শাওন আসগর
তিন বছর হয়ে গেল এখানে থাকছি, এই মেসে আরো ছয়জন। অথচ কখনো চোখে পড়েনি ঐ লাল বাগানবিলাস পুষ্প গাছটি। আগে জানতাম এ ফুলগাছের উচ্চতা চার-পাঁচ ফুট হতে পারে, কিন্তু এটি কী করে অত দূর উপরে উঠে এলো?
সকালে বৃষ্টি হয়ে গেল বেশ। বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাচ্ছি পাশের জানালায়। বৃষ্টি শেষ হলে উঠে বারান্দায় দাঁড়াই। তিন তলার বারান্দা। পূবের বারান্দা এটি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে গ্রিল ধরে পূবের আকাশ দেখিÑ মেঘাচ্ছন্ন। বৃষ্টির জলে পাশের প্রশস্ত রাস্তাটিকে ধুলোবালিমুক্ত সাফসুতরো লাগছে। এই বারান্দা থেকে দুশো গজ পূব-উত্তর পাশে কুঞ্জবীথি ও সান্ত্বনা অ্যাপার্টমেন্টের মেইন গেইট। বড় করে নামফলক লেখা। এখন অবশ্য তা দেখা যাচ্ছে না। শুধু দেখা যাচ্ছেÑ বীথি ও অ্যাপার্টমেন্ট। বিশাল আমগাছের শাখা-প্রশাখায় আড়াল হয়ে পড়েছে অ্যাপার্টমেন্টের নামফলকটি।
অনেক আম ধরেছে গাছটিতে। মাঝে মাঝে প্রবল বাতাস এলে ঝরে পড়ে কিছু আম, তখন পথচারীরা কুড়িয়ে নেয়। হুড়মুড় করে কোথা থেকে যেন একদঙ্গল কিশোর বালক উপস্থিত হয়, আমগাছে ঢিল ছুঁড়ে আরো কিছু হাতবন্দি করে পালিয়ে যায়। তো আমি আমার কাছের প্রথম আমগাছটির দিকে তাকাই। এখানে তেমন নেই। দ্বিতীয়টিতে আছে কিছু, কিন্তু শেষ গাছটি জুড়ে অনেক আম। ঝুলে আছে থোকা থোকা কাঁচা সবুজ রঙের আম। পাতাগুলো এখনো সবুজ আর একটু আগে বৃষ্টি হবার কারণেই পাতাগুলো কিশোরীর মতোই প্রাণবন্ত উতল হাওয়ায় ভাসছে পথের ওপর।
অবাক হই এই অত উঁচু আমগাছটির ভেতর মাথা উঁচু করে উঁকি দিয়ে আছে লাল ফুল! কী করে সম্ভব? তবে কি ভুল কিছু দেখছি? ঘুমভাঙা চোখে কোনো সমস্যা হলো না তো? কয়েকবার তাকিয়ে খেয়াল করি, হা তাই তো, এই উঁচু আমগাছের শাখা-প্রশাখায় অনেক লাল ফুল ও ফুলগাছের শাখা জড়ানো। বাগানবিলাস অত বড় হয়। এই লাল আর সবুজের রং আমাকে মোহিত করে।
নিচে তাকাতেই খেয়াল করি ঝট করে একটি লাল রঙের প্রাইভেট কার ছুটে যায় পূর্ব দিকে, কটকটে লাল আমার পছন্দ নয়। অবাক করা কাণ্ড যে, আমি অনেকক্ষণ পথ চলতি মানুষের দিকে তাকাতেই খেয়াল করি একজন লোক সাইকেল চালিয়ে হয়তো অফিসে যাচ্ছে, তারও গায়ের শার্টটি লাল।
একটু পর খেয়াল করি বেশ টগবগে এক যুবক ও এক যুবতী পাশাপাশি হাঁটছে পথের উত্তর পাশে। ওরা রিকশার গ্যারেজটি বাঁয়ে রেখে যেতেই চোখে পড়ল ওরাও লাল পোশাক পরে আছে। আজ কি তবে লালের সমারোহ চারপাশে? কোনোদিন খেয়াল করিনি, আমার অপজিট দোকানে ‘বাংলা লিংক’-এর সাইনবোর্ড লাল, বিকাশের ব্যানারটি লাল, আওয়ামী লীগের একজন নেতা ঈদের শুভেচ্ছা সংবলিত পোস্টার করেছে তাও লাল। আজ এমন হলো কেন, আমার চোখে লাল আর লালের রং চমকাচ্ছে।
লাল তো রক্তের প্রতীক। মাঝে মাঝে লাল শোকেরও চিহ্ন, কখনো কখনো সুখেরও হয়। এসব ভাবতে গিয়েই তখনো বারান্দা ছেড়ে আসিনি। জুথিকে মনে হলো, তিন বছর হলো সে আমাকে ত্যাগ করেছে। দেয়ালের ওপারেও সে তৈরি করেছে বিশাল প্রতিরোধ ব্যুহ, যেন আর কখনো নিজের গড়া বাড়িতে উঠতে না পারি। মহল্লাকে কব্জা করেছে, সন্ত্রাসীদের জানিয়ে রেখেছে আমার কথা। সে রয়েছে আমাদের সন্তান বেষ্টিত। তাদের বোঝানো হয়েছে সংসারের প্রতি আমার ব্যর্থতা, অমনোযোগিতা ও চারিত্রিক দুর্বলতা।
