Thikana News
২৫ এপ্রিল ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫
প্রসঙ্গ : স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও জাতিসংঘের ব্রিফিং

দলকানা ও ভাড়াটে সাংবাদিকদের লড়াই!

দলকানা ও ভাড়াটে সাংবাদিকদের লড়াই!
‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার।’ সাংবাদিকতার মহান পেশায় এমন বাংলাদেশি ‘নিধিরাম সর্দার’ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং নিউইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দপ্তর। বোনাফাইড মিডিয়ায় কাজ না করলেও মিথ্যা পরিচয় দিয়ে কেউ কেউ বাগিয়ে নিয়েছেন হোয়াইট হাউজের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড। তাদের কেউ দলকানা, আবার কেউ ভাড়াটে। 
দলকানা ও ভাড়াটে এসব সাংবাদিকের কর্মকাণ্ড সম্প্রতি স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর নজরে এসেছে। কৌশলগত কারণে তারা আপাতত নিরব থাকলেও বিষয়গুলো পুক্সক্ষানুপুক্সক্ষভাবে খতিয়ে দেখছেন। এসব সাংবাদিকের অনেকেই নিয়মিত-অনিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন। প্রথম দিকে মিডিয়া বিভাগের কর্মকর্তারা বিষয়টি উপলব্ধি করতে না পারলেও এখন বিষয়টি বুঝে ফেলেছেন। অনেকক্ষেত্রে তারা বিতর্কিত প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছেন এবং কৌশলে উত্তর দিচ্ছেন। 
গত প্রায় এক দশক ধরে স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও জাতিসংঘ সদর দপ্তরে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে অংশ নিচ্ছেন এমন একজন সাংবাদিক, যিনি বোনাফাইড কোনো মিডিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন। নিজের সম্পাদনায় একটি অনলাইন মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তা নিয়মিত আপডেট হয় না। তিনি সাংবাদিকতায় যতটুকু সক্রিয়, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশী সক্রিয় প্রবাসে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে। 
বিএনপির রাজনৈতিক মতাদর্শের এই সাংবাদিক একসময় বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকের কূটনৈতিক সংবাদদাতা ছিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রেস উইংয়ের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ছিলেন। এক দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে পাড়ি জমান তিনি। সাংবাদিকতায় তার যতটা না দখল, তার চেয়ে রাজনীতির লেজুরবৃত্তিতে কয়েকগুণ এগিয়ে থাকা এই সাংবাদিক নিজের বুদ্ধিমত্তায় পৌঁছে গেছেন হোয়াইট হাউজের প্রেস ব্রিফিংয়ে। বেশ কয়েকবার প্রেস ব্রিফিংয়ে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে। যদিও তার প্রশ্নগুলো বরাবরই ছিল বিএনপির পক্ষে। 
হোয়াইট হাউজ ছাড়াও বিএনপিপন্থি এই সাংবাদিক নিয়মিত অংশ নিয়েছেন ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে। সেখানে তার প্রায় সব প্রশ্নই ছিল বিএনপির পক্ষ নিয়ে করা। প্রতিটি প্রশ্নে রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতিফলন ফুটে ওঠে স্পষ্ট। 
এদিকে বিএনপিপন্থি সাংবাদিক ছাড়াও আরো একজন বিএনপি নেতা, যিনি যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি, তিনিও সাংবাদিক পরিচয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের ব্রিফিংয়ে অংশ নিচ্ছেন। বিএনপির স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশ্ন করছেন। সাংবাদিকতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এ ধরনের অনৈতিক কাজে লিপ্ত হওয়া সাংবাদিকতার নৈতিকতা পরিপন্থি বলে অনেকে বলছেন। 
এদিকে হোয়াইট হাউজ, স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও জাতিসংঘে একতরফা বিচরণের পর আওয়ামী লীগ সরকার তার বর্তমান মেয়াদের শেষ দিকে বিএনপিপন্থি সাংবাদিকের কাউন্টার দিতে প্রায় হাফ ডজন সাংবাদিকের শরণাপন্ন হয়েছে। একজন মন্ত্রীর পরামর্শে এসব দলকানা সাংবাদিকরা এখন সরকারের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে বিএনপিপন্থি সাংবাদিকের সঙ্গে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন। প্রেস ব্রিফিংয়ে বিএনপিপন্থি সাংবাদিক যে প্রশ্ন করেন, তার কাউন্টার প্রশ্ন করেন সরকারের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নকারী সাংবাদিকরা। বিষয়টি নজরে এসেছে সংশ্লিষ্টদের। 
৬ নভেম্বর সোমবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের এক সাংবাদিক সংস্থাটির মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিককে প্রশ্ন করেন, ‘আমার দুটি প্রশ্ন রয়েছে। এর মধ্যে একটি বাংলাদেশ সংক্রান্ত। বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি পূরণে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ৪ নভেম্বর হওয়া বৈঠকে অংশ নেননি। দলটি অবরোধের মতো কর্মসূচি দিয়েছে। এতে একজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েজন সাধারণ জনগণ প্রাণ হারিয়েছেন। কর্মসূচির নামেই এমনটি হয়েছে। জবাবে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র বলেন, দুঃখিত, দুঃখিত। আমি দুঃখিত। আপনার প্রশ্নটা যে কি? এর প্রতিক্রিয়ায় ওই সাংবাদিক বলেন, তারা (বিএনপি) নির্বাচন কমিশনের সংলাপে যাচ্ছে না। কিন্তু, দলটি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চায়।
উত্তরে স্টিফেন ডুজারিক বলেন, আমি জানি না কেন, আমরা বুঝাতে চাচ্ছি, আমার কাছে বিশদ বিবরণ নেই। কেন দলটি সংলাপে অংশ নেয়নি সে সম্পর্কে আমার জানা নেই। আমি আপনাকে যা বলতে পারি তা হল, আমরা বাংলাদেশে সহিংসতামুক্ত একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আশা করি। আমরা যেমন বলেছি, গ্রেপ্তার হওয়া বিপুল লোকের বিষয়ে আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছি।
