Thikana News
০৪ জুলাই ২০২৪
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪
বড়দের গোলমালে ছোটদের প্রক্সি ♦ গডফাদার ভারত-রাশিয়া

মার্কিন ব্যাক চ্যানেলে লোভাতুর বাংলাদেশ

মার্কিন ব্যাক চ্যানেলে লোভাতুর বাংলাদেশ
চলমান স্নায়ুযুদ্ধের বাইরেও বিশ্বের প্রায় ২৭টি দেশে যুদ্ধ বা যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান। কোনো কোনো যুদ্ধে সমরাস্ত্রের সঙ্গে অর্থনীতির উপাদান বেশি। কোথাও কোথাও বড়দের যুদ্ধের মধ্যে নাক-গলা ঢুকিয়ে ফেলছে ছোটরাও। কেবল নাকই গলাচ্ছে না, অ্যাক্টও করছে। পারফরম্যান্সও দেখাচ্ছে। বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কার মতো দেশও রয়েছে সেই শরিকানায়। এতে বড় রকমের ঝুঁকির বিপরীতে লাভবান হওয়ার আশা ছোট দেশগুলোর কারও কারও। সেই আশা বাংলাদেশের কিঞ্চিৎ বেশি। পূর্ব-পশ্চিমের উত্তেজনা ও রশি টানাটানিতে বাংলাদেশ এবং ক্ষমতাসীন সরকার ব্যাপক বেনিফিশিয়ারির স্বপ্ন দেখছে।
তাইওয়ানের সাম্প্রতিক নির্বাচনে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তেকে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়োকো কামিকাওয়ার ১৪ জানুয়ারির বিবৃতি নিয়ে ঘটেছে বিপত্তি। এর তীব্র বিরোধিতা করেছে চীন। এর মাত্র সাত দিন আগে বাংলাদেশের নির্বাচনকে দেশ দুটিই সমর্থন দিয়েছে, অভিনন্দন জানিয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধের এই সময়ে কে কখন কাকে অভিনন্দন বা নিন্দা জানাবে, আলামত বুঝে তা পাল্টে ফেলছে, তার নিশানা বা নমুনা বোঝা কঠিন। বিশ্বজুড়ে চীনা দূতাবাসগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেসব দেশ তাইওয়ানের ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি- ডিপিপিকে সমর্থন করবে, তাইওয়ানের পুনর্নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট লাই চিংকে অভিনন্দন জানানো বিদেশি সরকারগুলোর নিন্দা করতে।
চীনকে নিজ সীমানায় ব্যস্ত রাখার প্রচেষ্টা তাইওয়ানকে লিপ্ত করার আন্তর্জাতিক ও এশীয় খেলা চলছে। বেইজিংয়ের দৃষ্টিতে তাইওয়ান কেবলই একটা দ্বীপ। আর লাই চিংকে একজন ট্রাবলমেকার ও বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতাবাদী। তাইওয়ানকে নিজের ভূখণ্ডের অংশ মনে করে চীন। তাদের এ দাবি নতুন নয়। বরং শি জিনপিং এই একত্রীকরণের বিষয়টিকে একটি লক্ষ্যে পরিণত করেছেন। তাইওয়ানের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর লাই চিং-তেকে এখন মঞ্চে বিজয় উদ্্যাপন করতে দেখা যাচ্ছে, যা এশীয় অঞ্চলে আসল লড়াই বাধিয়ে দিয়েছে। এ অঞ্চলের বিশাল শক্তি ভারতের বশ্যতার জানান নতুন করে দিয়েছে বাংলাদেশ। আগের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে কথিত স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে কিছুটা রিমেক করেছেন সদ্য নিযুক্ত নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেছেন, চৌদ্দ-আঠারোর মতো এবারের নির্বাচনেও বাংলাদেশের পাশে ছিল ভারত। জবাবে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেছেন, ভবিষ্যতে এ সম্পর্ক আরও উচ্চতায় যাবে।