আর সারা দিনের জন্য জুথি বাইরে গেলে যে এই আমিই সন্তানদের উৎপাত সয়ে গেছি, ওদের কাপড় পরানো, গোসল করানো, খাওয়ানো, দেয়ালের কাঠপেন্সিলের দাগ সাফ করা, মুখ থেকে গলে পড়া আইসক্রিম মুছে দেওয়া- সব আমিই করেছি। খুঁজে খুঁজে ওষুধের পাতা সঠিক স্থানে রাখা, বিদ্যুৎ বিলের কপিটা ঠিক করে রাখা, গ্যাস আর পানির বিল সময়মতো ব্যাংকে গিয়ে পরিশোধ করা- সবই আমার হাতে ন্যস্ত ছিল। পথের পাশে ঘর ছিল বলে সারাদিনে অন্তত দুবার ঘরের ধুলোবালি পরিষ্কার করা সেটাও আমাকেই করতে হতো। অবসর নিয়ে বসতাম কবিতা বা গল্প লেখায়। তাতেই তার ছিল আপত্তি। রাতের বিছানায় সারাক্ষণ আমাকে নোংরা কথার জঙ্গলে ঠেসে রাখত।
যখন আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়তাম বা সংসার ছাড়ার উদ্যোগ নিতাম বা আত্মহত্যা করার ইচ্ছে জাগত, তখনো তাকে ছেড়ে আসার কথা মনে করিনি। কারণ তখন ছিল আমাদের সন্তানদের জীবন তৈরি করার উপযুক্ত সময়। জুথি ভোর হলেই চলে যেত কিন্ডারগার্টেনে চাকরি করতে, তারপর নিজের পড়াশোনা ও হোমিও চিকিৎসার ক্লাস করার জন্যে। সেই যে সকালে বের হতো, আর ফিরে আসত রাত দশটায়। এভাবে দিন-মাস অনেক বছরই আমিই সন্তানদের বুকে করে কাছে রেখে বড় করেছি। অথচ জুথি তারপরও আমাকে সন্তানদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিলো। নিজের নারীত্বকে অসম্মান করে পৃথিবীর সব কবিকেই জুথি চরিত্রহীন বানানোর চেষ্টায় ব্যস্ত থাকল। এবং এই পর্যন্ত মজবুত দেয়ালটি সরাবার কোনো চেষ্টাই সে করল না।
কয়েকটি রিকশা যাচ্ছে-আসছে। কোনোটায় যাত্রী আছে, কোনোটায় নেই। যেটায় নেই, সেসব রিকশার হুড ফেলে দেওয়া, ফলে সিট দেখা যাচ্ছে। প্রায় সবগুলো সিট কভারই লাল। আর নয়। এবার ঘাড় ঘুরিয়ে চলে আসব, দেখি লাল রঙের ‘সিঙ্গার’ লেখাটি! বেশ প্রশস্ত ও গাঢ় করে লেখা ঐ চারতলার বাড়িটির দ্বিতীয় তলার সামনের দেয়ালে। সিঙ্গারের যে দোকানটি দোতলায়, তার নিচেই রয়েছে রিকশা ও সাইকেলের পার্টস বিক্রেতার দোকান। ওখানেও লালচে কালারের টায়ার টিউব ঝোলানো।
চলে আসব রুমে, তখনই চোখ পড়ল পথের পূর্ব পাশ থেকে এদিকে এগিয়ে আসছেন একজন মহিলা। বুকটা ধক করে উঠল। অবিকল জুথির মতো। বয়স বেড়ে গেলেও চেহারায় বদল হয়নি। তার তো এখানে আসার কথা নয়। তিন বছর যে আমার কোনো খবর নেয়নি, সে কেন আসবে? নিজেকে একটু আড়াল করে পরখ করার দৃষ্টিতে দেখি বারবার কয়েকবার।
নাহ, সেই মহিলা আমার এই ব্যাচেলর বাসস্থান অতিক্রম করে চলে যায়, যার গায়ের ওপরের পোশাকটিও ছিল লাল। আজকের এসব লাল আর লালের মধ্যেই হঠাৎ মনের দেয়াল ভেঙে মনে হলো যেদিন জুথিকে নিয়ে ঘর সাজালাম সেদিন প্রথম রাতটিও ছিল সুখের। কারণ সে-রাতের আকাশের চাঁদ হয়তো উজ্জ্বল আলো ছড়িয়েছিল, আর জানালায় চাঁদের আলো পড়তেই খেয়াল করেছিলাম আমাদের বিছানার চাদরটি বাগানবিলাসের মতোই ছিল ছোপ ছোপ লাল আর লাল। মাঝে মাঝে লাল হয়তো সুখেরও প্রতীক হয়।