্ধ। মুখবন্ধটি লিখেছেন প্রফেসর ড. মোর্শেদ খান। বলতে পারি, এই মুখবন্ধটির মাধ্যমে বইটির ওজন অনেকাংশ বৃদ্ধি করেছে। এখানে তার কিছু অংশ উল্লেখ করা হলো : দীর্ঘ নয় মাস রণাঙ্গনে শত্রুর মোকাবিলা করে ছিনিয়ে আনেন স্বাধীনতার লাল সূর্য। জাতিকে উপহার দেন মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ। শুধু রণাঙ্গনে নয় কিংবা সামরিক পোশাকে পেশাদারিত্বের চরম উৎকর্ষ সাধন নয়, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবেও জিয়াউর রহমান ছিলেন সাফল্যে গাথা এক স্মরণীয় ইতিহাস। তিনি বাংলাদেশকে চিনিয়েছেন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে। এখানকার মাটি ও মানুষের কথা উপলব্ধি করে গড়ে তুলেছিলেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। এ ক্ষেত্রে নতুন কুঁড়ি ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমির কথা বিশেষভাবে স্মরণ করা যায়। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারীÑএ কথা মাথায় রেখেই তিনি কর্মক্ষেত্রে নারী কোটা প্রবর্তন করেছেন। যুবসমাজকে কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষিত করার জন্য জেলায় জেলায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট।
লেখক তার বইটি উৎসর্গ করেছেন বাংলাদেশ সরকারের দুবারের প্রধানমন্ত্রী, আপসহীন নেত্রী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পত্নী বেগম খালেদা জিয়াকে।
সবিনয়ে বলতে পারি, শহীদ জিয়াউর রহমানকে যারা জানতে আগ্রহী, তারা বইটি পাঠ করে তাঁর জীবন সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানতে পারবেন। বিশেষ করে, ‘জিয়াউর রহমান অনন্য রাষ্ট্রনায়ক’ বইটি তরুণদের দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করবে বলে আমি মনে করি।
উল্লেখ্য, আহবাব চৌধুরী খোকনের আরও একাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। সে বইগুলোও পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে। আমি আশাবাদী, এ বইটিও বিদগ্ধ পাঠকের মন জয় করতে পারবে। আমি লেখক, সংগঠক, রাজনীতিবিদ আহবাব চৌধুরী খোকনের সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করি।
লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক