Thikana News
২৮ জুন ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
(পর্ব-৭)

দুর্দশা লাঘবে ত্যাগ ও ভোগের সংমিশ্রণ অনস্বীকার্য 

দুর্দশা লাঘবে ত্যাগ ও ভোগের সংমিশ্রণ অনস্বীকার্য 



 
এস এম মোজাম্মেল হক

দুনিয়া একটি রঙ্গশালা। এখানে নানা রকমের নাটক মঞ্চস্থ হয়। কিছু জীবনঘনিষ্ঠ কিছু আবেগী কিছু বিবাগী কিছু রুক্ষ কিছু কোমল কিছু মিলনাত্মক কিছু বিয়োগাত্মক-এসব নিয়েই সামাজিক পরিমণ্ডলে মনুষ্য জীবন আবর্তিত। এসব ইভেন্টের কিছু জীবনঘনিষ্ঠ, কিছু খেলাধুলা-বিষয়ক, কিছু যুদ্ধবিগ্রহ সংশ্লিষ্ট। এর মধ্যে কিছু হিংস্র পশুর সঙ্গে আবার কিছু মানুষের সঙ্গে কিন্তু পশুর সঙ্গে বিরোধ ক্ষণস্থায়ী হলেও মানুষে মানুষে বিরোধ হয় দীর্ঘস্থায়ী। কারণ পশুর যুদ্ধের মধ্যে আবেগ বা হিংসা-বিদ্বেষ কাজ করে না। তাদের যুদ্ধ খাদ্য সংগ্রহের জন্য শিকার ধরা এবং আত্মরক্ষার জন্য। এ দুটো কারণের পরিসমাপ্তি ঘটলেই তাদের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে তা নয়। সংঘটিত যুদ্ধের আপাত পরিসমাপ্তি ঘটলেও হার-জিতের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া উভয় পক্ষের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষোভ-বিক্ষোভের জন্ম দেয়, যা থেকে পরবর্তী সময়ে যেকোনো অজুহাতে লেগে যেতে পারে বিশ্বব্যাপী নতুন যুদ্ধ, যা প্রতিনিয়ত মানুষ প্রত্যক্ষ করছে। অথচ তা থেকে পরিত্রাণ ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্ববিবেক প্রতিনিয়ত তৎপর থাকলেও কোনো না কোনো পক্ষের ক্ষুদ্র স্বার্থচিন্তা এবং বিবেকবর্জিত আচরণের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। তবু শান্তিপ্রিয় মানুষেরা হাল ছেড়ে দিচ্ছেন না। পর্যায়ক্রমে তারা তাদের তৎপরতা অব্যাহত রাখছেন। ফলে সহসা সুফল লাভ না হলেও অদূর ভবিষ্যতে যে হবে না, তা নয়। তাই তাদের এ তৎপরতাকে সমর্থন জানানো শান্তিপ্রিয় মানুষের একান্ত কর্তব্য।

মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশকাল, পাত্রমিত্র ভেদে নিয়মকানুন, পুরস্কার-তিরস্কার, শাস্তি-ক্ষমা এমন বহু দেশীয় ও আন্তদেশীয় বিধিবিধান প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ব্যবস্থা রয়েছে। তবু মহল বিশেষের স্বার্থের পক্ষে ও স্বার্থের পরিপন্থী হওয়ার কারণে তাদের অবস্থান সব সময় ন্যায়ানুগ হয় না। শক্তির ভারসাম্যের কারণে এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ এবং ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বনের মতো দুঃসাহস সব সময় দুর্বল প্রতিপক্ষ দেখাতে পারে না, যা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এ কারণে কিছু সময়ের জন্য হলেও সামর্থ্যবান পক্ষ অন্যায় অব্যাহত রাখায় সমর্থ হন কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ বিধানের কারণে অন্যায় কখনো চিরস্থায়ী হয় না। ফলে নির্যাতিত মানুষের মুক্তি অবশ্যই ঘটে এবং দুর্জনের অপরাধের শাস্তি অত্যন্ত করুণ থেকে করুণতম হয়ে থাকে। পশ্চাতে ঘটে যাওয়া এমন বহু করুণ পরিণতির উদাহরণ থেকে অন্যায়কারী কখনোই শিক্ষা গ্রহণ করে অপরাধপ্রবণতা থেকে বিরত থাকে না। এটাই ইতিহাসের চরম শিক্ষা।

