Thikana News
৩০ অক্টোবর ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫


গণহীন গণমাধ্যম

গণহীন গণমাধ্যম



 
কাকন রেজা


আমি মাঠে এখনো কেন কাজ করি, এমন প্রশ্ন অনেকে করেন। অনেকে বলেন, আরও ভালো জায়গায় থাকতে পারতেন। দোষ দেন আমাকে আমার চেষ্টা নেই বলে। তাদের এই অনুযোগকে আমি শ্রদ্ধা করি। জানি তারা ভালোবাসার জায়গা থেকেই বলেন। কিন্তু বিনীতভাবে জানাই, আমি একজন গণমাধ্যমকর্মী হতে চেয়েছি এবং তা সত্যিকার অর্থেই। আর গণমাধ্যমকর্মী হতে হলে মাঠে থাকতে হবে এবং তা মানুষের পালস বোঝার জন্য। মানুষের হৃৎকম্পন কী বলে, তা বুঝতে না পারলে আমি সঠিকটা লিখতে পারব না। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত অফিস, গাড়ি এবং বাড়ি হয়তো পাব। প্রায়ই অফার আসে প্রতিদিন পাঁচ হাজার টাকা রোজগারের, সেটাও হয়তো পাব। হতে পারব আরেক ‘ডরিন চৌধুরী’ কিংবা অন্য কোনো নামের ঘোস্ট রাইটার। কিন্তু গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা যেদিন ভেবেছি, সেদিন থেকেই রাজনীতি থেকে সরে এসেছি, লোভ থেকে সযতনে নিজেকে দূরে রেখেছি। লিখতে যখন বসি, তখন আসল কথাটাকেই তুলে আনতে চেষ্টা করি। যে কথা মানুষের মনের কথা। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যা ভাবে। আর সেটাই গণমাধ্যমকর্মী এবং গণমাধ্যমের কাজ।

আমার একটা লেখা কতজন পড়েছেন, যাকে অনলাইনের ভাষায় ‘হিট’ বলে, তার একটা সংখ্যা এক গণমাধ্যমের হেড অব নিউজ আমাকে জানিয়েছিলেন। আমার বিশ্বাস হয়নি, তিনি স্ক্রিনশট পাঠিয়েছিলেন সংখ্যার। যেটি আজও আমার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। কিন্তু যিনি দিয়েছিলেন তার নিষেধ ছিল সেটা প্রকাশের ব্যাপারে। কথা রেখেছি, প্রকাশ করিনি। করলে অনেকের চোখ কপালে উঠত। আরেকজন প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার লেখা এতজন পড়ে কেন? সোজা উত্তর ছিল আমার, আমি মানুষের সঙ্গে মিশি, মানুষকে পড়তে চেষ্টা করি, তাদের ভাষাতেই লিখি, সম্ভবত সে কারণেই তারা পড়ে। 

হাসতে হাসতে বলেছিলাম, আপনি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত মানুষ, সাধারণ মানুষের ঠান্ডা-গরমের সঙ্গে আপনার পরিচয়ের সূত্রটা কেটে গেছে। যত দিন মাঠে ছিলেন, সূত্রটা জুড়ে ছিল, এখন নেই। তাই মানুষ আপনাকে বুঝতে পারে না, আপনিও মানুষকে বুঝতে পারেন না। অবশ্য অনেকে বলতে পারেন, সামাজিক মাধ্যমে আমার শেয়ার করা লেখায় মানুষের লাইক, কমেন্ট কম কেন। এর একটা ব্যাখ্যা হলো, ফেসবুক তার লিঙ্কের বাইরে কোনো কিছু মানুষের কাছে বেশি পৌঁছাক, সেটা চায় না বলেই সরাসরি শেয়ার করা অন্য লিঙ্কের রিচ কম। সঙ্গে আমার ফেসবুক বন্ধুসংখ্যাও কম। সামাজিক মাধ্যমের লাইক, কমেন্টের সঙ্গে নিউজ পোর্টালের ‘হিট’ এর সম্পর্ক বলতে গেলে নেই।

