Thikana News
২১ নভেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

অভিমানী বুড়ো

অভিমানী বুড়ো
‘বুড়ো কি বাতাসে হয়েছেন’- এই প্রবাদ বাক্যটি অতীব সত্যই। বুড়ো কেউ বাতাসে হয় না এবং চুলও বাতাসে পাকে না। এ কথাটি বলে বুড়োদের হেয় করা হয়। বুড়োকে যখন কেউ বলেন- বুড়ো হয়েছেন বাতাসে! শুনে বুড়ো ফিরে তাকায় অতীতে। একদিন কিশোর ও যৌবন ছিলো, সবই হারিয়ে ফেলেছি। কিশোর বেলার চঞ্চলতায় দাপুটে ফুটবল খেলার দক্ষ খেলোয়াড় ছিলাম। কখনও বুঝিনি কোথায় পালিয়ে গেলো সেই দিনগুলো। যৌবনে কোকিলের ডাকে মনে হলো ওর মনে ফাগুন এসেছে। সেই ফাগুন যে কখন এলো আমার মনে, বুঝতে পারলাম না!

কলেজে পড়ার সময় কত মেয়ে বন্ধু হয়েছে, কার কথা মনে হয়নি! আজ রাণুকে দেখি কাজল ছোঁয়া বড় বড় পাতায় ঢাকা গভীর দীঘি চোখ! হলুদ তাঁতের শাড়ি জড়ানো রাণুকে দেখেই আমার মনে হলো- তুমি আমার চিরদিনের চেনা! কাউকে তো কখনও এমনভাবে আপন মনে হয়নি। 

রাণু এলো আমার জীবনে। পালাতে চাই লোকালয় থেকে। রাতে ঘুম আসে না, ঘর থেকে বাইরে যাই, বহুদূর থেকে ভেসে আসছে রাতজাগা কোনো এক কিষাণ ছেলের হৃদয় তোলপার করা করুণ বিষণ্ন সুর। নিশাচর পাখিগুলো অদ্ভূত শব্দ করে উড়ে যাচ্ছে জোৎস্না ভেজা বনের দিকে। মনকে শান্ত করতে পারি না। মানুষের মনের খাঁজে যে কত কী লুকিয়ে থাকে- ওপর থেকে জরিপ করা মুশকিল। 

রাণুকে ভুলতে পারি না। কাউকে তো এমনভাবে আপন মনে হয়নি। মনকে শান্ত করার জন্য ঘরে ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে পরি। আর গেয়ে উঠি ‘মোর ভাবনাকে একি হাওয়া মাতালো’। মা গান শুনে ঘরে এসে আমার দিকে অদ্ভূতভাবে তাকান! মাথায় হাত দিয়ে স্নেহের সুরে প্রশ্ন করেনÑ সত্যি করে বলোতো তুমি কাউকে ভালোবাসো? নিঃসন্দেহে বলতে পারো। মায়ের কথায় আমি শান্তির পরশ খুঁজে পাই। মার কাছে মনের কথা বলি।
মা শুনে বলেন, তোর জীবনে প্রেম এসেছে। প্রেম হচ্ছে মানববৃক্ষের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার বন্ধন। সৃষ্টি জগতের একমাত্র সিস্টেম তুমি-আমি কেউ উপেক্ষা করতে পারি না। মায়ের কথায় সব গ্লানি মুছে গেলো। মনে খোলা বাতাসের ধ্বনি খুঁজে পাই। 
আজ আমি রাণুর কাছে নিজের কথা তুলে ধরবো। রাণুকে বলি আমার মনের কথা। রাণু হেসে হেসে বলে, আমার মনের অজান্তে ভালোবেসেছি তোকে। আমার প্রেম মুক্তি পেলো। 