বাংলাদেশের এ রকম ভারতপ্রীতির জানান দেওয়ার সময়ে ভারতকে একহাত নিয়েছে মালদ্বীপ। দেশটি থেকে ১৫ মার্চের মধ্যে সব ভারতীয় সেনা সরাতে নির্দেশ দিয়েছেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জু। চীন সফর করে দেশে ফিরেই ভারতের বিরুদ্ধে তার এমন কঠোর বার্তা। রাখঢাক না রেখেই বলেছেন, ‘হতে পারি আমরা ক্ষুদ্র। তাই বলে কাউকে চোখ রাঙানোর ছাড়পত্র দিয়ে দিইনি।’ চীনের তাইওয়ান নীতির মতো ভারতও মালদ্বীপকে একটি খুদে দ্বীপই মনে করে। এরই মধ্যে দ্বীপরাষ্ট্রকে বয়কটের ডাক দিয়েছেন বহু ভারতীয়। তবে সেই বয়কটকে একেবারেই পাত্তা দিতে রাজি নন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জু। দমতেও রাজি নন তিনি। পাশাপাশি ভারতের ‘ছায়া’ থেকে বেরিয়ে আসতে নতুন নতুন সিদ্ধান্তও নিতে শুরু করেছে মালদ্বীপের মুইজ্জু সরকার। খাদ্য ও ওষুধের জোগান অব্যাহত রাখতে আর কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশের ওপর নির্ভর করতে রাজি নয় মালদ্বীপ। এ অঞ্চলের আরেক দেশ শ্রীলঙ্কাও বড়দের ঝগড়ায় মাথা দিয়ে বসেছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে লোহিত সাগরে হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন নৌ অভিযানে যোগ দেওয়ার। ঋণে জর্জরিত শ্রীলঙ্কার নৌবাহিনী হুতি বিদ্রোহীদের আক্রমণের বিরুদ্ধে লোহিত সাগরে বণিক জাহাজগুলোকে রক্ষায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন অভিযানে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে।
এশীয় আরেক প্রতিবেশী মিয়ানমারের ভেতরে ভেতরে চলছে চরম অস্থিরতা, যার সিকি ভাগও গণমাধ্যমে আসছে না। মার্কিন সহায়তায় আরাকান আর্মিরা সমানে সামনে এগোচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত লাগোয়া মিয়ানমারের পালেতাওয়া শহর থেকে সেনাবাহিনীকে হটিয়ে দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মিসহ একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রতিরোধযোদ্ধারা। আটক করেছে শীর্ষ কর্মকর্তাসহ বহু সেনাসদস্যকে। মিয়ানমারের চিন রাজ্য লাগোয়া বন্দর নগরী পালেতাওয়া ঘিরে ১৩ নভেম্বর থেকে প্রতিরোধযুদ্ধে নামে পিপলস ডিফেন্স ফোর্স ও আরাকান আর্মি। গত বৃহস্পতিবার থেকে প্রতিরোধযুদ্ধ পরিণতির দিকে আগাতে শুরু করে। চিন রাজ্যের অপর প্রান্তে চীন সীমান্ত থাকায় কৌশলগতভাবেও শহরটি গুরুত্বপূর্ণ। তুমুল সংঘর্ষে সামরিক জান্তা বাহিনীর অন্তত ৩৬ সদস্য নিহত হয়। এতে কমপক্ষে ২৪টি সেনা ঘাঁটির পতন হয়। চিন, রাখাইন, শান, কাচিন ও কারেনি রাজ্যে কমপক্ষে ৩০টি শহরে তুমুল প্রতিরোধযুদ্ধ চলছে। সেনাবাহিনীকে প্রাণে বাঁচতে চাইলে অবিলম্বে শহর ছেড়ে পালানোর আল্টিমেটাম দিয়েছে আরাকান আর্মি।
