বিশেষ প্রতিনিধি : ক্ষমতা নিশ্চিত-নিছিদ্র রাখতে দেশে-বিদেশে দশাননে-দশভুজে খেলছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যেখানে যা করা দরকার সবই করছেন, করাচ্ছেন। ছাড়ছেন না একরত্তিও। কঠিন এই অভিযাত্রায় মেসি-ম্যারাডোনা স্টাইলে একাই খেলছেন। বাদবাকিরা জোগালি বা সহায়তাকারী মাত্র। তিনি কী করছেন, কী করবেন জানেন একাই। বাকিদের কাজ শুধু সায় দেওয়া। একসময়ের বিশেষ অর্থনীতিবিদ, বিশ্লেষক কিংবা ব্যবসায়ীসহ পরামর্শকদের দায়িত্বও এখন কেবল তাকে সমর্থন করা। তার মূল সহায়ক ও কাজের অংশীজনদেরও রাখছেন দৃশ্যপটের বাইরে। যা তার ক্ষমতাকে লক্ষ্মীন্দরের বাসরঘরের চেয়েও নিছিদ্র রাখতে মোক্ষম কাজে দিচ্ছে।
দল ও সরকারের হার্ডকোরের লোকেরাও জানেন না কোন ম্যাজিকে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহ দেখিয়েছে মার্কিন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এক্সন মবিল করপোরেশন। প্রতিষ্ঠানটি গভীর সমুদ্রের ১৫টি ব্লকেই অনুসন্ধানে বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ডক্টর তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীও তা জেনেছেন অনেক পরে। জ্বালানি উৎসে বৈচিত্র্য, ভৌগোলিক ও কৌশলগত কারণে বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী কেবল মার্কিন নয়, আরো বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠানই। এ খাতের বিশ্লেষক-বিশেষজ্ঞরাও এক্সন মবিলের কার্যক্রমে সায় দিচ্ছেন। কোথাও ত্রুটি দেখছেন না।
বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিভিন্ন দেশের জোয়ার নামা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এর আগে সমুদ্রে কনোকো ফিলিপস ও দাইয়ু আগ্রহ দেখিয়েও কাজ করেনি। এবার বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ধরে রাখতে উৎপাদন-বণ্টন চুক্তি পিএসসিতেও পরিবর্তন আনছে সরকার। এর পেছনে কূটনীতির সঙ্গে রাজনীতির মহামিলন ঘটে গেছে। এ সেক্টরে যুক্ত হয়ে গেছেন রাজনীতিকেরা। তাদের প্যাকেজ ডিল বড় বড় অঙ্কের। বিদেশ থেকে গ্যাস কিনতে দেশীয় খনিজ সম্পদ নিয়ে কিছু উড়ো কথা ছড়িয়ে অন্যদের ব্যস্ত করে দেওয়া হয়েছে। আর কাজের অংশীজনেরা ঢুকে পড়েছেন জ্বালানি খাত নিয়ন্ত্রণের পাইপলাইনে। দফায় দফায় জ্বালানির দামবৃদ্ধিতে জনগণ ক্ষেপবে বা সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে যাবে, এমন কোনো শঙ্কাই দেখছেন না তারা।
দেশের জ্বালানি খাতকে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার এমন কাজে সরকারও সামনে উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছে। গ্যাস সংকটের কারণ দেখিয়ে ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করে এ পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে ২৯ কার্গো এলএনজি আমদানির নামে বিশাল অঙ্কের কারবারেও কোনো বাধা আসেনি। বিদ্যুতের বিষয়টিও এমনই। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কমলেও যে বিদ্যুতের দফায় দফায় বাড়ানো, দাম একবারও কমানো হয়নি-এ নিয়ে কোনো দল প্রশ্ন তোলেনি। মানুষের মধ্যেও হা-পিত্যেশ নেই। যদিও কারও কারও শঙ্কা ছিল এতে দেশ গরম হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি। ২০০৯ সাল থেকে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে পাঁচ দফায়, যা ১৭৪ শতাংশের বেশি। পরিবহন খাতের সিএনজির দাম বেড়েছে ছয় দফায়। এসব ভাবার স্মরণশক্তিও হারিয়ে গেছে অনেকের, যা সরকারকে ক্রমেই সাহসী করে তুলেছে। সেই সাহসের জেরে চট্টগ্রাম বন্দরের বড় টার্মিনালগুলো পরিচালনার ভার বিদেশি অপারেটরের ওপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। সৌদি আরব, দুবাই ও সিঙ্গাপুরকেন্দ্রিক তিনটি অপারেটর নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। এরই অংশ হিসেবে টার্মিনাল পরিচালনায় আন্তর্জাতিক অপারেটর নিয়োগের সিদ্ধান্তে অনুমোদন দিয়েছে অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। এ নিয়ে লিজ-সাবলিজের তোড়জোড় চলতে থাকলেও কোথাও টুঁ শব্দ হচ্ছে না। সবই হচ্ছে নিজস্ব বোঝাপড়ায়।
