Thikana News
২৫ এপ্রিল ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

গাঁয়ের ছেলে

গাঁয়ের ছেলে
জর্জেস মোহাম্মদ

মেঘা আর শেরা। দুই বন্ধু, গলায় গলায় খাতির। একই গাঁয়ের ছেলে। পুরো নাম খতিয়ে দেখে না সবাই। একজন জেলের ছেলে। শুধু জেলের ছেলে বলা সঠিক নয়। শীতে কৈ-শিং থেকে শুরু করে শ্রাবণে ইলিশা জাল দিয়ে ইলিশ মাছ ধরা। নিজের জাল, নৌকা কিছুই নেই। যে ব্যক্তির মাছধরার কোনো জাল নেই, তাকে জেলে বলা অনুচিত। অন্যজন কৃষকের ছেলে। কৃষক বলা ভুল হবে। এখানেও কৃষক ডেকে কৃষকের মান কমাতে চাই না। লাঙল, হালিগরু, মই, পাইচন-এসব কিছুই নেই। অন্য কৃষকের হালচাষে সাহায্য করে। দিন আনে দিন খায়। কেউই স্কুলের গলিতে হাঁটেনি। লাটিম খেলা, নৈমীর, টোঙামির, ঢালামির যে খেলেনি স্কুলের আঙিনায় বলা বাহুল্য। স্কুলের আঙিনায়, মঠের ধারে, মুদিবাড়ির মাঠেই ছিল ওদের রাজত্ব। দিনের আলো দেখার সঙ্গে সঙ্গেই রাজ্যভার তুলে নিতে হয়। নৈমীরের চাঁড়া জোগানো-গোল, চারকোনা, লোহার, মাটির, ভারী, পাতলাÑচাঁড়ার জগতে কত কোনা, কোন কোনা কীভাবে কাজ করে, তা একজন জ্যামিতিকও জানে না। চাঁড়ার কোনা ও ভারসাম্য যেন ওদের আঙুলের খেলা। পদার্থবিদ্যার মাধ্যাকর্ষণ সূত্র ওই নৈমীর খেলার মাঝে লুকায়ে কত উঁচুতে কীভাবে মারতে হবে, বিজ্ঞানকেও হার মানাবে। 

স্কুলের অন্য সব ছেলেমেয়ের চেয়ে মেঘা ও শেরার পরিচিতি অনেক বেশি। মেঘা কম কথা বলে, শেরা একটু বেশি। দুজনই চুলে কটু তেল দিয়ে পরিপাটি থাকে। দুজনেরই বিধাতার দেওয়া বড় গুণ ছিল। গাঁয়ের রং। আহা সেকি কালো। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকেও হার মানিয়েছে। মেঘার শখ ঘুড়ি ওড়ানো। শেরার শখ বাঁশি বাজানো। বাঁশের বাঁশি, আড়বাঁশি। আর গানও গায় ভালো। বিশেষ করে, রাতের অন্ধকারে। বন-জঙ্গল একা পার হতে উঁচু স্বরে গান তোলে, ‘দাদা আর যাব না ঐ স্কুলে পড়তে।’ ভয় তাড়ানোর মহৌষধ, তবে গায় ভালো। মেঘা ভালো গাইতে পারে না, গুনগুনিয়ে গায়। বাবাকে মাছ ধরায় সাহায্য করে। আলতিতে ওস্তাদ। পূজার ঢোলের তালে তালে আগুন নিয়ে নাচ। ভয়ানক কঠিন, কিন্তু মেঘার অতি সহজ কাজ। কৃষ্ণকালো মেঘাকে অনেকেই ভালোবাসে। পুরুষের চেয়ে কুমারীরাই বেশি। কুমারীদের কোনো জাত নেই। ঘড়ির কাঁটার মতো হৃদয়। শুধু বয়স গুনতে থাকে। নাচের তালে একটুকরো জ্বলন্ত কয়লা যদি মাটিতে পড়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে কুমারীর দল। নিজের হাত পোড়ে মেঘার পা বাঁচাতে। মা হরির পূজা, কম কথা নয়। বলো হরি, হরি বলো, হরি হরি। মেঘা সবই বোঝে, সবই দেখে, তবু কৃষ্ণ রশি টানে। মেঘার মনসাগরে কোনো জাতিভেদ নেই। ধর্ম আর জাত শুধু সমাজে, হৃদয়ে নয়। সমাজ বলে কথা। ঝাঁপ দেওয়ার আগে দশবার ভাবতে হয়। এক মন ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত, আরেক মন আঁচল টেনে ধরে। এ বাড়ির কোকিল যদিও বাড়ির কাকের বাসায় স্বজাতীয় না হয়েও ঘর-সংসার করতে পারে, আবার মনের সুখে গানও গায়, তবে মানুষের কী দোষ।

