তখন সবেধন নীলমনি হিসেবে একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম ছিল বিটিভি বা বাংলাদেশ টেলিভিশন। ঘণ্টা হিসেবে প্রচারিত হতো অনুষ্ঠান। আজকের মতো চব্বিশ ঘণ্টা ধরে প্রচারের কোনো ধারাবাহিকতা ছিল না। ফলে দর্শকের আগ্রহও ছিল বিটিভির প্রতি। সবচেয়ে বেশি মানুষ খুশি হয়ে উঠতো যখন রমজান মাস শেষ হয়ে শাওয়ালের চাঁদ উঁকি মারতো সন্ধ্যার আকাশে। ঠিক ওই মুহূর্তে বিটিভিতে প্রচারিত হতো কাজী নজরুলের জনপ্রিয় সেই গানটিÑ ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’।
আর অবধারিতভাবে গানটি কানে যাওয়ামাত্র আমার মা মন্তব্য করতেন, ‘দেশে শুনি এখন এতো কবি-সাহিত্যিকের জন্ম হয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত একজন কবিকেও দেখলাম না নজরুলের ওই গানের মতো একটা লাইন কাউকে লিখতে।’ আমি তখন টুকটাক লেখালেখি করি। আমাকে শুনিয়েই আমার মা কথাগুলো বলছেন সেটা ভালোভাবেই বুঝতে পারার কথা। কিন্তু চুপ করেই শুনতাম। উত্তর দিতাম না তার কথার। ওই গানটার পরের লাইন ছিল ‘আপনাকে তুই বিলিয়ে দে শুন আসমানি তাগিদ’। কী গভীর তাৎপর্যময় কথা!
আসলে রমজান মাসকে বলা হয় আত্মশুদ্ধির মাস। দীর্ঘ একটা মাস কঠিন সিয়াম সাধনার শেষে ঈদ আসে মানুষের দোরগোড়ায়। ঈদ একটি আরবি শব্দ। যার অর্থ ফিরে আসা। আবার অন্যভাবে হয় ‘খুশি হওয়া’। আবার ‘রমজান’ শব্দের প্রতিশব্দ হলো ‘সিয়াম’। যার অর্থ ‘সংযম’। আসলে ক্ষুধার্থ অসহায় মানুষ কী করে দিন কাটায়, সেই উপলব্ধির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার তাগিদ থেকেই রমজান মাসের আবির্ভাব। মক্কার বির্ধমীদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে আল্লাহ্র নবী (স.) ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেছিলেন। এবং ওই সময়কালকে ধরে নিয়েই ‘হিজরী’ সাল গণনার শুরু। যদিও আনুষ্ঠানিকভবে হযরত ওমর (রা.)-এর সময় থেকে হিজরী সালের গণনাকাল হিসেবে ধরা হয়েছিল।
তবে হিজরী প্রথম বছরেই শাবান মাসে রোজা পালনকে বাধ্যতামূলক করে আয়াত নাজিল হয়েছিল। সেই হিসেবে আরবি বছরের নবম মাসকে রোজা পালনের জন্য নির্ধারিত করে দেয়া হয়। এই রমজান মাসকে অন্য আর সব মাসের তুলনায় শ্রেষ্ঠ মাস হিসেবে বিবেচিত করা হয়ে থাকে, কারণ কোরআন নাজিলের মাস হিসেবে রমজান মাসের গুরুত্বও অপরিসীম। এই মাসের মর্যাদা এতটাই বেশি যে, বলা হয়ে থাকেÑ এই মাসে একটি দানের তুলনায় অন্য মাসের চাইতে সত্তর (৭০) গুণ বেশি শওয়াব রয়েছে। রমজানের রোজা পালনের ইতিহাস তাই ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই শুরু এবং ওই ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে মদিনায় প্রথম ঈদ পালনের মধ্য দিয়ে মুসলিম উম্মা নতুন এক আনন্দ-উৎসব পালনের সুযোগ পায়। হিজরতের মধ্য দিয়ে মদিনার যে জীবন শুরু হয়েছিল নবী করিম (স.)-এর, সেই সময়ে মদিনাবাসী বছরে দু’টি উৎসব পালন করতো। একটি ছিলÑ ‘নওরোজ’ এবং অন্যটির নাম ‘মিহিরজান’। নবী এই দু’টি উৎসবকে বাতিল করে দিয়ে ‘ঈদুল ফিতর’ এবং ‘ঈদ উল আযহা’ পালনের ঘোষণা দিলে ইসলামের নতুন যাত্রার পথ প্রশস্ত হয়েছিল। এছাড়া এই রমজান মাসে ইসলামের ইতিহাসে অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটেছিল, তার মধ্যেÑ মক্কা বিজয় ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মদিনায় হিজরত করার সাত বছর তিন মাস সাতাশ দিন পরে বিজয়ীর বেশে বিনা রক্তপাতে মক্কায় ফেরৎ এসেছিলেন আল্লাহ্র নবী। একপ্রকার বিনাযুদ্ধে বিজয়ীর বেশে ১০ হাজার সেনাসদস্য নিয়ে তিনি মক্কায় প্রবেশ করেছিলেন যেদিন, সেদিন ছিল রমজান মাসের ১৭ তারিখ। ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জানুয়ারি।
