Thikana News
০৪ জুলাই ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪

নাকফুল সমাচার

নাকফুল সমাচার
আমি আসলে কোনো দিনই স্বর্ণালংকারের প্রতি লোভী ছিলাম না। সাজগোজের প্রতিও আগ্রহী ছিলাম না কোনো দিন। তবে নিজেকে একদিন স্বর্ণালংকারের মতো দামি করে তুলব-এমন প্রত্যাশাও ছিল না। সাধারণভাবে বাঁচতে পারলেই কি মানুষের তকমা নিয়ে বাঁচা যায়? এমন একটা ধারণাকে সম্বল করেই পথ হেঁটেছি চিরটাকাল। তবে এই হাঁটাপথে কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। কত স্মৃতি বুকের গভীরে স্থান করে নেয় অবলীলায়। নাকফুল নিয়েই স্মৃতির ঝাঁপি খোলার সামান্য প্রয়াস আজ আমার।

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসলাম। বাবার এবং স্বামীর বাড়ি থেকে বিয়ে উপলক্ষে দুই সেট গয়না পেয়েছি। সোনার সেই দুই সেটের ওজন নেহাত কম ছিল না। বাবার বাড়ি থেকে চিরদিনের মতো বিদায় নিয়ে স্বামীর বাড়িতে যখন এসেছি, তখন সন্ধ্যা আসন্ন প্রায়। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী শ্বশুরবাড়িতে উপস্থিত সবার সামনে আবারও দুজনকে বসতে হলো। নেতৃস্থানীয় এক মুরব্বি মহিলা আমার শাশুড়ির হাতে তুলে দিলেন আরও ভারী পাথর বসানো জড়োয়া দুই সেট গয়না। বললেন, তুমি নতুন বউয়ের হাতে তুলে দাও। আমার শাশুড়ি কিছুটা মানসিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন, তাই অন্যরা যা বলছিলেন, তিনি সেই অনুযায়ী কাজ করছিলেন। কিন্তু ঘরভরা অতিথিদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন শুরু হলো। ছেলে তো তিনজন, তাহলে শাশুড়ির সব গয়না শুধু একজনের বউয়ের অধিকারে যায় কী করে! যে ফুফুশাশুড়ি দেওয়া-নেওয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তিনি উত্তরে বললেন, আমার ভাই গয়নার সেটগুলো আমাদের দুই বোনের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, যে ছেলে তার মায়ের দেখাশোনা করবে, তার বউয়ের হাতে গয়নাগুলো যেন আমরা তুলে দিই। আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র। এখন তোমরা দেখো, তোমরা কী করবে?

গয়না নিয়ে ওই অসন্তোষটা যদিও ডালপালা মেলানো নয়, কিন্তু অনেক দিন পর্যন্ত মৃদু ফিসফাস বাতাসে ভেসে থাকল। পরবর্তী সময়ে আমি অবশ্য এর একটা সম্মানজনক মীমাংসা করেছিলাম। আর আমার তো গয়নার প্রতি তেমন একটা আকর্ষণ কোনো সময়েই ছিল না। শুধু শুধু নিজেদের মধ্যে ঝামেলা জিইয়ে রেখে কী লাভ? তাতে করে ভাঙনের শব্দ উচ্চকিত হবে। ক্ষতি হবে নিজেদেরই।

আমার শাশুড়ির দেওয়া গয়নার মধ্যে খুব চিকন চিকন সোনার কয়েকটা চুড়ি ছিল। শখ করে সেই চুড়ি পরে একবার এক অনুষ্ঠানে গেলে দেখা হয়ে গেল শ্রদ্ধেয় এক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। তখন শাহজালাল ইউনিভার্সিটির ভিসি ছিলেন হাবিবুর রহমান। জানি না কেন যেন উনি আমাকে নিজের বোনের মতো স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতেন। পাশে ডেকে নিয়ে সরাসরি বললেন, ‘শামসাদ, আপনি তো নারীবাদী লেখা খুব লিখে থাকেন। কিন্তু হাতের চুড়িকে কি আপনি শৃঙ্খল হিসেবে দেখেন না? আসলে আমি আপনাকে অন্যভাবে ভেবেছিলাম।’

বাসায় এসে হাত থেকে খুলে রেখেছিলাম চুড়িগুলো। তারপর আর অনেক দিন ছুঁয়েও দেখিনি। তবে ওই গয়নার বাক্সে ছোট এক বক্সের ভেতরে বেশ বড় সাদা পাথরের একটা নাকফুল পেয়ে গেলাম। জুয়েলারি দোকানে দেখিয়ে এনেছি, পাথরটা হীরার নয়, তবে দামি জানাল তারা। কোনো দিন নাকফুল পরার সুযোগ হয়নি, এবার যখন মুফতে পেয়েছি, তাহলে পরার একটু চেষ্টা করা যায়!

