নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে দেশ স্বাধীন করতে রণাঙ্গনে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করেছেন, এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন এই প্রবাসে। বার্ধক্যের ভাড়ে তারা আজ ন্যুব্জ। অনেকেই একা চলতে পারেন না। কিন্তু জীবন সায়ান্থে এসে তারা দেখছেন- এই প্রবাসে কিছু ‘দুষ্টুলোক’ নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিচ্ছেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সামনের আসন দখল করছেন। কমিউনিটির কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি তাদের অ্যাওয়ার্ড দিচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে উত্তরীয় পরিয়ে দিচ্ছেন। তখন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মনটা ঢুঁকড়ে কেঁদে ওঠে।
কোথাও কেউ প্রতিবাদ করছেন না। প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসছে না। যারা প্রতিবাদ করবেন, ভূয়াদের রুখে দাঁড়াবেন, সেই মুক্তিযুদ্ধের নতুন প্রজন্মও এই প্রবাসে অনেকটাই বিভ্রান্ত। কারণ তাদের ভেতরেও কৌশলে ঢুকে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি। সর্বত্র ভূয়াদের জয়-জয়কার। এই ভূয়াদের কব্জায় এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এসব ভূয়ার কেউ ঢুকে পড়ছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায়, কেউ লিখছেন স্বাধীনতার কবিতা, কেউ করছেন আবৃত্তি। সোস্যাল মিডিয়ায় ‘কপি-পেস্ট’ করছে মুক্তিযুদ্ধের নিশানা। অথচ ‘কেউটে সাপের বাচ্চা’ যেমন বিষধর, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী এসব প্রজন্ম প্রবাসে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে ভূয়াদের মত করেই।
উপরের বর্ণনা বা ভয়াবহ চিত্র এই প্রতিবেদকের নয়। সবই সম্মুখসমরে যুদ্ধ করা কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার করুণ আর্তনাদ। এ প্রতিবেদককে তারা বলেছেন- ‘আমাদের শরীরে শক্তি নেই প্রতিবাদ করার। নতুন প্রজন্মও এগিয়ে আসছে না। এভাবে সবাই চুপ থাকলে এই প্রবাসে ৫০ বছর পরও ভূয়ারা মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেবে। হয়তো পরপারে আমাদের এই দৃশ্য দেখতে হবে। সচেতন প্রবাসীদের উচিত ভূয়াদের বর্জন করা।’
বার্ধক্যজনিত রোগে অসুস্থ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসাধীন ম্যানহাটনের একটি হাসপাতালে। স্বচ্ছল স্বজনেরা তার পাশে সার্বক্ষণিক রয়েছেন। নাম প্রকাশ করতে চাইলেও পরিবারের সদস্যরা অনিচ্ছুক। ওই বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্ষেপ করে বললেন- প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বয়সের কারণে ভালো নেই। অথচ কিছু ভূয়া এই প্রবাসে রীতিমত দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। নিজেদের শুধু মুক্তিযোদ্ধা নয়, বিভিন্ন সংগঠন খুলে তার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এরাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের ভন্ডামির লাগাম টেনে ধরার যেন কেউ নেই।
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত প্রবাসের একটি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, তারা শিগগিরই কিছু একটা করবেন। ভূয়াদের মুখোশ উম্মোচন করবেন। ওই সংগঠনের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা জানিয়েছেন, আগে প্রবাসে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অনেক সম্মান পেতাম। এখন ভূয়াদের দাপটে নিজেরই লজ্জা হয়। তিনি বলেন, ‘প্রবাসে ভূয়াদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাদের দৌরাত্ম এখন সর্বত্র। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার পথ খুঁজতে হবে।’
নেতৃস্থানীয় ওই বীর মুক্তিযোদ্ধা জানান, ‘কিছুদিন আগেও একজন রাজনৈতিক নেতা, যিনি একটি রাজনৈতিক দলের এখানকার উপদেষ্টা, তিনি এতদিন নিজেকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান দাবি করতেন। গত দুই বছর ধরে তিনি নিজেকেই মুক্তিযোদ্ধা দাবি করছেন। শুনেছি- তালিকায় নামও উঠিয়েছেন রাজনৈতিক খুঁটির জোরে।’
এদিকে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে ভূঁইসর্বস্ব কিছু সংগঠনের ব্যানারে অনুষ্ঠান করে প্রতিবছর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে অ্যাওয়ার্ড নিচ্ছেন ভূয়ারা। তারা ওই সংগঠনের পুরো খরচও বহন করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
একজন মুক্তিযোদ্ধা বেশ কয়েক বছর আগের একটি অনুষ্ঠানের কথা উদাহরণ টেনে বলেন, প্রবাসের নাম সর্বস্ব একটি সংগঠন বিজয় দিবস অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা জানায়। ওই অনুষ্ঠানে কয়েকজস ব্যক্তির গলায় লাল-সবুজের উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যে কয়জনকে সেদিন উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাদের অনেকেই এই প্রবাসে নিজেদের স্বঘোষিত মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় দিচ্ছেন এখন। তাদেরই এখন দাপট চলছে এই কমিউনিটিতে। আর এই দাপটে বিব্রত বাংলাদেশি কমিউনিটিও। অথচ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা একেবারেই চুপচাপ।
নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় বসবাসরত একজন মুক্তিযোদ্ধা বলেন, জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। কারণ এখন সবখানে রাজনীতি ঢুকে পড়েছে। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যায় যেমন পরিবর্তন আসে, তেমনি নতুন নতুন মুক্তিযোদ্ধাও গজিয়ে ওঠে। তিনি বলেন, একসময় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসাবে চাকরির কোটা ছিল। তখন শুধু চাকরির জন্য অনেকে পিতার নামে সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেছেন। এখন সেই সার্টিফিকেটধারীরাও মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছেন। সরকার থেকে ভাতা পাচ্ছেন। অথচ দেশের আনাচে কানাচে বহু মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যারা সরকারি ভাতা না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