দ্যা কেমব্রিজ হিস্ট্রি অফ ইসলাম গ্রন্থের তথ্যমতে, ‘মক্কা বিজয়ের মধ্যদিয়ে এই সত্যটাই প্রমাণিত হলো যে, মুসলমানদের বিরোধিতা করতে পারে এমন শক্তিশালী উপজাতি আর নেই’। এবং ওই ঘটনার পরে সমগ্র আরব বিশ্ব আল্লাহ্র একাত্ববাধকে স্বীকার করে নিয়ে ইসলামের পতাকাতলে আশ্রয় নেয়া শুরু করলো। এ সম্পর্কে সুরা আল ইমরানের ১১০ নম্বর আয়াতে স্বয়ং স্রষ্টা বলেছেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মানবতার কল্যাণের জন্য’। এই ‘মানবতার কল্যাণ’ শব্দটি জড়িয়ে আছে রমজান মাস এবং দুই ঈদ পালনের মধ্যদিয়ে। যেমন ‘সদকাতুল ফিতর’Ñ এ শব্দটির উল্টো প্রতিশব্দ হলো ‘ঈদুল ফিতর’। এটি প্রত্যেক সামর্থবান মানুষের ওপর জাকাতের মতো ফিতরা প্রদানকে ওয়াজিব হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এমন কি যে শিশুটি ঈদের দিনে জন্মগ্রহণ করেছে, তার পক্ষ হয়ে অভিভাবককে ফিতরা আদায় করার জন্যও নির্দেশ রয়েছে ইসলামে। পুরুষের মতো একজন নারীকেও তার উপার্জন না থাকা সত্ত্বেও ফিতরা প্রদানের তাগিদ দেয়া হয়েছে। এই ফিতরা হলো ৩০ দিনের রোজা পালনের সময়ে যদি কোনো ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিজের অজান্তে ঘটে থাকে, তার কাফফারা।
ইসলামের প্রথম জমানায় ফিতরা নির্দিষ্ট হতো খাদ্যদ্রব্য দ্বারা। সেই খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে খেজুর, কিসমিস কিংবা গম ইত্যাদি এক নির্দিষ্ট পরিমাণ দ্রব্য ঈদের নামাজের আগে সমাজের অসহায় মিসকিনদের হতে তুলে দেয়ার বিধান হচ্ছে ফিতরার সংজ্ঞা। উদ্দেশ্যÑ যেনো মানুষটি উপবাসে দিনটি অতিবাহিত না করে। আর আমাদের দেশীয় পদ্ধতিতে ফিতরার পরিমাণ হলো- তিন সের এগারো ছটাক, মেট্রিক পদ্ধতিতে চাল বা গমের হিসাব হলো তিন কিলোগ্রামের সমপরিমাণ। তবে এই হিসাব এখন আর প্রায় কেউই মানেন না। উল্লেখিত খাদ্যদ্রব্যের মূল্য ধরে সেই টাকাটাই আমরা দিয়ে থাকি ফিতরা হিসেবে। বাংলাদেশে তার পরিমাণ দ্রব্যের মূল্য অনুযায়ী। একইভাবে প্রবাসের জীবনেও সেই দ্রব্যমূল্যকে সামনে রেখে ফিতরার পরিমাণ নির্ধারিত হয়ে থাকে। তবে শর্ত হচ্ছে- ফিতরার অর্থটা ঈদের নামাজের আগে সমাজের নিরন্ন মানুষের হাতে তুলে দিতে হবে, যদি ওই অর্থটা নামাজের পরে কেউ বণ্টন করার কথা মাথায় রাখেন, তখন আর সেই দানটা ফিতরা হিসেবে বিবেচিত হবে না বরং সাধারণ সাদকার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে।
জাকাতও একইভাবে সামর্থবান মানুষের উপর ফরজ করে দেয়া হয়েছে। মানুষের বৈধ উপার্জন থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ দরিদ্র সম্প্রদায়ের হাতে তুলে দেয়ার নাম হচ্ছে ‘জাকাত’। ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভেও মধ্যে যাকাতের অবস্থান তৃতীয়। অর্থাৎ বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই বিবেচনায় রাখা হয়েছে। জাকাত দিলে সম্পদ কমে- এ ধারণাকে উড়িয়ে দিয়ে ইসলামী মতবাদে উল্লেখ করা হয়েছেÑ ‘জাকাত কোনো দান নয়, এটা গরিবের হক’। অর্থাৎ প্রতিজন সামর্থবানের জন্য গরিবের হক আদায়ের ওপর নির্ভর করবে তার ঈমানের পরীক্ষা প্রদানের ফলাফল। যেহেতু রমজান মাসের একটি নেকিকে অন্য মাসের তুলনায় ৭০ গুণ বেশি হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন স্বয়ং স্রষ্টা, তাই ধর্মে রমজান মাসে জাকাত আদায়ের তাগিদ রয়েছে। ইসলামী পরিভাষায় এসব অবশ্য পালণীয় বিষয়কে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সময়ের ইতিবাচক পরিবর্তনের একটি উপায় হিসেবেই রাখা হয়েছে। সে কথা প্রভু সুরা আল ইমরানে স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মানবতার কল্যাণের জন্য’।