Thikana News
২১ নভেম্বর ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

স্মৃতিতে মাওলানা ভাসানী

স্মৃতিতে মাওলানা ভাসানী
আমাদের ছেলেবেলায় নেতারা ছিলেন ত্যাগী। সে সময় নেতারা সব সময় ছিলেন মানুষের পাশে। তাদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ ছিল অনেক উঁচুতে। যে সময়ে আমাদের জন্ম, সেই সময়ের একজন বড় নেতা ছিলেন মওলানা ভাসানী। আজকে মওলানা ভাসানীর জন্মদিনে হঠাৎ করে একটা স্মৃতির কথা মনে পড়ল।
মওলানা ভাসানীকে সব দলের, সব গোত্রের, সব ধর্মের লোক পরম শ্রদ্ধা করতেন। মওলানা ভাসানী ছিলেন আজকের আওয়ামী লীগের জন্মদাতা। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ তৈরি করেন মুসলিম লীগ থেকে বের হয়ে। তাই পরবর্তী সময়ে মুসলিম নামটা বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নাম নিয়ে দাঁড়ায়। তিনি আওয়ামী লীগের স্রষ্টা। সে সময় তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট। জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন টাঙ্গাইলের শামসুল ইসলাম। যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মোশতাক। পাকিস্তানের জন্ম ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৭ সালে। তিনি বুঝেছিলেন যে তাদের সঙ্গে থাকা চলবে না। তাই কাগমারী সম্মিলনে তিনিই প্রথম পাকিস্তানিদের বলেছিলেন, আসসালামু আলাইকুম। লাকুমদি নুকুম ওয়ালিয়াদিন। অর্থাৎ তুমি তোমার মতো থাকো আর আমাদেরকে আমাদের মতো থাকতে দাও।
কিন্তু সেদিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা সোহরাওয়ার্দী। তিনি তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি পাকিস্তানিদের পক্ষে ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পূর্ববঙ্গকে ৯৫ ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছে। তাই এ দাবি অমূলক। এর পরিপ্রেক্ষিতে সেই সময় মওলানা ভাসানী রাগ করে বের হয়ে আসেন ও ন্যাপ তৈরি করেন। এই জননেতার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ ছিল অপরিসীম। যখনই মওলানা ভাসানীর মিটিং হয়, আমি সেখানে গিয়েছি, যদি আমার যাওয়ার সুযোগ থাকত। আমি কখনো মিস করিনি। তার কথা আমার খুব ভালো লাগত।
সময়টা ১৯৭২ সালের জুন/জুলাই মাস। আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফার্স্ট ইয়ার স্টুডেন্ট। সেই সময় উনি অসুস্থ হয়ে ঢাকার পিজি হসপিটালে ভর্তি হলেন। পিজি হসপিটাল জাস্ট কয়েক মাস আগে ঢাকা মেডিকেলের ক্যাজুয়ালিটি (পুরান ঢাকার ইউনিভার্সিটি কলা ভবন) থেকে পিজি হসপিটালে স্থানান্তরিত হয়েছে। তার আগে পিজি হসপিটাল ছিল শাহবাগ হোটেল। আমার বন্ধু নাজিম টাঙ্গাইলের ছেলে ও মওলানা ভাসানীকে খুব পছন্দ করে। আমরা রুমমেট। তো আমরা দুজন মিলে তাকে পিজি হসপিটালে দেখতে গেলাম। তখনো হসপিটাল হিসেবে পিজি গড়ে ওঠেনি। হোটেল রুমগুলো কেবিন বানিয়েছে। গিয়ে দেখলাম, ওনার রুমে তালা দেওয়া। ওনার রুমে তালা দেওয়ার কারণ ওনার এত ভিজিটর আসে যে উনি কোনো রেস্ট পান না, সেই জন্য। ওনার রুমে তালা দিয়ে রাখা হয়েছে তাতে কী। উনি কাউকে নিরাশ করতে রাজি নন। তাই উনি জানালা খুলে দিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলছিলেন। তো ওনার রুমের সামনে গিয়ে দেখি বিরাট জটলা। ৫০-৬০ জন লোক অপেক্ষা করছে দরজার বাইরে। উনি ওনার স্বভাবসুলভভাবে অনর্গল কথা বলে চলেছেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, দুর্ভিক্ষ সবকিছু। এরপর মুক্তিযুদ্ধে ওনার ইন্ডিয়াতে থাকার অভিজ্ঞতা। শুনতে ভালোই লাগছিল। তাই আমরা দুজনই সামনে চলে এসেছিলাম। এত কাছে থেকে প্রিয় নেতাকে দেখার এক্সাইটমেন্ট। এর মাঝে প্রসঙ্গ চেঞ্জ করে যে দেশের কী অবস্থা, দেশে কী হচ্ছে, কী করতে হবে ইত্যাদি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উনি শুধু একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন না, উনি অনেকের কাছে ছিলেন পীর বাবা। টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও সিরাজগঞ্জ এলাকায় ওনার অনেক মুরিদ আছে। তাই মাঝে মাঝে উনি ব্রহ্মপুত্র নদীতে নৌকাভ্রমণে বের হতেন। তখন মানুষের খুব কাছে যেতে পারতেন এবং তাদের সুখ-দুঃখ সম্পর্কে অবহিত হতেন। উনি বললেন, দুদিন আগে জহুর এসেছিল। সে এসে বলল, ‘হুজুর, আমি ৩০ হাজার শ্রমিককে ঈদের বোনাস দিয়েছি।’