একই দিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রেস ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেলকে সরকার সমর্থক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন- 
বাংলাদেশের জনগণ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। যুক্তরাষ্ট্র সি-৩ ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। এখন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) কর্মীরা গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের অজুহাতে ভাঙচুর এবং সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করে নির্বাচনের আগে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ ব্যাহত করছে। আপনি কি জাতীয়তাবাদী দলকে সহিংসতা বন্ধ করে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বলবেন?
জবাবে বেদান্ত প্যাটেল বলেন, ‘আগামী জানুয়ারিতে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচনের জন্য পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। এটি আমরা করতে থাকব এবং আমরা যেকোনো সহিংসতার ঘটনাকে অনেক গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছি। বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে আমরা সরকার, বিরোধী দল, সুশীল সমাজে এবং অন্যান্য অংশীদারদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানাতে যুক্ত আছি এবং এটি অব্যাহত রাখব।’
স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেলকে বিএনপিপন্থি সাংবাদিক প্রশ্ন করেন- বাংলাদেশজুড়ে বিক্ষোভ চলছে।  তারা ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছেন এবং সরকার এক অর্থে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছে। আটক করা হয়েছে বিএনপি মহাসচিবসহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের ৮ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে। ২৮ অক্টোবর থেকে বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর থেকে অন্তত ১১ জন নিহত হয়েছেন। ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা তার দলের সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছেন, বিরোধী দলের সদস্যদের আগুনে নিক্ষেপ করতে বা তাদের হাত পুড়িয়ে দিতে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ-সেই পরিবেশ তৈরির জন্য আপনারা কি বাংলাদেশের জনগণের পাশে থাকবেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে সহায়তা করবেন?
এই প্রশ্নের উত্তরে বেদান্ত প্যাটেল বলেছেন, ‘এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে না। এটি আমরা আগেও বলেছি, আপনার বন্ধুর প্রশ্নের জবাবে আমরা এটি পুনরুল্লেখ করেছি। একটি দলের বিপরীতে আমরা আলাদা করে কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করি না। এই মুহূর্তে আমাদের ফোকাস হচ্ছে আগামী জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে নির্বাচনী পরিবেশ ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা।’
বিএনপি এবং সরকারপন্থি সাংবাদিকদের প্রশ্নগুলো যে পক্ষপাতদুষ্ট তা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে ওই ব্রিফিংয়ে। এমনকী মুখপাত্র প্যাটেলও বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। 
নিউইয়র্কে কর্মরত বেশ কয়েকজন সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, যারা স্টেট ডেপার্টমেন্ট ও জাতিসংঘের বিফিংয়ে অংশ নিয়ে সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে লড়াই করছেন, তারা আর্থিকভাবে বা অন্য কোনোভাবে লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু দিন দিন তাদের দলকানা আচরণ পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। এতে বাংলাদেশেরই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। এটি সাংবাদিকতার অপব্যবহার হিসাবে চিহ্নিত হলে পেশাদার সাংবাদিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। 
একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপির পক্ষে হোয়াইট হাউজ, স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও জাতিসংঘে সাংবাদিকতার আড়ালে লবিয়িং করার জন্য প্রতিমাসে মোটা অংকের অর্থ পাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক। এই অর্থে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে সপরিবারে বসবাস করছেন তিনি। অন্যদিকে সরকার সমর্থক সাংবাদিকরাও সম্প্রতি নানান সুবিধা পাচ্ছেন বলে জানা গেছে। কোনোদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেননি, বরং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কলম খুলে লিখেছেন, তাদের অনেকেই এখন আওয়ামী লীগের ঝান্ডা তুলে ধরছেন স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও জাতিসংঘের প্রেস ব্রিফিংয়ে। বিনিময়ে মাস শেষে পাচ্ছেন মোটা অংকের অর্থ। আর এই অর্থ সরকারের তহবিল থেকে নয়, প্রবাসে আওয়ামী লীগ করেন, অথবা দেশে বিস্তর সুবিধা নিচ্ছেন এমন ব্যক্তি এসব অর্থ পরিশোধ করছেন। 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিউইয়র্কের একজন প্রবীণ সাংবাদিক এ প্রতিবেদককে জানান, বাংলাদেশি সাংবাদিকরা  হোয়াইট হাউজ, স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও জাতিসংঘে সংবাদ সংগ্রহ করেন, এ বিষয়টি গৌরবের হওয়া উচিত। কিন্তু এসব স্থানে সাংবাদিকদের যে দলকানা আচরণ বা আনুগত্যের লড়াই শুরু হয়েছে, তার ফল ভালো হবে না। সাংবাদিকতার মত মহান পেশাকে কলুষিত করা হচ্ছে। সাংবাদিকতার সুযোগের অপব্যবহার হচ্ছে। এটি জঘন্য ও ঘৃণ্য অপরাধ। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক হওয়া জরুরি। 
 

কমেন্ট বক্স