Thikana News
০৬ অক্টোবর ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫

স্মৃতির মণিকোঠায় কুয়াকাটা ভ্রমণ

স্মৃতির মণিকোঠায় কুয়াকাটা ভ্রমণ



 
‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।’
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বাড়ির খুব কাছের কোনো স্থান ঘুরে দেখার সময় আমাদের খুব কমই হয়ে থাকে। দেশ-বিদেশ কত ঘুরে বেড়ালাম অথচ নিজ জেলার খুব কাছের জায়গায় কখনো যাওয়ার অবসর আমাদের হয় না। তেমনি একটি জেলা আমার নিজ জেলা ভোলার পার্শ্ববর্তী জেলা পটুয়াখালী। সময়টা ২০১২। চাকরিকালীন পটুয়াখালীতে অনেকবার গিয়েছি কিন্তু সময় নিয়ে যাওয়া হয়নি সাগরকন্যা নামে পরিচিত পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটার সেই বিশাল সমুদ্রসৈকত দেখতে। বিশাল সমুদ্র, যার পাড়ে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। তাই দেশে গিয়ে ভাবলাম এবার কুয়াকাটায় ঘুরে আসি। ভোলা থেকে মাইক্রোবাসে সকাল সকাল রওনা হলাম। এক বন্ধু ফ্যামিলিও আমাদের সঙ্গে ছিল, তাই ভ্রমণটা হয়েছিল আনন্দের। ভোলা ইলিশা ফেরিঘাট থেকে ফেরি গিয়ে থামল লাহারহাটে। বরিশাল হাতেম আলী কলেজে পড়াকালীন লঞ্চে এই পথে ছিল আমার চলাচল। ভোলা থেকে লাহারহাট, সাহবের হাটসহ সব স্টপেজ ছিল মুখস্থ। তবে লঞ্চ থেকে কোনো সময় নামা হয়নি এসব এলাকায়। ফেরি থেকে গাড়ি লাহারহাটে উঠে আবার রওনা হলো। দেখতে পেলাম এখানে সদ্য প্রতিষ্ঠিত সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজ। লাহারহাট থেকে আমাদের গাড়ি ছুটে চলল কাউয়ার চরের উদ্দেশে বরিশাল কীর্তনখোলা নদী পার হওয়ার জন্য। অল্প সময়েই আমাদের গাড়ি পৌঁছে গেল কাউয়ার চরে। আমার কলেজবন্ধু নয়নের বাড়ি এখানে কর্ণকাঠি গ্রামে। কলেজ-জীবনের অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেল এই নদী দেখে। বরিশাল হাতেম আলী কলেজে পড়াকালীন এই নদী পাড়ি দিয়ে বরিশালে এসে নামতাম। তিন ঘণ্টা নদী পাড়ি দিয়ে ভোলা থেকে বরিশালে আসতাম। বরিশাল আমার অনেক প্রিয় শহরের একটি। একটা আলাদা আভিজাত্য আছে এ শহরের। একসময় বরিশালের নাম ছিল চন্দ্রদ্বীপ। সে সময়ে নিক্সন মার্কেট (মহসিন মার্কেট) থেকে অনেক কেনাকাটা করতাম। আর ঘুরে বেড়াতাম সারা বরিশাল শহর। ফেরিতে ওঠার অল্প কিছুক্ষণ পরই গাড়ি ওপরে উঠে গেল। মেইন রোডে উঠতেই দেখতে পেলাম বরিশাল সার্কিট হাউস, জিলা স্কুল, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ। মেডিকেল পার হওয়ার পরই গাড়ি বাঁয়ে মোড় নিয়ে সাগরদী পার হয়ে রুপাতলির দিকে ছুটতে লাগল। আমি শুধু জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে যাচ্ছিলাম এসব রোডে কলেজে পড়াকালীন সাইকেল নিয়ে কত ঘুরে বেড়িয়েছি। রুপাতলি ছিল আমার মামার শ্বশুরের বাসা। এসে প্রায়ই বেড়াতাম। রুপাতলি ফেরিঘাটে এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেল। 