সে সময় চিটাগাংয়ের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্বাস্থ্য ও শ্রমমন্ত্রী ছিলেন।
-তো আমি বললাম, খুব ভালো করেছ। কিন্তু ৬৫ হাজার গ্রামের কৃষককে কী দিয়েছ? আমি দুই সপ্তাহ আগে ব্রহ্মপুত্রের চরে গিয়েছিলাম। মানুষ অভাবে কচু সেদ্ধ করে খাচ্ছে। তাদের জন্য কী করলে?
কথা বলতে বলতে হঠাৎ আমাদের দিকে নজর পড়ল।
আমি ও নাজিম দুজন খুবই কেতা দুরস্ত ছিলাম পোশাকে। হঠাৎ করেই প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলা শুরু করলেন।
Ñআমি কলকাতায় ছিলাম মুক্তিযুদ্ধের সময়। দেখলাম, এদের মতো ছেলেরা বাপের কাছ থেকে পয়সা নেয় না। নিজের উপার্জনে লেখাপড়া করে। ওদের ইউনিভার্সিটিতে পড়া ছেলেমেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হকারি করে, বিভিন্ন জিনিস ফেরি করে বিক্রি করে।
আর আমাদেরকে দেখিয়ে বললেন, ‘এদের দেখো। ফুল বাবু। বুঝলে, ওদের কাছে শেখো।’
খুব লজ্জা পেলাম।
সে কারণে জটলার পেছনে লুকানোর চেষ্টা করলাম। পেছনে ফিরেই দেখি, আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন মশিউর রহমান সাহেব (যাদু মিয়া)। উনিও শুনছেন এবং মিটিমিটি হাসছেন।
তারপর ১৯৭৬ সালের নভেম্বর মাস। আমাদের শেষ পরীক্ষা অর্থাৎ ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষা চলছে। হঠাৎ শুনতে পেলাম মওলানা ভাসানী খুব অসুস্থ, কেবিনে ভর্তি।
কেবিনের শেষ মাথায় ৯ নং কেবিন, যেটা ভিআইপি কেবিন নামেই পরিচিত। দৌড় দৌড় দৌড়। দেখলাম, হুজুর খুব অসুস্থ। আমি প্রতিদিন হুজুরকে দেখতে যেতাম। শুধু আমি না। দলমত-নির্বিশেষে সবাই আসছে, হুজুরের জন্য দোয়া করছে। অবশেষে ১৭ নভেম্বর ৯৫ বছর বয়সে হুজুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ভারত কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষার যুক্তি দেখিয়ে ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণ করে। ফলে বাংলাদেশে এর বিরূপ প্রভাবে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ মরুভূমি হয়ে যায়। তাই তার মৃত্যুর ছয় মাস আগে ১৯৭৬ সালের ৬ মার্চ তিনি লক্ষাধিক লোক নিয়ে ঢাকা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক লংমার্চের নেতৃত্ব দেন।
যারা আওয়ামী লীগ করেন কিংবা ছাত্রলীগ করেন, তাদের জন্য বলছি। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর মাস। বঙ্গবন্ধু তখন আগরতলা মামলায় জেলখানায়। আইয়ুব খান তাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানোর সব ব্যবস্থা পাকা। তখন দেশের অবস্থা শান্ত। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। কোনো মিছিল নেই, কিছু নেই। সেই সময় নরসিংদীর শিবপুরে কৃষকেরা হরতাল করাতে গুলি হয় এবং সেখানে দুজন মারা যায়। সে জন্য উনি বায়তুল মোকাররমে গায়েবানা জানাজা পড়তে যান। পুলিশের বাধার তোয়াক্কা করলেন না। উনি ওইখানে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়লেন। এইখান থেকে যে গন্ডগোল শুরু হলো, তা দাবানলের মতোই সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ল। এটিই পরবর্তী সময়ে ১৯৬৯ সালের সর্বদলীয় ছাত্র আন্দোলনে রূপ নেয় এবং সেই আন্দোলনের ফলে শেখ মুজিব জেল থেকে ছাড়া পান। মনে রাখবেন, সেদিন সেই আগুন জ্বেলেছিলেন এই মওলানা ভাসানী।
আরও একটা জিনিস এখানে বলে রাখা ভালো। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মওলানা ভাসানীর দল অংশগ্রহণ করেনি। মওলানা ভাসানীর যুক্তি ছিল, যদি আমরা এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি, তবে স্বাধিকারের সপক্ষের শক্তি ভোট ভাগ হয়ে যাবে। বরং পাকিস্তানপন্থী দল যেমন মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী ২০-২৫টা সিট পেলেই আমরা আর মেজরিটি হতে পারব না। সেদিন মওলানা ভাসানীর এই দূরদর্শিতার জন্য আজ আমরা স্বাধীন।
-রলি, নর্থ ক্যারোলিনা

 
কমেন্ট বক্স