এই ইচ্ছা নিয়ে আমার মায়ের শরণাপন্ন হলাম। আমার মায়ের আবার ওইসব বিষয়ে সীমাহীন উৎসাহ। কারও গায়ে ছোট একটা ফোড়া উঠলে কিংবা কারও মুখের একটা দাঁত নড়ে গেলে যতক্ষণ না তার একটা সদ্গতি করা যায়, তার নিরলস চেষ্টা তিনি করেই যাবেন! নাক ফোঁড়ানো বা কান ফোঁড়ানোÑএসব তার কাছে আরও শখের বিষয়। মা-ই আমার নাক সুই দিয়ে ফুঁড়িয়ে দিলেন। তারপর যথারীতি ফুলটা নাকে পরিয়েও দিলেন একসময়।

কিন্তু একটু খচখচ করে মনের ভেতরে। পাথরটা যেহেতু হীরার নয়, তাহলে আর সুচের আঘাত সইতে গেলাম কেন? কিছুদিন পরে জিন্দাবাজারে গিয়ে ছোট একটা হীরার নাকফুল কিনলাম, তিন হাজার টাকা দিয়ে। নাকে পরে আছি, সেই দৃশ্য দেখে আমার মুখরা স্বভাবের এক বোনঝি মন্তব্য করল, সেই তো হীরার নাকফুল কিনলে, তবে একটু বড় কিনলেই পারতে। চোখেই দেখা যায় না! কথাটা হজম করলাম, কিন্তু উত্তর দিলাম না। কে না জানে-হীরার বড় ফুল কিনতে গেলে বড় অ্যামাউন্টের টাকাও লাগবে! এই মুহূর্তে আমার সেই সামর্থ্য নেই।

পরে একটা সময়ে যখন নিউইয়র্কের বাসিন্দা আমি, সেই সময়ে ঘুমন্ত ইচ্ছাটা আবার একটু একটু করে মাথা তোলা শুরু করেছে। নিজে চাকরি করি, মোটামুটি টাকা নয়, ডলার হাতে জমা হয়। এবার তো ইচ্ছে করলে একটা হীরার বড় নাকফুল কিনতেই পারি আমি! বেশ কিছুদিন দোটানায় সময় পার করে শেষ পর্যন্ত জ্যাকসন হাইটসের এক সোনার দোকানে হাজিরা দিলাম। কিনলামও একটা হীরার নাকফুল। আকারে নেহাত ছোট নয়, বেশ বড় অঙ্কের ডলারের বিনিময় মূল্যে কেনা সেই নাকফুলটা নাকে দিতেই অন্য ধরনের এক অপরাধবোধে আক্রান্ত হলাম! কত মানুষের সারা দিনের মধ্যে এক বেলা খাবার জোটে না, আর আমি শুধু একটা শখ পূরণের পেছনে এতগুলো টাকা খরচ করলাম! শখ বলে কথা, একসময় সেই অপরাধবোধের জায়গা দখল করে নেয় ভালো লাগা আর ভালোবাসা নামের শক্তিশালী কিছু অনুভূতি। কিন্তু জীবনে কোনো কিছুই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ২০০৬ সালে নিউইয়র্ক নগরীতে অভিবাসী জীবন গ্রহণ করার পাশাপাশি আমার শারীরিক অবয়বে বেশ বড় মাত্রার পরিবর্তন ঘটে। আমি অবশ্য কোনো দিনই শারীরিক দিক দিয়ে ভালো ছিলাম না। নিতান্তই কম বয়সে টিটেনাসের মতো রোগে মরমর অবস্থা হয়েছিল। তারপর বিয়ে-পরবর্তী কিডনি জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে দেশে থাকাকালীন তিনবারের মতো সার্জারি করাতে হয়েছিল। দুবার দেশে সার্জারি করালেও মাঝে একবার দিল্লিতে করালাম। নিউইয়র্কে আসার পর ফের সার্জারির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেওয়ায় ২০১০ সালে ম্যানহাটনের মেট্রোপলিটান হাসপাতালে কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে আবারও ছুরি-কাঁচির নিচে যেতে হয়েছে।

নিয়ম অনুযায়ী সার্জারির আগে শরীরের সব গয়না খুলে রাখতে হয়। খুলে রেখেছি ঠিকই, কিন্তু নাকফুলটা আর খুলতে পারছি না! এতটাই টাইট হয়ে রয়েছে যে খোলার আশা ছেড়ে দিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। ওটিতে ঢোকানোর আগে জুনিয়র লেভেলের একজন মহিলা ডাক্তার আমার সঙ্গে কথা বলতে এসে নাকের দিকে আঙুলের ইশারা করে বললেন, এটা খুলতে হবে। বিনয়ের সঙ্গে বললাম, বেশি টাইট হয়ে যাওয়ায় খোলা সম্ভব হয়নি। আপনাদের কোনো সিজার দিয়ে কেটে ফেলতে পারেন।

কিছুটা রাগ দেখিয়ে বললেন, এ রকম কোনো সিজার আমাদের নেই। রুম থেকে বেরিয়ে কিছু সময়ের মধ্যে একটি ফর্ম নিয়ে ফিরে এলেন। বললেন, এখানে একটা সই করতে হবে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতে উত্তর দিলেন, সার্জারির সময় আপনার এই নাকফুলের কারণে যদি কোনো ঝামেলা হয়, তার জন্য আমরা দায়ী থাকব না। বোকার মতো কাজ করলাম, একটা কাগজে সই দিতে দিতে অপমানটা নীরবে হজম করলাম। দোষ তো আমারই। অবশ্য নাকফুলের জন্য বেহুঁশ অবস্থায় কোনো ঝামেলা হয়েছিল কি না, বুঝতে পারিনি। তবে এমন ভুল আর কোনো দিন করব নাÑমনে মনে তওবা করলাম।

বছরখানেক না কাটতেই আরও একটা সার্জারির সময় প্রায় এগিয়ে এল। এবার বুকের একটা ল্যাম্প অপারেশন করে ফেলে দিতে হবে। সার্জারি হবে ম্যানহাটনের মাউন্ট সাইনাই হাসপাতালে। ডাক্তার বলে দিয়েছেন, সার্জারির পরের এক মাসে রেডিয়েশন দিতে হবে। মোটামুটি বড় একটা ধকল যাবে শরীরের ওপর দিয়ে। অতএব, নাকফুলটা বহাল তবিয়তে জায়গামতো রাখার কোনো যুক্তি নেই। উপায়ান্তরও নেই, খুলে রাখতেই হবে! কিন্তু যেভাবে টাইট হয়ে আছে, খুলে ফেলা বেশ কষ্টকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এক দুপুরে জ্যাকসন হাইটসের এক সোনার দোকানে গিয়ে সমস্যার সবিস্তার বর্ণনা করে সাহায্য চাইলাম। কিন্তু সেলস গার্ল সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে বললেন, আমরা তো এ ধরনের কাজ করি না। তবে পাশের আরেক দোকানের বেজমেন্ট বললেন, একজন সোনার কারিগর রয়েছেন, তার কাছ থেকে সাহায্য নিতে পারি। পরামর্শটা কাজে এল।

সার্জারি শেষে পরের এক মাসে পুরো শরীরটা যখন মেশিনের ভেতরে ঢুকিয়ে দিত, মনে মনে কলমা পড়তাম, তখন নিজের বুদ্ধির তারিফ করলাম মনে মনে। ভাগ্যিস খুলে ফেলতে পেরেছিলাম, না হলে কী যে ঝামেলা হতো! কিন্তু কপালের গর্দিশ আর কাটে না। মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কাউকে না কাউকে এমনভাবে তৈরি করেন, যেন বারবার কোনো না কোনো দুঃখ-কষ্টের সামনে পড়ে পরীক্ষা দিতে হয়। আমি হলাম সেই প্রজাতির এক প্রাণী, তাই আমার জীবনটা সেই পরীক্ষার তালিকায় বারবার উঠে আসে।