দুজনেরই বয়সের তুলনায় দৈহিক গড়ন পুষ্ট। ঘরের খাদ্য খোরাকের চেয়ে বাইরের খাদ্যই বেশি। লোকদেখানো ফুটফরমাশ করে। ফুটফরমাশের অনেক প্রকারভেদ আছে। রুখমনি যদি মেঘাকে ডেকে বলে, এই মেঘা, আমাকে বাজার থেকে এক দোয়াত কালি এনে দিবি? উত্তরে মেঘা বলবে, তাতে যেটুকু কালি আছে, একটু জল মিশিয়ে নাও। আরে বোকা! জল মিশিয়ে কি কালি বাড়ানো যায়? তোকে একটা পাকা ডালিম দেব। অমনি মেঘা চিৎকার করে শেরাকে ডেকে বলবে, চল বাজারে যাই। রুখমনি লেখাপড়া করে না। কিন্তু বিদ্যাসাগরী ভাব। আসলে মেঘার সঙ্গে একটু কথা বলা। বয়স মানে না জাত-ধর্ম।
শেরা ঘাস কাটতে গেলে গান গায়, পাট কাটতে গেলে গান গায়, গরুর গোসল করাতে গেলেও গান গায়। শুধু শসার মাচা থেকে কচি শসা তুলতে গান আসে না। কারণ শসা তোলা একটু গোপন কাজ। চুরি বলা চলে না। আর ভাগ তো মেঘা পাবেই। এ গাঁয়ের আম, জাম, পেয়ারা, পেঁপেÑসবকিছুতেই অপ্রকাশ্য অংশীদার। চালতা, বেতফল, আমড়া, কুল আর তেঁতুলÑএসবের বড় অংশীদার গাঁয়ের মেয়েরা। গাছে উঠে একটা ঝুল দেওয়া মাত্র। বড় নারিকেল গাছে সবাই উঠতে পারে না। শেরার কাছে একেবারেই সহজ, ডাল-ভাত। শেরা বলবে ইয়া আলি, মেঘা বলবে জয় বজরংবলি। পাঁকি ছাড়া গাছের মাথায় উঠে বলবে, রুদ্রকরের মঠ দেখা যায়, আড়িয়াল খাঁ নদী দেখা যায়। ঝুনা নারিকেল মাটিতে ফেললে অসুবিধা নেই। সমস্যা হলো ডাব নারিকেল নিয়ে। পুকুরের পানিতে ফেলতে হয়। আর পুকুরের পানি থেকে তুলবে কে? আর কে? শেরা ও মেঘা। ওদের ভেজা গায়ে দেখতে অনেকেই পছন্দ করে। এ গাঁয়ের নব ভাবি ও বউদিরাও বাদ নেই। মুখে বলে না, মনে শ্রীকৃষ্ণ। আর ওরা যখন ঢকঢক করে ডাবের পানি খায়, গোপনে তাকায়। ডাবের কাঁচা ছোলা দিয়ে লেই তুলে খাওয়ার দৃশ্য অপূর্ব।

মেঘা ঘুড়ি ওড়ায়। সব ঘুড়ি নয়, ঢাপার ঘুড়ি। বিকেলের আকাশের সবচেয়ে বড় ঘুড়ি। ভনভন ভেঙ্গুরের শব্দে নাচে মুক্ত আকাশে। বোলতা পোকার রং প্রজাপতির কারুকাজ। আকাশের রাজা। এই ঘুড়ির কারিগর মেঘা নিজেই। সুতা, নাটাই, কাগজ, বাঁশ-আরও নাম না-জানা উপাদান। সুতা তৈরিতেও আরেক শিল্প লুকায়ে। গাবের কষ, চালের কুঁড়া, বাড়লি, কাচের গুঁড়া, রোদে শুকানো, মাইঞ্জা মারা, পাঁচ থেকে সাত দিন পরে সুতা নাটাই বাঁধা। নাটাইর ভেতর দুটি মাডবল দিতেও ভোলে না। নাটাই যত ঘোরাবে, ততই শব্দ হবে। মেঘার ঘুড়ি বলে কথা!