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য হচ্ছে, ‘মানবতা’ শব্দটি খাতায়-পত্রে উল্লেখ থাকলেও মানুষের হৃদয় আর তাকে ধারণ করতে পারছে না। ফলে উৎসব-সর্বস্ব হয়ে উঠছে রমজানের রোজা রাখা থেকে শুরু করে ঈদ পালনÑ। রমজান মাসের শুরু থেকেই দেশ এবং প্রবাসের সব জায়গায় মুসলমান নামধারীরা ইফতার কালচারে এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েন যে, প্রায় প্রতিরোজই ইফতার পার্টির সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় স্থানীয় প্রিন্ট মিডিয়াগুলোতে। দেশের অবস্থা এবার মারাত্মক ধরনের খারাপ। সরকার এবার কোনো ইফতার পার্টির আয়োজন করবে না বলে আগেভাগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। অন্যান্য বিরোধী দলগুলোও খুব একটা এই খাতে জাঁকজমক দেখাতে পারছে না। দ্রব্যমূল্য এতটাই লাগাম ছাড়া যে, সাধারণ মানুষের এখন ‘ত্রাহি মধুসূদন’ দশা। যদিও সরকার বরাবরের মতো বাস্তবতাকে অস্বীকার করার প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসার সাহস দেখাতে পারছে না, তাই নির্লজ্জের মতো ক্ষমতাসীনদের মধ্যকার কেউ কেউ যখন বলেন, ‘এই সরকারের আমলে এতটাই উন্নয়ন হয়েছে যে, আগের মতো এখন আর রাস্তায় তেমন একটা ফকিরের দেখা পাওয়া যায় না’। তখন কথাটা শুনেও না শোনার ভান করতে হয়Ñ এতটাই দুর্ভাগা জাতি আমরা।
তবে আমাদের এই বর্তমান নিবাস নিউইয়র্ক নগরীর অভিবাসী বাঙালি সমাজ একেবারে যে ভালো নেই, তেমনটা দাবি করা যায় না। যদিও এখানেও দ্রব্যমূল্য লাগামছাড়া দশায় ওঠানামা করে। অনেকের পক্ষে নিত্যদিনের বাজেট কাঁটছাঁটে অনেকটা সময় ব্যয় করতেও দেখা যায়। তারপরও শুধু ইফতার পার্টি নয়, সেহরি পার্টির নামেও অনেককে আনন্দ-উল্লাস করতে দেখা যায়।
সম্প্রতি একটি জরিপের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক কর্মসূচির ওয়েবসাইটে- ‘খাবার অপচয় সূচক প্রতিবেদন ২০২৪’ শিরোনামে। সেখানে তারা দেখিয়েছে, গত ২০২২ সালেই বিশ্বে মোট অপচয় হয়েছে ১০০ টনের মতো, যা বিশ্ববাজারে আসা মোট খাদ্যের পাঁচভাগের এক ভাগ। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের তুলনায় খাদ্য অপচয়ের দিক দিয়ে বাঙালিরা এগিয়ে আছে সবচেয়ে বেশি। যার পরিমাণ হলোÑ একজন বাঙালি বছরে গড়ে ৮২ কেজি খাবার অপচয় করে। সেই হিসেবে ওই অপচয়ের পরিমাণ বছরে এক কোটি টনের চেয়েও বেশি। তারা দেখিয়েছে, ওই অপচয়ের মাত্রা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ভারতীয়দের চেয়ে বহুগুণ বেশি। ওই অপচয়ের একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছেÑ প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্ডার দেয়া ছাড়াও সব খাবার একটু চেখে দেখার প্রবণতা থেকে বাঙালি সমাজের মানুষেরা এমন ভয়াবহ অপচয়ের কাজটা ঘটিয়ে থাকে। এই সত্যকে স্বীকার না করার কোনো কারণ নেই। ইফতার আর সেহরি পার্টির জৌলুসকে চোখের সামনে রাখলে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব এক কঠিন দুর্যোগের মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে পরোক্ষ মদদদাতার ভূমিকায় বাইডেন প্রশাসনের অমানবিক কারসাজি যতটা না নিন্দনীয়, তারচেয়ে হাজার হাজার গুণ বেশি ইসরায়েলকে মদদ দিতে গিয়ে ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের রক্তে রঞ্জিত বাইডেনের দু’হাত যে কলঙ্কের ইতিহাস তৈরিতে স্বাক্ষর করলো। একজন মানুষ হিসেবে আমরা কি করে ভুলে যাই যে, স্বয়ং স্রষ্টা তার পবিত্র কোরআন শরীফে এই মনুষ্য প্রজাতির উদ্দেশে বলেছিলেনÑ ‘তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মানবতার কল্যাণের জন্য’। মাঝে মাঝে নিজেকেই শুধাই, আমরা কি নিজেকে এখনো মানুষ হিসেবে পরিচয় দেয়ার অধিকার রাখি?