এবার বড় এক ধাক্কার মুখোমুখি হলাম। সামান্য এক সমস্যা নিয়ে কার্ডিওলজিস্টের কাছে গিয়েছিলাম। তার কথা অনুযায়ী এনজিওগ্রাম করালে ধরা পড়ল তিনটা আর্টারিতে ৯৫ ভাগ ব্লক হয়ে আছে! অতএব, তড়িঘড়ি করে বাইপাস সার্জারির ডেট পড়ল। ২০২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি। সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নাকফুলের শখ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করব না। নাক থেকে হীরার ফুলটা খুলে রাখতে রাখতে ভাবলামÑকী দরকার আর বাড়তি এই প্রেশার নেওয়ার। খুলে রেখে দেব চিরকালের জন্য। সেই যে খুলে রাখলাম, আর পরার ইচ্ছা জাগে না। মাঝে মাঝে ভাবি, যখন লাশ হয়ে পড়ে থাকব, তখন এটা খোলা নিয়ে স্বজনেরাই ঝামেলায় পড়বে।
অবশ্য এই হীরার নাকফুলের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের নজরুলগীতির এক প্রখ্যাত শিল্পী। বইমেলার আয়োজন হয়েছে জ্যাকসন হাইটসের পিএস ৬৯ স্কুলে। শিল্পী স্টেজে উঠতে গেলেন, তারপর ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা পাওয়ারফুল আলোর বিচ্ছুরণ ঘটল তার নাকে পরা হীরার নাকফুলের ওপর। যেন এক আলোর ফুলঝুরি! দৃশ্যটা আমাকে সেদিন এতটাই অভিভূত করল যে তার পর থেকে সেই নাকফুলের ওপর আগ্রহ যেন বেড়ে গেল বহুগুণ।
মহিলাদের এই নাকফুল পরার ইতিহাস নিয়ে অনেক কথা রয়েছে। যদিও ঐতিহাসিকদের দাবি অনুযায়ী, নবম ও দশম শতাব্দী থেকে নাকে ফুল পরার প্রচলন শুরু হয়েছিল প্রাচ্যের মাটিতে। মোগলদের আমলে ভারতে তা প্রসার লাভ করে। প্রাথমিক অবস্থায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মহিলারাই কেবল নাকফুল ব্যবহার করতেনÑসেই দাবিটিও ছিল ইতিহাসবিদদের। কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতির তথ্যমতে, পাঁচ হাজার বছর আগে অনেক পুরোনো মন্দিরে বা গুহাতে অবস্থিত খোদাই করা মূর্তির নাকে ওই ধরনের অলংকারের চিহ্ন দেখা গেছে। কাজেই মোগল ঘরানায় নাকফুলের উত্থান কথাটা সর্বক্ষেত্রে সঠিক নয়। তবে নাকফুলের তিনটি ভিন্নতা রয়েছে, যেমন নাকফুল, নথ ও নোলক। অধিকাংশ রমণী নাকফুল পরে থাকেন নাকের বাম পাশে। আর নাকের মাঝ বরাবর ছিদ্র করে সেখানে নোলক পরা হয়। আর যেকোনো এক পাশে ছিদ্র করে বড় গোলাকার যে অলংকার পরেন মহিলারা, তাকে বলে নথ। এই নথটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিয়ের কনেকে পরানো হয়। বিশেষ এক সময়ের অলংকার এটা। সব সময় নাকে দিয়ে রাখা যায় না। প্রচলিত ধারণায়, ওই অলংকার হচ্ছে বিবাহিত নারীর স্বামীর মঙ্গল কামনায় ব্যবহার করার একটা উপায়। এখন অবশ্য এই ধারণা পোষণ করেন না অনেক নারীই। অনেকের কাছে যেকোনো ধ্যান-ধারণার একটি অংশমাত্র। তবে খ্রিষ্টান, মুসলমান, শিখ, হিন্দু-সব সম্প্রদায়ের নারীরা এই নাকফুলকে অলংকার হিসেবে সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছেন।

ওই নাকফুল নিয়ে আমার পারিবারিক এক কাহিনি লিখে লেখাটার ইতি টানব। ইতিহাসের তথ্যমতে, আট শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রায় ৪০০ বছর ধরে বাংলা ও বিহার শাসনকারী রাজবংশের নাম পাল ডায়ানেস্টি। ওই বংশের মোট ১৮ জন রাজা ৪০০ বছর ধরে বাংলা ও বিহারের সীমানা ছাড়িয়ে কৌনজ পর্যন্ত তাদের রাজ্যসীমা বিস্তৃত করেছিলেন। কিন্তু দিন সব সময় সমান যায় না। বিশেষ করে, উত্তর ভারতে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামসহ দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূটদের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষ মোকাবিলায় শক্তিক্ষয় থেকে একসময় শাসনকাঠামোর দুর্বলতায় পতন ত্বরান্বিত হয়ে ওঠে। যার ফলে বারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, সেন রাজবংশের হাতে পাল বংশের পতন ঘটে। সেই থেকে ইতিহাসের বাকবদলের পালা শুরু। নিজের পরিবর্তিত সাম্রাজ্যের হাতবদলের বিষয়টি মেনে নিতে ওই বংশের মানুষদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কেউ কেউ সেই সময় বাইরের বিভিন্ন অঞ্চলে পাড়ি জমিয়েছেন নিজ বাসভূমি ছেড়ে। এমনি করেই ওই পাল বংশের এক অধস্তন উত্তরাধিকার কুমার কালিদাস পাল পানিপথ দিয়ে বিস্তীর্ণ ভূভাগ ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন বৃহত্তর সিলেটের বিয়ানীবাজার গ্রামের পঞ্চখণ্ড অঞ্চলে। ওই বিয়ানীবাজারে পাল শাসনের সময়কাল ছিল প্রায় ১০০ বছর। পরে ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর সিলেট বিজয়ের মধ্য দিয়ে ওই জনপদ মুসলিম শাসনের আওতাভুক্ত হয়েছিল।