রাণুকে বলি, চলো কোন পার্ক বা নদীর ধারে, আজ আমরা মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়াবো! 
রাণুকে নিয়ে পার্কের গাছের ছায়ায় বসি। রাণুর হাতটা নিয়ে কিছু কথা শোনাতে চাই।
রাণু হেসে বলে, আজতো আর বন্ধন নেই। রাণুর কথা শুনে বুকের পাথরটা সরে গেলো। খুশি মনে বাড়ি আসি। আমার হাসি মুখ দেখে বলেন, ‘মা’ তুমি যাকে পেতে চাও তার সাথে কথা বলে ঠিকানা দাও। তোমাকে তার হাতে তুলে দিয়ে আমি মুক্তি পাই। 
সত্যিই মা রাণুকে নিয়ে এলো, আর রাণুর হাতে তুলে দিলো। রাণু লাল বেনারসি পরে বসে আছে। আমার আবেগ যে অসহায় লাগছে, এই দিনটা সবার জন্যেই। রাতে ভাবি-বোনেরা নিয়ে এলো। ঘোমটা পরা রাণুর মুখটা তুলি। রাণুর ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। ওকে নিয়ে বারান্দায় যাই, বাড়ির কাছে মেঘনার পানিতে কে যেনো ছিটিয়ে দিয়েছে হিরের গুড়ো। প্রকান্ড চাঁদ জ্যোৎস্নায় দূও থেকে দেখছিলো কৃত্রিম বিধি আর প্রকান্ড গাছেরা মাথা নাচিয়ে সম্মতি জানাচ্ছে কিভাবে একে অপরকে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওরা কিভাবে পূর্ণতা পাচ্ছে এই প্রেম। 

ঝিঁঝি পোকার গানে সচেতন হই। ফিরে আসি ঘরে। এসে দু’জনেই কথা বলতে থাকি। কথার যেনো শেষ হয় না! 
হঠাৎ রাণু হাত ধরে বলে- আজতো আমরা দু’জনই-দু’জনের। কথা দাও যদি কোনদিন সময় আসে, যেনো দু’জনই এভাবে চলে যেতে পারি না ফেরার দেশে। কত কথা ভবিষ্যতের, কথার আর শেষ নেই। একটু গড়াতেই জানালার দিকে তাকাই, জ্যোৎস্নার আলো চলে যাচ্ছে। মসজিদের আজানের সুর, উল্টোদিকে মন্দিরের ঘণ্টার আওয়াজ, কুলু বধূদের শাঁখের আওয়াজ, কুয়াশা একটু একটু করে সরে সরে যাচ্ছে! পশ্চিমের আকাশ ধীরে ধীরে ভরে উঠছে ধূপছায়ার রঙে। সিঁদুরের টিপের মতো সূর্যটার নিটোল গোলকৃতিতে ভোরের বেলায় সেই আলো একটু একটু দৃশ্যমান হচ্ছে জগৎ সংসার। আমি এবার সংসারে পা দেই। ভুলে যাই আবেগময় যৌবন, যৌবনের স্বাদ আহ্লাদকে ভুলে যাই। ডুবে যাই জীবনযুদ্ধে, আশা আর ভালোবাসা থাকুক অন্তরে। 
রাণু ভরিয়ে দেয় আমার নতুন জীবন। সবকিছুই নতুনভাবে ভাবতে ভালো লাগে। আমার ক্লান্তিময় জীবনে রাণুর হাসি মুখ দেখে।