গাড়ি ফেরিতে ওঠার পর আমরা হালকা কিছু খেয়ে নিলাম। ফেরি নদীর ওপারে পৌঁছাতে বেশি সময় নিল না। আমরাও তাড়াতাড়ি করে গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি রওনা হলো পটুয়াখালীর কুয়াকাটার উদ্দেশে। আমাদের হোটেল বুক করা ছিল আগে থেকেই। গাড়িতে বসে থেকে দেখতে লাগলাম দুই পাশে বয়ে যাওয়া নানা রকম দৃশ্য। কখনো ধানখেত আবার কখনোবা নারিকেল-সুপারির বাগান। সুন্দর অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা যখন সাগরপাড়ে চলে এলাম, তখন ঘড়ির কাঁটায় বিকেল পাঁচটা। আমাদের হোটেলটি ছিল সমুদ্রের কাছেই রাখাইন পল্লির ঠিক পেছনে। নাম ছিল নীলাঞ্জনা। আমরা রুমে পৌঁছেই ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলাম খাবার খাওয়ার জন্য। হোটেল থেকে একটু এগোতেই অনেক খাবারের হোটেল পেয়ে গেলাম। সামুদ্রিক রুপচাঁদা, চিংড়িসহ আরও অনেক রকম তাজা মাছ রান্না করা ছিল হোটেলগুলোতে। আমরাও ছিলাম প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত। তাই তাড়াতাড়ি করে খাবারের অর্ডার দিলাম। দেখেই বোঝা গেল, হয়তো এসব এলাকায় তেমন বেশি দিন নয় মানুষ দোকানপাট স্থাপন করে ব্যবসা শুরু করেছে। খাবার খেয়ে আমরা আবার রুমে ফিরে গেলাম ড্রেস চেঞ্জ করে সাগরপাড়ে যাওয়ার জন্য। তখন প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে সূর্য ডুবুডুবু। আমরা তাই তাড়াতাড়ি করে রুম থেকে চেঞ্জ হয়ে সাগরপাড়ে রওনা হলাম। হোটেল থেকে বেশি দূরত্বে নয়। মাঝখানে একটা রাখাইন মার্কেট। বিশাল সাগরের পাড়ে পৌঁছে আমরা সূর্যাস্ত উপভোগ করতে লাগলাম। কী বিশাল সমুদ্র। আর কী বিশাল তার গর্জন।
রাতে হোটেল ম্যানেজার আমাদের জন্য মোটরবাইক ও ড্রাইভার ঠিক করে দিল। সেখান থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে ঝাউবনের নিকট থেকে সকালবেলা সূর্য ওঠা দেখা যায়। আমাদের ভোররাতে উঠেই রেডি হয়ে থাকার জন্য বলল, যাতে সূর্য ওঠার আগেই আমরা সেখানে পৌঁছাতে পারি সূর্যোদয় দেখার জন্য। আমরা রাতের খাবার সেরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম। নীলাঞ্জনা হোটেলটি বেশ মনোরম। তাদের অভ্যর্থনা রুমটি গাছ আর নানা রকম ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলাম ভোর চারটায় যেন উঠে আমরা আস্তে ধীরে রেডি হতে পারি। আমাদের সাথের বন্ধু পরিবারটিকেও জাগিয়ে দিলাম রেডি হওয়ার জন্য। কথামতো কিছু সময় পর ড্রাইভার তাদের মোটরবাইক নিয়ে হোটেল লবিতে এসে হাজির হলো। আমাদেরকেও ইন্টারকমে নিচে নেমে আসার জন্য ডেস্ক থেকে জানানো হলো। বাইকে আমরা দুজন উঠে বসলাম। বাইক সাগরের পাড় দিয়ে চলা শুরু করল। মাটি ও বালুর মধ্যে চালানো ততটা সহজ নয় দেখতে পেলাম। যারা এখানে পেশাদারি সার্ভিস দেয়, তাদের পক্ষেই চালানো সম্ভব। এক পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে গ্রাম, গাছগাছালি আর আরেক পাশ দিয়ে বিশাল বঙ্গোপসাগর। কিছু সময় পরে আমরা ঝাউবনের কাছাকাছি এসে হাজির হলাম। একদম সঠিক সময়ে আমরা সেখানে আসতে পেরেছি। সমুদ্রের পানির নিচ থেকে মনে হলো লাল রক্তিম আভা উদিত হচ্ছে। সূর্য তখন তার আলোকরশ্মি ছড়িয়ে কিছুক্ষণ পরই উঠবে। চোখের পলক দেওয়া অসম্ভব হয়ে যাচ্ছিল সেই মুহূর্তটায়। শুধু তাকিয়ে দেখছিলাম কীভাবে সূর্য উদিত হতে যাচ্ছে। এর আগে এত কাছ থেকে সূর্যকে উদিত হওয়া কোনো দিন দেখিনি, যেটা এখানে এসে দেখতে পেলাম। জীবনের কিছু মুহূর্ত যদি মনে রাখার মতো হয়, তাহলে এটাও একটা মুহূর্ত ছিল। খুব ভালো লাগছিল লাল সূর্য উদিত হওয়া দেখতে পেরে। মনে হচ্ছিল, যেন পানির নিচ থেকে সে ভেসে উঠল। অনেক সময় দাঁড়িয়ে তা প্রত্যক্ষ করলাম। অনেক লোকের সমাগম হয় সেই প্রত্যুষে সূর্য উদিত হওয়া দেখার জন্য। বাংলাদেশের মধ্যে একমাত্র কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতেই সূর্য উদিত ও অস্ত যাওয়া দেখা সম্ভব। ঝাউবনে ও সমুদ্রের কাছে দাঁড়িয়ে কিছু ছবি নিয়ে সে সময়টাকে স্মরণীয় করে রাখলাম।
পরদিন আমাদের ফেরার পালা। কুয়াকাটায় অনেক উপজাতির বসবাস। তাদের মধ্যে রাখাইন বেশি। আমরা রাখাইন পল্লি ঘুরে দেখলাম। তাদের মার্কেট থেকে হাতে তৈরি জিনিস কেনাকাটা করলাম। এরপর আমরা রওনা হলাম পটুয়াখালীর পথে। আমার এক কাজিনের বাসায়। তখন কুয়াকাটা-পটুয়াখালীর রাস্তা ততটা ভালো না থাকায় গাড়ি একটু বেশি সময় নিল পৌঁছাতে। আমরা দুপুরের পর তাদের বাসায় পৌঁছালাম। তারা দুপুরের খাবারের বিশাল আয়োজন করেছে। খাবার খেয়ে বিকেল নাগাদ আমরা পটুয়াখালী শহর ঘুরে দেখলাম। এরপর বিকেলে বরিশালের উদ্দেশে রওনা হলাম। আমার কলেজবন্ধু দিপুকে ফোনে জানালাম আমাদেরকে ভালো একটা হোটেলের ব্যবস্থা করে দিতে। দিপু সাগরদী মেডিকেলের নিকট তার পরিচিত হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে আমাকে ফোনে জানাল। আমরাও এসে রাত নয়টার দিকে হোটেলে উঠলাম। ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেতে নিচের হোটেলে গেলাম। সে সময় আমার কামরুল মামা বরিশাল এয়ারপোর্টে চাকরি করেন। তাকে ফোনে জানালাম আমরা বরিশাল সদরে। মামা বললেন সোজা এয়ারপোর্টে চলে আসেন। কিছু সময়ের মধ্যে আমরাও চলে এলাম রহমতপুর এয়ারপোর্টে। আমার মনে আছে, এ এয়ারপোর্টটি যেদিন ঘোষণা করা হয়েছিল, সেদিন আমি আমার শহীদ আলমগীর ছাত্রাবাস বটতলা থেকে সাইকেল চালিয়ে রহমতপুর এয়ারপোর্ট উদ্বোধন দেখতে গিয়েছিলাম। এয়ারপোর্টের টাওয়ারে কন্ট্রোল রুম দেখে আমরা আবার রওনা হলাম উজিরপুরে বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত মসজিদ ঘুটিয়ার মসজিদ দেখতে। মসজিদটি নির্মাণ করেন স্থানীয় শিল্পপতি সরফুদ্দিন আহমেদ। অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় মসজিদের ভেতরে আর ঢোকা হয়নি। বাইরে থেকে দেখে আমরা আবার সাগরদী হোটেলের দিকে রওনা হলাম। সকাল হলে আমরা আমাদের ভ্রমণ শেষ করে ভোলায় নিজ ঠিকানায় আবার ফেরত যাব।
কুয়াকাটার সেই ভ্রমণস্মৃতি আজও আটলান্টিক পারের দেশ নিউইয়র্কে বসে মনে পড়ে। ইচ্ছা হয় আবার ছুটে যাই সেই কুয়াকাটা সাগরপাড়ে।

 
কমেন্ট বক্স




9