মন আর বয়স, সমাজ-সংসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে। বেশির ভাগেই মন আর বয়স পরাজয় বরণ করে। এই পরাজয়ের পেছনে কাজ করে স্বার্থ, লালসা ও চক্ষুলজ্জা। রুখমনিও পরাজয় বরণ করেছে। রাধিকার মতো মেঘাকে ভালোবেসেও পাগলমনকে হেমায়েতপুর পাঠাতে হয়েছে। পাগলমন কত কিছু চায়, সবই কি পায়? অতি পাগল হলে পায়, তবে সারা জীবন খেসারত দিয়ে যায়। তেলিবাড়ির মেয়ে, মোটা অঙ্কের পণ দিয়ে, মোটাতাজা লম্বা আবার ফরসা ছেলেকে বিয়ে করেছে। পরিবারের পছন্দ আর পণের জাদু। জামাইবাবু লেখাপড়ায়ও ভালো। বাবার ব্যবসা না দেখলেও ব্যবসা বোঝে ভালো। হুকুম দিয়ে কর্মচারী চালাতে পারে ভালো। একটু হুকুমে অভ্যস্ত। এইটুকু সময়ে আলতা সাজা বউকেও দু-একটা হুকুম দেয়নি, তা নয়। তবে পণের ভারে একটু নিচু স্বরে। ধুতি-পাঞ্জাবি পছন্দ নয়। হাওয়াই শার্ট, কুতুব মিনারি প্যান্ট। মনে হয় সবুজ খুব পছন্দ। তাই রঙিন চশমাটা শার্টেও বোতামের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখেছে। হাতে শ্বশুরের দেওয়া ওমেগা ঘড়ি চকচক করছে। একেবারে শহুরে বাবু।

রুখমনি মায়ের বাড়ি নাইয়র এসেছে। এখন আর নিজের বাড়ি নয়। মাত্র তিন দিন আগেই তো এ বাড়িতে ছিল নিজের বাড়ি মনে করে। এখন কেন পর পর লাগচ্ছে। মাত্র তিন দিনেই এত পরিবর্তন? পাশে স্বামী আজীবন সহায়। মেঠো পথে হাঁটতেই মনে হলো, অতি সামান্য এই ক্ষণ, কত অজানা অতি জানা পথ ও বন। হুঁ হুঁ কাঁদে কোমল মন। এই গাছ, এই পাখি, মারে উঁকিঝুঁকি, কেউ আপন নয়। তবে কি কেউ আছে আপন এ গাঁয়ের জন, আমার স্বজন। ভেতরের কান্না হৃদয়ে বাসা বেঁধে রয়, চোখে শোভা নাহি পায়।

মন যেন কারে খোঁজে গোপনে, চোখ এদিক-ওদিক তাকায়। মন চায় কালীবাড়ি মন্দিরের পেছন থেকে ডেকে বলে, আজ আর খেলার দরকার নেই, সারা দিন কথা বলবে। এখন তো আমি স্বাধীন, তবুও পরাধীন। কী ভাববে স্বামী? তবে কি পৃথিবীর মানুষের মন জোগাতে জোগাতে নিজের মনের স্বাদ চাপা পড়ে যাবে। হঠাৎ শেরাকে দেখা গেল। গাছের একটা ভাঙা ডালা দিয়ে অন্য ছোট গাছকে দু-একটা বাড়ি দিতে দিতে আসছে। একটু সামনে আসতেই রুখমনিকে দেখেই চলেছে। কী দেখছিস তুই? তোমাকে! কী সেজেছ এসব? মনে হয় কোনো বাড়ির বউ। শেরার মনে কষ্ট হয়, যে কষ্ট কখনো হয়নি মনে। পাশে ওই ধোপদুরস্ত লোকটা একদমই পছন্দ হয়নি। রুখমনির পাশে অন্য মানুষ, সে কিনা রুখমনির সাথে মাদবরি করে বেড়ায়।

এই নে, আমার ব্যাগটা ধর। মেঘা কইরে? মেঘা তোমার বাক্সপেটরা নিয়া একটু পরে আইতাছে। তোমাগ ঘরের কোনায় ডালিম গাছে একটা ডালিমও কেউই ধরে নাই। মেঘায় কইছে দেইখ্যা রাহিছ। ডাব পাইড়া রাখছি, দুপুর অইলে ডাইকো, কাইটা দিমু। অহন যাই, দেখি মেঘায় কই। হয়তো আমার লাইগ্যা বইয়া রইছে। মেঘা আর শেরা আর কেউ নয়, এ মাটির সন্তান। নয় হিন্দু নয় মুসলমান। এ গাঁয়ের ছেলে, এ গাঁয়ের সম্মান।

কমেন্ট বক্স