রাণু আজ হাসি মুখে কানে কানে বলে, তুমি বাবা হতে চলেছো। শুনে আমি নিজেকে কুর্নিশ করি, আমার পুরুষত্বকে। রাণুর ছন্দে-আনন্দে ভরে ওঠে আমার জীবন। 
রাণু ব্যস্ত থাকে, কাছে ডাকলে পাই না। সন্তান নিয়ে নিজের জগৎ। রাণুকে কাছে না পাওয়ার অভিমান হয়। তবুও খুশি বাচ্চার হাসি-কান্না ছোটাছুটি কলরবে বাড়িময় ভরে ওঠে। সংলারের এই সুখটুকুর জন্য কত যুদ্ধ, মিথ্যাচার, প্রবঞ্চনা, বিবেক দংশন। মনে মনে হাসি। হাসিটুকু নিয়ে বাড়ির বাইরে যাই। পথে যেতে যেতে মনে হলো মুখটা মলিন, শুধু বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় কত যুগ বাচ্চাদের দেখো নাই। 
সারাদিনের ক্লান্তি গুটিয়ে সে আমার পাশে বসে আলতো করে আমার হাতটা টেনে নিয়ে বলে, কিছু বলবো? বলো, এত সংকোচ কেনো? 
একদিন বলেছিলাম, যদি ওপারের ডাক আসে, তবে যেনো আমরা দু’জনেই এক সাথে যাই। তাতো বলেছো, আমার মনে আছে।

না আজ অন্য কথা বলি, যদি আমি আগে যাই, আমার সন্তানদের মায়ের আদর দিয়ে বড় করো। আর তুমি আগে যাও, তোমার স্নেহ-মায়ায় গড়ে তুলবো। 
রাণুকে বলি, তুমি এসব কি বলছো? তোমার সন্তান তুমি মানুষ করবে। আরেকজন আসছে। তোমার কি হলো? রাণুর চোখ ছল-ছল করে, আমার খুব ভয় করছে। কিসের ভয়? তোমাকে হারাবার ভয়, সন্তানদের হারাবার ভয়। এসব কি বলছো! তুমি বুদ্ধিমতি। যথেষ্ট বুদ্ধি, মন থেকে ভয় তুলে নাও। ভয়কে জয় করো। সব ভয় জয় করা যায় না। ভয়ের কাছে পরাজিত হতে হয়। 

রাণুকে হেসে বলি, তোমার সোনার তরী কোন ঘাটে ভিড়াবো আমি। রাণু থামতে চায় না। তোমার বয়স হবে, ধীরে ধীরে চোখ ছানি পড়বে, জড়া-ব্যাধি জেঁকে বসবে। যৌবনে যারা ঘিরে রেখেছিলো, তারা হয়তো কাছে আসবে না। 

রাণুকে বুকে নিয়ে বলি, আমার সবই তোমার। আমাকে দুর্বল করো না। আস্তে হাতটা আমার হাতে দিয়ে বলে, তাইতো তোমার কাছে রেখে গেলাম আমার গোছানো সংসার। কখন যে নিদ্রাদেবী চোখের পাতায় নেমে এলো, বুঝতে পারিনি। 
আচমকা জেগে দেখি রাণু বিছানায় নেই। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি পায়চারী করছে। ওর কাঁধে হাত দেই, চমকে ওঠে। ভোরের স্নিগ্ধ সকাল। সকালের উজ্জ্বলতা নেই। অসময় আমার মনে অজানা সংকেত। তোমার কিসের এতো ভয়? তুমিতো অবুঝ নও। মনকে শান্ত করো। কিসের ভয়? 
রাণুর চোখ দুটি ছলছল করছে। তুমি নাস্তা করে নাও। যেতে হবে কোথাও? আস্তে করে বলে, হাসপাতালে। চমকে উঠি! পায়ে পায়ে গিয়ে সার্টটা হাতে নেই। আগে নাস্তা করো, পরে চলো। 

রাণুর হাতের নাস্তা খাওয়াই বুঝি শেষ খাওয়া। বাচ্চাদের কাছে ডেকে বলে, তোমরা ভালোমতো থাকবে। বাবার কথা শুনবে। 
আমি একটু অস্বাভাবিক হই। গুরু-গুরু মেঘ ডাকার মতো অসময়ে মেঘ জমলো মনের কোণে। রাণু কেনো এ রকম করছো? 
বাচ্চারা সাথে যেতে চাইলো। বাচ্চাদের বলি, তোমরা দাদিমার সাথে থাকো। মাকে বিকালেই বাড়ি নিয়ে আসবো। 