এর বিপরীতে বাহ্যত বাংলাদেশের ভূমিকা মার্কিনবিরোধী। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে বেশ সাবধানীও। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও নতুন করে এসেছে মার্কিনবিরোধী ঝাঁজালো বক্তৃতা। বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমেরিকার লজ্জা নেই, তারা কখন কাকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে, তার ঠিক নেই। তাদের গোয়েন্দা সাক্ষ্যতেই তারেক রহমানের সাজা হয়েছে। এরা একজনকে এমন করবে, আবার কখন কাকে পছন্দ করে ক্ষমতায় নিয়ে আসে, তারও ঠিক নেই। বিশ্ব ও এশীয় অঞ্চলের রাজনীতি-কূটনীতি বুঝেই টোকা দেওয়ার মতো এমন মন্তব্য ছুড়েছেন প্রধানমন্ত্রী। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে যাওয়া রোধ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাক চ্যানেল ডিপ্লোম্যাসি এখন ওপেন সিক্রেট।
এ ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতায়ই ১৯৬২ সালে কিউবা মিসাইল সংকট মোকাবিলা করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। তিনি আরেকটি অনিবার্য পারমাণবিক যুদ্ধ রোধ করতে পেরেছিলেন ব্যাক চ্যানেলে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে। এবার ইয়েমেনে হুতিদের ওপর দ্বিতীয় দফা হামলা চালানোর পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলছেন, তারা ইরানকে হুতিদের ব্যাপারে একটা ‘গোপন বার্তা’ পাঠিয়েছে।
লোহিত সাগর বন্ধ হলে নানা অসুবিধার পাশাপাশি বিচ্ছিন্ন লাভবান হওয়ার রাস্তাও হচ্ছে কোনো কোনো দেশের। যদিও বিশ্বে পূর্ব-পশ্চিম এবং রাশিয়া-ইরানের ভয়াবহ প্রক্সি ওয়ারে বলির পাঁঠা হওয়ার সমান্তরালে শেষ পর্যন্ত কারা কারা লাভবান হবে, সেই হালখাতা এখনই খোলা যাচ্ছে না। ইয়েমেনের হুতি সরকার লোহিত সাগরে অব্যাহতভাবে পরিবহন জাহাজে আক্রমণ করায় যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য ইয়েমেনে আঘাত হেনেছে। অন্যদিকে হুতিরা মূলত ইরানের প্রক্সি। রাশিয়া গডফাদার। মধ্যপ্রাচ্যে এরা কয়েকটি দেশে শিয়া ইরানের মাধ্যমে ব্যাপক প্রক্সি গড়ে তুলেছে। রাশিয়া তার পশ্চিমাবিরোধী যুদ্ধও লড়ছে এসব প্রক্সি দিয়ে। ইউরোপ থেকে এশিয়ায় যত পণ্য পরিবহন হয়, তাদের একটি বড় অংশ আসে মিসরের সুয়েজ ক্যানেল হয়ে রেড সি বা লোহিত সাগর দিয়ে। লেবাননের হিজবুল্লাহ, সিরিয়ার ইরানি ব্লকসহ ইয়েমেনের হুতিদের দিয়ে পুরো এই পথটাকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এ জন্য বেশির ভাগ পণ্যবাহী জাহাজ এখন বহু পথ ঘুরে দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে তারপর এশিয়ায় আসতে পারবে। অবস্থার আরও অবনতি হলে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড থেকে ইউরোপ, আরব দেশগামী বিমানগুলোকে অনেক কসরত করে চলতে হবে। টিকিটের ভাড়া আরও বাড়বে। এরই মধ্যে ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম বাড়বাড়ন্ত। সৌদি আরব তেল রফতানিতে বাধাগ্রস্ত হবে রেড সি বন্ধ থাকলে। একসময় দাম বেশি দিলেও তেল পেতে কষ্ট হবে বাংলাদেশসহ অন্য দেশগুলোর। বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্টস ইউরোপে যেতে যেসব জাহাজ ব্যবহার করে, তার সব রেড সি হয়ে চলাচল করে। এখন দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে চলতে গেলে সময় বেশি লাগবে ১৫-২০ দিন। পণ্য পরিবহন খরচ বাড়বে দেড় গুণ। ক্ষতি হবে অর্থনীতির। কিন্তু সরকারকে বরং রক্ষা দেবে। প্রক্সি বা ডামি সুবিধার পাশাপাশি রাজনীতির মাঠ উতরানোর নতুন ইস্যুও দেবে।

কমেন্ট বক্স