প্রবাসে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যারা চুপচাপ আছেন। ইমিগ্রেশন জটিলতাসহ নানান কারণে দেশে যেতে পারছেন না। এ রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা দূরে থাক, স্বীকৃতিও মিলছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিউইয়র্কে বসবাসরত একাধিক মুক্তিযোদ্ধা বলেন, প্রবাসে মুক্তিযোদ্ধাদের ছড়াছড়ি। কে আসল আর কে ভূয়া কেউ তো চ্যালেঞ্জ করছেন না। এসব নিয়ে কথা বলতেই এখন খারাপ লাগে। তার মতে- নিউইয়র্কে কমপক্ষে ৪০ জন দুষ্টুলোক আছে, যারা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে চলছে। আসলে তারা ভূয়া।
একজন মুক্তিযোদ্ধা বলেন, বিভিন্ন সময় ঢাকার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ আসেন। তারা এসে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হন। বক্তৃতা দেন। এরপর চলেও যান। কিন্তু এসব নিয়ে কথা বলেন না।
কমিউনিটির পরিচিত মুখ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এ প্রতিবেদককে বলেন, একাত্তরে যাঁরা অস্ত্র হাতে সরাসরি পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী, সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারী, ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ত্রাণ বিতরণসহ যাঁরা বিভিন্ন সেবামূলক কাজে অংশ নিয়েছেন, কলকাতায় স্থাপিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পরিচালকমণ্ডলী, সাংবাদিক, ভাষ্যকার ও শিল্পীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তালিকাবদ্ধ করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে যারা অস্ত্র হাতে মাঠ পর্যায়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন তাদের চার ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমন তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর নিয়মিত সদস্যবৃন্দ। এরা আগে থেকেই অস্ত্র ব্যবহারে এমনকী সম্মুখ সমরাভিযানে প্রশিক্ষিত ছিলেন। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তারা পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলেন। তাদের অধিকাংশই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ‘নিয়মিত বাহিনী’র সদস্য।
দ্বিতীয়ত: সাধারণ মানুষ যাঁরা বাংলাদশ থেকে ভারতে গিয়েছিলেন এবং ভারতের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অস্ত্রচালনা, বিস্ফোরকদ্রব্যের ব্যবহার ও গেরিলাযুদ্ধের কলাকৌশলে প্রশিক্ষণ লাভের পর দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সেগুলো ব্যবহার করেছিলেন। সংখ্যায় তারাই সর্বাধিক। তাদের বলা হতো ‘গণবাহিনী’। সামরিক প্রশিক্ষণের পরই তাদের হাতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রসহ সমাজের নানা স্তরের মানুষ।
টাঙ্গাইলের বঙ্গবীর আব্দুল কাদেরর সিদ্দীকীর (বীর উত্তম) নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত কাদেরিয়া বাহিনীর লোকজনও মুক্তিযোদ্ধা। তাদের অধিকাংশই প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যাননি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ল্যান্স নায়েক কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে দেশের ভেতরই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন তারা। তবে, কেবল ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে নতুনভাবে ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে না ফিরে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধ করেছেন। তাদের পৃথকভাবে নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মুজিব বাহিনী’। জীবন বাজি রেখে এসব মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করেছেন। অথচ এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে যারা কোনোদিন যুদ্ধ করেননি, তারা সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে এবং রাষ্ট্রীয় সুবিধা নিতে অসৎ পথে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করছেন। তাদের কর্মকাণ্ড দেখে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা গুমড়ে কেঁদে ওঠেন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবসে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস, নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন এবং বাংলাদেশ কনস্যুলেট বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে। এসব অনুষ্ঠানে প্রবাসে মুক্তিযোদ্ধাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু এই আমন্ত্রণ জানানো নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় সরকারি এসব প্রতিষ্ঠানকে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, মুক্তিযোদ্ধাদের আমন্ত্রণ জানানোর পর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তি দূতাবাস ও কনস্যুলেটে ফোন করে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেন এবং একে অন্যকে ভূয়া বলেন। এমনকী অনুষ্ঠানে বসার আসন নিয়ে কথিত মুক্তিযোদ্ধারা ঠেলাধাক্কা শুরু করেন। এসব দেখে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা চুপচাপ হয়ে যান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সরকারি কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, এসব সমস্যার কারণে আমরা আমন্ত্রণ জানাতে গিয়ে খুব সমস্যায় পড়ছি। এসবের সমাধান কোথায় এবং কে দিতে পারনে তাও জানি না। চাইলেও আমরা সনদ চাইতে পারি না। এটা তো সম্ভবও নয়।



ঠিকানা রিপোর্ট