বন্দর অপারেটিংয়ে ভারত ও চীনও ক্যান্ডিডেট ছিল। দুটিকেই বাদ দেওয়ার পেছনে আরেক বোঝাপড়ার কাহিনি। কেউ ফিরবে না খালি হাতে। তাদের দেওয়া হবে আরও বড় তোহপা। বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি সরকার বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের মতো অর্থলগ্নির আন্তর্জাতিক সংস্থাকেও হাতে রাখছে দক্ষ হাতে, যার পুরো ক্রেডিটই প্রধানমন্ত্রীর। এ কাজে তার হাইপ্রোফাইলের লবিস্ট রয়েছেন। এই লবিস্টরা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের নাড়ি-নক্ষত্র সম্পর্কে সর্বোচ্চ আপডেট। এসব প্রতিষ্ঠান যে তাদের ভেতরগত আগের বৈশিষ্ট্য ও কৌশল পাল্টে ফেলেছে, তার রহস্য অনেকের চেয়ে বেশি জানা প্রধানমন্ত্রীর। তিনি জানেন, নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণার পরও আইএমএফ শ্রীলঙ্কাকে কেন ঋণ দিয়েছে? কীভাবে ঋণ দেওয়া হয়েছে পাকিস্তানকেও। সেখানে বাংলাদেশের পজিশন ঢের উত্তম। পদ্মা সেতু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও বাংলাদেশ কেন এখনো বিশ্বব্যাংকের অগ্রাধিকারের শীর্ষে-এর মাজেজাও বেশ গভীরে।
বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ৫০ বছরের সম্পর্ক উদযাপন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে তাদের সদর দপ্তরে রাজকীয় আমন্ত্রণ সেই গভীরতার কিঞ্চিৎ ছাপ মাত্র। তার এ সফরকালে নানান সমঝোতা ও চুক্তির মাঝে আঞ্চলিক বাণিজ্য, কানেকটিভিটি, দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং পরিবেশগত ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশকে ২ দশমিক দুই পাঁচ বিলিয়ন ডলার ঋণের ঘোষণা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এ লক্ষ্যে পাঁচটি প্রকল্প বাস্তবায়নে চুক্তি সই হয়েছে। সামনে ঋণসহ বিশ্বব্যাংকের সুযোগ-সুবিধার আরও বিস্তার ঘটার বার্তা রয়েছে। বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ শেখ হাসিনাই পারেন, পারবেন, তাকে দিয়েই হবে- এমন বিশ্বাস জন্মেছে বিশ্বব্যাংকের। যার বেনিফিট শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচনসহ আরও অনেক কিছুতে পেতেই থাকবেন। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের দূরত্ব নিয়ে খুশি মহলের জন্য তা হবে মাথায় উঠে আছাড় খেয়ে ছুড়ে পড়ার মতো।
রাজনীতি যে এখন কূটনীতির বিষয় হয়ে গেছে, তা বুঝে শেখ হাসিনা এগোচ্ছেন একেবারে তার নিজের মতো করে। ওয়ান ইলেভেনের পর দেশি-বিদেশি বিশেষ বিশেষ শক্তির সঙ্গে বোঝাপড়া করে ক্ষমতারোহণ এবং টানা ১৫ বছর ক্ষমতা ধরে রাখার ক্যারিশমা বাংলাদেশে একমাত্র তারই। সামনের করণীয়ও অনেকটা একাই ঠিক করছেন তিনি। এবার ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ মার্কিন দূতদের নির্বাচন নিয়ে কড়া বার্তায়ও হাল ছাড়ছেন না তিনি। কিম, পুতিন, শি চিন পিং ধাঁচে শক্তিধর না হলেও নিজ দেশে একক কর্তৃত্ব তার। আবার পশ্চিমাদের একেবারে পরিত্যাগও করেননি। এ দূরদর্শিতা তাকে শেষ পর্যন্ত কোনো গিরিখাদে ফেলবে না বলে দৃঢ় আশাবাদী তিনি। সহকর্মীরাও এখন পর্যন্ত তার ভবিষ্যৎ রূপরেখা নিয়ে অন্ধকারে। এবারের জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে দীর্ঘ সফরে তার সেই ক্যারিশমায় আরো শাণ পড়বে। এরপর তার ভারত যাওয়ার কথা। চীনের সঙ্গে সংযোগ তো আছেই। কূটনীতির এ কেমিস্ট্রি ডিসেম্বরের পরে বাংলাদেশের রাজনীতিকে বড় রকমের টার্নিং পয়েন্টে নেবে। সেখান থেকে উতরানোর যাবতীয় কৌশলও শেখ হাসিনার হাতে। যা কেবল যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়াই দেখবে না। উত্তর-দক্ষিণ দুই কোরিয়া থেকে ইরান, কিউবা, ভেনিজুয়েলা, বেলারুশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তানও শিক্ষা নেবে। জড়িয়ে যেতে পারে আরব বিশ্বও।
এরই মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার ওজারতি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করছে চীন। মার্কিন আধিপত্য কমানোর লক্ষ্য তাদের। চীনের মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি ঝাই জুন সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সঙ্গে এক্সক্লুসিভ বৈঠকের মাঝেও ছিল এ অঞ্চলের বিষয়াদি। সিরিয়ার প্রতি চীনের সমর্থন এবং ইরান-সৌদি পুনর্মিলন মুসলিম বিশ্বের শরিক বাংলাদেশের জন্য বার্তা আছে সেখানে। অনেককে পেছনে ফেলে দিগন্তজোড়া কূটনীতির সেই ডালপালায়ও ঘুরছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যে স্বস্তির জন্য তিনি আইএমএফের ঋণ নিয়েছেন, সেই স্বস্তির জন্য আরও যেখানে যেখানে সংযোগ ও লেনদেন পাতানো দরকার, তার সবই করার আয়োজন রয়েছে তার। ভৌগোলিক অবস্থানের ব্যবহার করে যেকোনো পরিস্থিতি উতরানোর সক্ষমতা কাজে লাগাতে একটুও পিছপা নন তিনি। তাকে বাদ দিয়ে প্রতিবেশী ভারত, নিকটবর্তী চীন এবং দূরপ্রাচ্যের যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য কারও সমীকরণ মিলবে না; ক্ষমতার সেই লক্ষ্মীন্দরের সিদ্ধিলাভ অনেকটাই হয়ে গেছে শেখ হাসিনার।