জাহানারা ইউসুফ :
অনেক আশা নিয়ে এসেছি আমেরিকা,
ছেলেমেয়ে মানুষ হবে পেয়ে উচ্চ শিক্ষা-দীক্ষা।
পরবে শার্ট, কোর্ট, টাই; বদলে যাবে বেশভূষার পুরোটাই।
পরবো না বাঙালি পোষাক লুঙি শাড়ি,
ভুলেই যাবো ছিলো দূর ছোট এক অজ পাড়া গাঁয় মোর বাড়ি।
যেখানে নিত্য দৈন্য, নিত্য সুখের ছিল যাতায়াত।
যেখানে অল্পতে খুশি অল্পতে হাসি, সুখদুখ ছিল পাশাপাশি,
ছেলের দিকে চাহি মায়ের অন্তর ওঠে কাঁদি,
আশা ছিল চেয়ে মস্ত বিদ্যান হবে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ডিঙিয়ে।
বলবে ইংরেজি, গর্বে মার বুক উঠবে ভরি।
বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়ের কোন অঙ্গনেই পা পরে নাহি।
স্কুল ফাইনালের পর পরই লেখাপড়া দেয় ছাড়ি।
কোন আশায় দিয়েছিলাম বিদেশ পাড়ি?
ছেলে মানুষতো হয়নি, হায়েনা বললেও ভুল, হবে অপ্রতুল।
পোশাকেও অদ্ভুত, প্যান্ট পরে নিতম্ভের উপর,
দেখে মনে হয় এই বুঝি খসে পড়ে!
কান দুটো করেছে ফুটো, এফোঁড় ওফোঁড় পেনি সমান বৃত্তাকার।
নাকে পরেছে বালি করে স্বেচ্ছাচার।
মাথার চুল নেমেছে কাঁধ ছাড়ি।
হিপপ গান শুনে, দুরে দুলে বাবরি চুল ঝাঁকিয়ে মাথা নাড়িনাড়ি।
সময় সময় চুল বাঁধে আফ্রিকান স্টাইলে, করে সরু সরু বেনুনি।
বন্ধুরা কয় মাঝে মাঝে নাকি বুঁদ হয় গাঁজা টানি টানি।
দুঃখ শুধু আমার একার নয়, আরো অনেককেইÑ
আমার চেয়ে বেশি দুঃখ সইতে হয়।
রেনুর মেয়ে বেনু, সে নাকি হবে মডেল।
লেখাপড়ার পাট চুকিয়েছে। বন্ধুবান্ধব জুটিয়েছে ঢের।
বাঙালি পোশাক মানায় না তারে।
তাই সে মর্ডান পোশাক ধরেছে, পাশ্চাত্যের অনুকরণে।
লোকাট প্যান্ট পরে উরুর উপর কাটা আয়তাকারে।
কখনও হাঁটুর অংশ কাঁটা, কখনও পাদুটো পুরোটাই কেটে
লেংটিসম বানিয়ে পরে। স্কার্টও তথৈবচ।
টপস্ পরে স্লিব্লেস বক্ষবন্ধনীর মত ছোট্ট গেঞ্জি।
বগল, উদর বেলি বাট্টন সবই করে প্রদর্শন।
লেখাপড়ার পাট চুকিয়েছে, কাজ নিযেছে গ্রোসারিতে।
রুমমেট সাথে নিয়ে বাসা ছাড়ে, ভালো লাগে না পরিবারে।
শিখেছে ধূমপান, চিনেছে পার্টি ক্লাব, হয়েছে রঙিন পানিয়ে আসক্তি
সভ্যতার এ দৌড় কোথায় নিয়ে চলেছে কে জানেÑ সামনে, না পিছনে?
কবির সাহেবের সোনার টুকরো ছেলে, মেধায় বিদ্যায়Ñ
কেউ পারে না তাকে ফেলতে পিছনে।
তাকে নাকি ধরেছে ডিজিটাল ডিভাইসের ডিপ্রেশনে।
কিসে কি হলো, পড়াশুনা ছেড়ে নেশা ধরলো।
জুয়াও ধরেছে সঙ্গ দোষে। ও নেশা খায় না
নেশায় ওকে খায়, নেশা দিরে চাড়া, কাঁপে ওর শরীর,
হাত-পা কেটে করে রক্তাক্ত। এমনি করে নেশা দেয় ওকে তাড়া
বস বুঝতে পেরে করলো চাকুরি ছাড়া।
নেশার বন্ধু ভারী শক্ত জুটি, ওরা ইবলিশ শয়তান।
পয়সা না পেলেও বন্ধু দু’চারদিন দেবে নেশার জোগান।
এমনি এক সুহৃদ বিদেশিনী চলে আসে কবিরের বাড়ি,
ওর ছেলের হাত ধরি, সম্মান বাঁচাতে-
ওদের বিয়ে দেয় মৌলভী ডাকি।
বাবা-মার স্বস্তি মেলে- সোজা পথে ফিরবে এবার ছেলে,
পোড়া কপাল! এক সন্ধ্যায় মা দেখে, নেশা করছে ওরা দু’জনে মিলে!
কবিরের ভাঙে ধৈর্য্যরে বাধ।
ছেলেকে ডেকে শাসায়, আমেরিকা এসে-
আমাদের মেরুদণ্ড খাঁড়া করে দাঁড়াতে, পুড়াতে হয়েছে কত খড়-কাঠ।
বুঝতে দেইনি কোন অভাব, পূরণ করেছি, সব চাহিদা সব আবদার।
শুধু এতটুকু আশায়Ñ তুমি মানুষ হয়ে মুখোজ্জ্বল করবে আমার।
অনেক হয়েছে, এবার আমার বাসা ছাড়, যাও সেদিকে পারো।
ছেলে অনুনয় করে- কোথা যাবো, কি খাবো, চাকুরি নাই দু’জনেরই কারো।
আমি আর কতদিন বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবো।
এইতো বেশিরভাগ সংসারের চিত্র।
দু’চারজন পরম ভাগ্যবান; সন্তান তাদের লক্ষ্যে পৌছায়, এটাই উদাহরণ নয়।
জীবনের প্রয়োজন পূরণের সহজ লভ্যতায়
অনেকেই চলেছে প্রবাহে গড্ডলিকায়।
আমেকিরা সবাই এসেছে নিয়ে বুক ভরা অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা।
অনেকেরই স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে, হতে হয়েছে আশাহত।
আশাগুলো দূরাশায় হয়েছে পরিণত।
মিছেই সবাই হয়েছে সোনার হরিণের প্রত্যাশী।
ছেড়েছে স্বদেশ, প্রিয় পরিজন, হয়েছে সুদূর প্রবাসী।
ইচ্ছে হয় ফিরি সেই ছোট গাঁয়, হায় ফেরার উপায় নাই।
জাকিয়ে বসেছি এথায়।
প্রতি মাসে দিতে হয় বাড়ির লোন, গাড়ির লোন,
দিতে না পারলে হবে দ্বিগুণ।
তবুও, একটুখানি আছে সুখ, একটুখানি বেঁচে আছে আশা,
খেয়ে পড়ে আছি বাঁচি, অসুখে পাচ্ছি চিকিৎসা-
চড়ে বেড়াচ্ছি গাড়ি।
বৃদ্ধকালেও হবো না, এসব ছেলেমেয়েদের দায়,
যাবো নার্সিং হোম, বাঁচাবে সরকার তার নিজস্ব ভাতায়।