সহাবস্থানকারী জনগোষ্ঠীর পক্ষ-বিপক্ষের বিভাজন বিভিন্ন কারণে তৈরি হয়। তবে প্রতিপক্ষের মধ্যেও সহাবস্থানপূর্ণ বা বৈরিতাপূর্ণ সম্পর্কের অবতারণা হয়ে থাকে। এর অন্যতম কারণ নীতি-আদর্শ ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রাধান্য। মানুষ যখন আইন ও মানবিক মর্যাদাবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সহাবস্থান নিশ্চিত করতে সমর্থ হয়, তখনই একে অপরের প্রতিপক্ষ হওয়া সত্ত্বেও পারস্পরিক সহনশীলতা বজায় থাকে। কিন্তু যখন ক্ষুদ্রস্বার্থতাড়িত হয়ে হীনম্মন্যতায় আক্রান্ত হয়, তখন কেবল লোভ-লালসা চরিতার্থ করার বিষয়টিই প্রাধান্য পায়। আর তা থেকেই ক্রমান্বয়ে মানবিক মূল্যবোধ লোপ পেয়ে হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতর ও সর্বগ্রাসী স্বভাবের সমন্বয় ঘটে, যা ব্যক্তিকে অন্যদের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ধীরে ধীরে এ প্রক্রিয়া ঘটে বলে যার মধ্যে এ প্রক্রিয়া ঘটে, সে টেরও পায় না। তবে যখন তা উপলব্ধিতে আসে, তখন আর পূর্বাবস্থায় ফেরার মতো সময়-সুযোগ থাকে না। বিশেষ করে, ব্যক্তি যদি খুব ক্ষমতাবান হয় এবং জবাবদিহির ঊর্ধ্বে অবস্থান করে, তবে তো পেছন ফেরার প্রয়োজনই বোধ করে না। এ ক্ষেত্রে অবশ্য তাকে এককভাবে দায়ী করা চলে না। তার চারপাশে ঘিরে থাকা সুযোগসন্ধানীর বেষ্টনী ভেদ করে সমাজের আসল চিত্র অনুধাবন করার মতো অবস্থা থাকে না। ফলে চাটুকারদের গোঁজামিল দেওয়া পরামর্শই প্রাধান্য পায়, যার অনুসরণ-অনুকরণ তাকে আরও তিমিরে নিপতিত করে। এ থেকে উত্তরণের উপায় যে নেই তা নয়, তবে তাকে ন্যায়বোধসমৃদ্ধ নিজস্ব বিবেচনা এবং নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের পরামর্শ নিজ স্বার্থেই গ্রহণের মানসিকতা অর্জন ও তা বাস্তবায়ন অপরিহার্য।

ব্যক্তি বা সংগঠনের ভালো কাজের যেমন সুনাম-সুখ্যাতি আছে, তেমনি মন্দ কাজ বা দোষত্রুটির বিশ্লেষণ ও তার জবাবদিহি মোটাদাগে দু’ভাগে বিবেচনায় নিয়ে তার বিচার বা প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এর একটি ইচ্ছাকৃত আইন লঙ্ঘনজনিত অপরাধ এবং অনিচ্ছাকৃত বা ভুলবশত কৃত অপরাধ। শাস্তি বা ক্ষমার বিষয়টিও নির্ভর করে কৃত অপরাধের ধরন বিবেচনায়। তবে অনুরূপ অপরাধ পৌনঃপুনিকভাবে করা হলে তার শাস্তি বা ক্ষমার বিষয়টিও বিবেচিত হয় ভিন্নরূপে। সে ক্ষেত্রে নিয়ম ভঙ্গকারী ব্যক্তির অপরাধের মাত্রা ও তা থেকে ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করে সেরূপ শাস্তি তার প্রাপ্য। ব্যক্তি পর্যায়ে অপরাধের কারণে লাভ বা ক্ষতির পরিমাণ সীমিত হলেও একই অপরাধ গোষ্ঠীকেন্দ্রিক হলে তার ব্যাপকতা যেমন বেশি, তেমনি সুদূরপ্রসারী। তাই তার প্রতিকার বা শাস্তিও ব্যাপক। গ্লোবাল ভিলেজ ও প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের কারণে পৃথিবীর আনাচ-কানাচে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনাই মুহূর্তে সবার দৃষ্টিসীমায় চলে আসে। ফলে ঘটনার কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টদের কৃতকর্মের বিচার-বিশ্লেষণ ও প্রতিকার শুধু সংশ্লিষ্ট গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। তার পক্ষে-বিপক্ষে দুনিয়াব্যাপী জনমত তৈরি হয়। খেলাধুলার ক্ষেত্রে রেফারিকে নিয়ম মেনে খেলা পরিচালনা ও উভয় পক্ষের নিয়ম-বহির্ভূত কোনো আচরণের জন্য শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হলেও তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত বা ভুলবশত অনিয়মের ক্ষেত্রে তদূর্ধ্ব পারিষদ কর্তৃক উদ্ভূত সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হলেও অনলাইন ও প্রিন্ট মিডিয়ায় তার রিভিউ বেশ কিছুদিন এমনকি অনাগত ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকে, যা অনেক সময় ইতিহাসের অংশে পরিণত হয়। সব সময় স্মরণ রাখা প্রয়োজন, ব্যক্তি বা সমষ্টির কোনো কার্যকলাপই পর্যবেক্ষণের বাইরে নয়। স্মর্তব্য যে ফুটবল পায়ের খেলা হলেও হাত দিয়ে গোল করে বিশ্বকাপ জেতার বিষয়টি ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার গণ্ডি পেরিয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। সুতরাং উদাহরণ হিসেবে খেলাধুলার বিষয়টি আলোচিত হলেও শুধু খেলাধুলার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয় বরং রাজনীতি, যুদ্ধবিগ্রহ, বিচার-আচার, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান বিভিন্ন ক্ষেত্রেও ব্যাপৃত। তাই পৃথিবীর কোনো কাজই এখন আর ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ফলে যেকোনো কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে সকলকে সাবধানতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ জনমত বিবেচনায় নিয়ে বাস্তবায়ন করার বিকল্প নেই। বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হলে তা ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের জন্য বুমেরাং হওয়ার যথেষ্ট শঙ্কা থাকে। সুতরাং সাধু সাবধান।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক। কুইন্স ভিলেজ, নিউইয়র্ক।

কমেন্ট বক্স