গণমাধ্যম সম্পর্কে আমার ধারণা হলো, ‘গণ’ এর সঙ্গে মাধ্যম যুক্ত হলে হয় গণমাধ্যম। আর ‘প্রচার’ এর সঙ্গে মাধ্যম যুক্ত হলে হয় প্রচারমাধ্যম। আর ‘গণ’ বিযুক্ত হলে তা হয়ে ওঠে প্রচারণামাধ্যম। আমাদের বেশির ভাগ মাধ্যম থেকে ‘গণ’ বিযুক্ত হয়েছে বহু আগেই। এখন প্রচার থেকে প্রচারণায় পা রাখতে চলেছে মাধ্যমগুলো। এখানে কারও একটু বিভ্রান্তি থাকতে পারে প্রচার আর প্রচারণা নিয়ে। প্রচার হলো নিজস্ব মতবাদ প্রচার করা এবং তাতে অতিরঞ্জন না থাকা। প্রচারণা হলো নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে অতিরঞ্জিত ও বানোয়াট বিষয়কে যুক্ত করা। আমাদের কিছু কিছু মাধ্যম এই অতিরঞ্জনকে বেছে নিয়েছে, যার ফলেই তারা গণমাধ্যমের কাতার থেকে বিযুক্ত হয়েছে।

গণ না থাকলে গণমাধ্যম থাকে না, এটাই চরম সত্য। মানুষের মনের কথাকে উল্টো পথে প্রবাহিত করা, মানুষের মনের কথার বিপরীত কথাকে মানুষের নিজস্ব কথা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা এখন মাধ্যমগুলোকে প্রচারণামাধ্যমের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। এ কারণেই মানুষ সামাজিক মাধ্যমের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সিটিজেন জার্নালিজম নিয়ে নিচ্ছে মেইনস্ট্রিম জার্নালিজমের জায়গা। মানুষ খবরের মাধ্যম থেকে ফেসবুকে বেশি নির্ভরতা খুঁজে পায় এবং তা খবরের মাধ্যমে নিজের কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পায় না বলে।

কেন এ অবস্থা হলো-এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের মাধ্যমগুলোর মালিকানা এবং ঊর্ধ্বতনদের ব্যাপার চলে আসে। গণমাধ্যমের মালিকেরা যখন গণমাধ্যমের সঙ্গে সম্পর্কহীন ব্যবসায়ী হন, তখন তার নজর থাকে ব্যবসার দিকে; খবরের নীতিমালার দিকে নয়। তার কাছে খবর হয়ে ওঠে পণ্য, যেটা বেচলে তার লাভ হবে, অর্থের উৎস খুলে যাবে। আর যারা খবরের মাধ্যমের লোক এবং ঊর্ধ্বতন, তারাও নিজেদের খবরের লোক থেকে ব্যবসায়ীতে পরিণত করেছেন, তাদের কাছেও খবর পণ্য। কোন পুজোয় কোন দেবতা তুষ্ট, তা তারা বুঝে গেছেন। ফলে তারা দেবতাদের তুষ্ট করার ধান্দায় থাকেন। সাধারণ মানুষ তাদের কাছে অসুরসম হয়ে ওঠে। মানুষের তথা ‘গণ’ এর চাওয়া-পাওয়া তাদের কাছে অর্থহীন মনে হয়। এমন অবস্থাতেই মাধ্যম থেকে ‘গণ’ বিযুক্ত হয়।
শেষ করি বাংলাদেশের এক টেলিভিশনের কথায়। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি নিয়ে খবর। 

২৮ অক্টোবরের ঘটনায় যে বিরোধী পক্ষ দায়ী এবং তার জন্য তাদের ওপর ভিসানীতি প্রয়োগ করা হতে পারে এবং তা উচিত, এই হলো সে খবরের প্রতিপাদ্য। হাসলাম, অতিরঞ্জনের শিল্পটাও শিখতে না পারা এক নাদানকে দিয়ে সেই প্রতিবেদনটি করানো হয়েছে। একটা খবর কতটা কনফ্লিক্টেড হতে পারে, তার দারুণ উদাহরণ সেই প্রতিবেদন। খবরটি দেখে মনে হলো, মূর্খতারও একটা সীমা থাকা দরকার, সীমাটা সেই টেলিভিশন পার করে এসেছে। বলতে পারেন তারা নির্বাণপ্রাপ্ত হয়েছে। মৃত্যু, শোক, জরা, দুঃখ, বিষাদ, নির্যাতিত মানুষের আর্তনাদ, সন্তানহারা পিতা-মাতার কান্না, ভাই হারানো বোনের অশ্রু, পিতা হারানো শিশুর আকুতি কিছুই তাদের কানে পৌঁছায় না।

কমেন্ট বক্স