রাণুর এ যাওয়াই শেষ যাওয়া। শেষ যাওয়া বুঝতে পারিনি। রাণু বুঝেছিলো। গাড়িতে উঠতে গিয়ে বাড়িটার দিকে বারবার তাকালো, কিছু যেনো ফেলে যাচ্ছে!
হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে দিয়ে বাইরে বসে আছি। একটু পরে সিস্টার এসে বলে ছেলে হয়েছে। রাণু কেসন আছে? রাণুর কাছে যাই, দেখি রাণু আমাদের মাঝে নেই! নিথর দেহটা বিছানায়। রাণু আমার কাছে রেখে যায় গোছানো সংসার, আর সন্তানদের। ছোট বাচ্চাটা ফুপুর কাছে দিয়ে বলি, মা-হারা ছেলেটাকে তুমি রাখো। 

রাণুকে নিয়ে চার প্রহরীর কাঁধে করে রেখে আসি হাজার মৃত্যুর যাত্রীর সাথে। মনে মনে বলি, তোমার সমাধিতে বিছিয়ে দেবো হাজার ফুলের তারার মালা। অশান্ত মনটাকে কিছুতেই শান্ত করতে পারি না। সন্তানদের বুকে নিয়ে নিজের দুঃখ ভুলে যাই। মনে হয়, যাকে ধরে নিয়ে এলাম, তাকেই রেখে এলাম শবযাত্রীদের কাছে। বিধাতার কি খেলা! 
সংসারে কিছুই থেমে থাকে না। সময়ের গতিতে চলতে থাকে। সুঃখ-হাসি-কান্নরা মাঝে গড়ে তুলি রাণুর সন্তানদের। এক এক করে সবাই বড় হয়ে গেলো। অনেক রাত কেটে গেলো। মাঝে ঘুম ভেঙে যায়। খারাপ লাগে। ফেলে আসা অজস্ত্র মধুর স্মৃতি লেপ্টে আছে মনের মধ্যে। স্মৃতি নিখুঁত, সত্য হারাতে পারি না। আমার স্মৃতিতে ভালোবাসার আবরণ দিয়ে। সে অনেক অনেক গোটা কথা শরীরজুড়ে। এত বছর ধরে জমানো কথা পাথর হয়েছে, শোনার কেউ নাই। সবাই যে যার মতো ব্যস্ততায় থাকে। রাণু মনের বাসায় জায়গা করে রেখেছে। নানা স্মৃতি ভুলতে পারি না। ভোলা যায়?

আজ আমার কি হলো? নিজের মনকে প্রশ্ন করি- রাণুর কাছে দেয়া কথঅ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। কৃপণতা করিনি। আজ আমি পরাজিত সৈনিক। মেরুদণ্ডহীন নাবিক। বুড়ো হয়েছি। এই ঘুঁনে ধরা সমাজে বুড়োরা অবাঞ্ছিত। অবহেলিত, সংসারে বোঝা। সংসার নামক কথায় খুব কষ্ট দেয়। সত্য বড় নিষ্ঠুর, কসাই। কাউকে যেনো বুড়ো হয়ে বাঁচতে না হয়। পৃথিবীটা বুড়োদের জায়গা নয়। বুড়োরা তো সন্তানের বাবা, মা ছিলেন। আজ সন্তান-সমাজ সবাই দূরে ঠেলে দিয়েছে। এখন আর পাশে কেউ নেই। তাই বলি বৃদ্ধাশ্রম তাদের জায়গা। বৃদ্ধাশ্রমে ভালো লাগবে। মনের দুঃখের কথা বলতে পারবে। তাই বলি, বাতাস লেগে কেউ বুড়ো হয় না। পৃথিবী যতদিন থাকবে, বাতাসতো থাকবে চিরদিন। কিন্তু বুড়োরা থাকবে না।

কমেন্ট বক্স