ওই ১০০ বছরের শেষের দিকে জনৈক কুমার প্রতাপ চন্দ্র পাল কোনো এক কারণে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে পঞ্চখণ্ডের অদূরে বাহাদুরপুর পরগনা প্রতিষ্ঠা করে সূচনা করেছিলেন চৌধুরী পরিবারের। তিনি তার নাম পরিবর্তন করে রেখেছিলেন প্রচণ্ড খাঁ। বাহাদুরপুরের নামকরণ করেছিলেন ‘বাগে প্রচণ্ড খাঁ’। অর্থাৎ প্রচণ্ড খাঁর বাগান। ওই বংশে জন্ম আব্দুল ওয়াহিদ চৌধুরীর। তিনি তার বংশের ষোলোতম পুরুষ ছিলেন। তার দুই পুত্র ছিলেন। বড়জনের নাম আব্দুল করিম চৌধুরী এবং ছোটজনের নাম আব্দুল খালিক চৌধুরী (আমার পিতার প্রপিতামহ) এবং তাদের বোন ছিলেন একজন। বড় ভাইয়ের ইচ্ছা তিনি তার শ্যালকের সঙ্গে বোনের বিয়ে দেবেন। কিন্তু ছোটজনের তাতে ঘোর আপত্তি। আমার দাদির কাছে শোনা ঘটনাÑছোট ভাইয়ের আপত্তিকে আমলে না নিয়ে বড় ভাই বোনের বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন করেন। আগের দিন কনের হাতে মেহেদি পরানো ছাড়াও অলংকার দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ছোট ভাই আব্দুল খালিক চৌধুরী মরিয়া হয়ে এক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেছেন, যেভাবেই হোক এই বিয়ে তিনি ঠেকাবেনই। ভাইয়ের ঘরের কাজের মহিলাকে বড় অঙ্কের টাকার টোপ দিয়ে তিনি রাজি করিয়ে রেখেছেন, শেষ রাতের দিকে দরজার হুড়কাটা খুলে দেবেন মহিলা। কথামতো খুলেও রেখেছিলেন, কিন্তু বিপত্তি বাধল, ছোট ভাই যখন তার বোনকে জাপটে ধরে দরজার চৌকাঠে পা রাখতে যাবেন, বিয়ের কনে তখন তারস্বরে আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘ও হুরু ভাই, আমার নাকের নথটা খুলে পড়ে গেল।’ বোনের কণ্ঠস্বর শুনে বড়জনের ঘুম ভেঙে গেলে ছোট ভাইয়ের সামনে পালানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ ছিল না। তিনি পালিয়ে জান বাঁচালেও তকদিরের ওপর গর্দিশের ফাড়াটা কাটল না। বড়জন খালি পেটে এক কাপ চা গলাধঃকরণ করেই ছুটলেন স্থানীয় থানায়। ভাইয়ের বিরুদ্ধে বোনকে অপহরণের অভিযোগ খাড়া করে থানার ঊর্ধ্বতন কর্মকতাদের মন গলিয়ে শেষ পর্যন্ত ছোট ভাইকে হাজতবাস করালেন টানা এক দিন আর এক রাত।
আর সেই সময়কালের মধ্যে একমাত্র বোনের বিয়েটাও সম্পন্ন করলেন তিনি নিজের শ্যালকের সঙ্গে। আর থানার মধ্যে চেয়ারে বসে সময় কাটানোর মুহূর্তে ছোট ভাইয়ের বারবার করে কথাটা মনে পড়ছিল, এত জোরে জাপটে না ধরলে হয়তো বোনটার নাকের নথ খুলে গিয়ে এমন কাণ্ডটা ঘটত না। বিয়েটাও আটকাতে পারতেন তিনি।

কমেন্ট বক্স