বিশেষ প্রতিনিধি : চার দিন জাপান সফর শেষে যুক্তরাষ্ট্র সফরে আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যুক্তরাষ্ট্র সফরটি বিশ্বব্যাংকের আমন্ত্রণে। বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের পার্টনারশিপের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে অনুষ্ঠানে অংশীজন তিনিও। তার ঢাকা ছাড়ার এক দিন আগেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই সফরে দেশটির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কোনো বৈঠক হবে না। যুক্তরাষ্ট্রে ছয় দিনের সফর শেষে যাবেন আরেক শক্তিমান রাষ্ট্র যুক্তরাজ্যে। সেখানে থাকবেন চার দিন। বিশ্বরাজনীতি-কূটনীতির ফ্যাক্টর তিন দেশ সফর শেষে ৯ মে তার ঢাকায় ফেরার কথা। এর আগে-পিছে অনেক ঘটনা। জাপান থেকেই ২৯ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াশিংটন পৌঁছাবেন এবং সেখানে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তিনি বিশ্বব্যাংক-প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করবেন। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারেও বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি আলোচনা করবেন। তবে কূটনীতিক মহল মনে করছেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকের বাইরেও প্রধানমন্ত্রীর সফর বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওয়াশিংটনে তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কংগ্রেসম্যান এবং সিনেটরের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে ১৫ দিনের সফর শুরুর এক দিন আগে শপথ নেন নয়া রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। সেদিনই পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ইন্দো-প্যাসিফিক বিষয়ে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেন। দিনটির আরেক ঘটনা নতুন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আধা ঘণ্টার মধ্যে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের অভিনন্দনপত্র। ঘড়ির কাঁটায় দুপুর পৌনে ১২টায় চীনের ঢাকাস্থ দূতাবাসের ফেসবুক পেজে পোস্ট করা হয় ফোলানো-ফাঁপানো অভিনন্দনপত্রটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সবার পরে (বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ১৫ দিন পর পঁচাত্তরের ৩১ আগস্ট) স্বীকৃতি দেওয়া চীন নতুন রাষ্ট্রপতিকে অভিনন্দন জানাল সবার আগে।
অভিনন্দনবার্তায় বলা হয়েছে ‘চীনের ঐতিহ্যগত বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী’ নামে। শি জিনপিং বলেছেন, তিনি চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নয়নকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেন এবং দুই দেশের ঐতিহ্যগত বন্ধুত্বকে এগিয়ে নিতে উচ্চমানের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ নির্মাণে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত। এর আগে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিজয়ী আওয়ামী লীগকে চীন প্রথম দেশ হিসেবে অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক ‘নৌকা’ উপহার দিয়েছিলেন দেশটির রাষ্ট্রদূত।
একই দিনে একদিকে চীনের এমন মিতালি, আরেকদিকে বাংলাদেশ ১৫ দফা ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক ঘোষণার রসায়নের মাঝে কূটনীতিকদের ভাবনার অনেক খোরাক। দেশীয় রাজনীতির সমীকরণে ঠাসা। আউটলুকের ঘোষণায় বলা হয়েছে, সকলের ভাগাভাগি ও সমৃদ্ধির জন্য একটি মুক্ত, উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল গড়ার প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারতসহ বেশির ভাগ মার্কিন মিত্র এরই মধ্যে তাদের নিজস্ব ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি ঘোষণা করেছে, যেখানে বাংলাদেশকে দীর্ঘদিন ধরে ধারণাগত প্ল্যাটফর্মে যোগদানের জন্য আহ্বান করা হয়েছে।
মাত্র দুই সপ্তাহ আগে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেছেন, মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে বাংলাদেশের নিযুক্তি বেইজিংয়ের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কের যথেষ্ট ক্ষতি করবে। তবে চলমান স্নায়ুযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন চীন ও রাশিয়ার মুখোমুখি অবস্থান করছে, তখন ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুকের ভিত্তি হিসেবে বাংলাদেশের চারটি নীতির অন্যতম ‘সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়’ নীতি কতক্ষণ বাস্তবে প্রয়োগ করা যেতে পারে, তা দেখার বিষয় বলে মনে করছেন রাজনৈতিক-কূটনৈতিক উভয় বিশ্লেষকেরাই।
সকালের বন্ধুর সন্ধ্যায় শত্রু হয়ে যাওয়ার স্নায়ুযুদ্ধকালে এক কঠিন সন্ধিক্ষণ পার করছে বাংলাদেশ। যার মধ্য দিয়ে স্থানিক রাজনীতিতে আশীর্বাদের লক্ষণ দেখছে শেখ হাসিনার সরকার। সোনার হরিণের মতো বাংলাদেশকে পেতে চায় পরাশক্তিগুলো। মার্কিন-চীন সব দিকেই কম-বেশি সমাদর। তা সহসা অনাদরে রূপ নেওয়ার আলামত আপাতত নেই। পরিস্থিতি বুঝে শেখ হাসিনা কাউকে ‘না’ করছেন না। দক্ষ হাতে ঝুলিয়ে রাখছেন সব কূল। চীনা মুদ্রার প্রচলনের প্রস্তাবও ফেলছেন না। আন্তর্জাতিক বাজারে চীনের মুদ্রা ইউয়ান গতি পাচ্ছে। বাংলাদেশের পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতে রাশিয়ার ঋণে নির্মিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের অর্থ চীনা মুদ্রা ইউয়ানের মাধ্যমে পরিশোধ করবে বলে প্রচার-প্রচারণা চলছে চীনের সরকারি গণমাধ্যমে। বাংলাদেশের ডলারের রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে এই পদক্ষেপের কথা চাউর করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে জাপান ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান পরিবর্তন করেছে। বিশেষ করে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর জাপান যেভাবে নিরঙ্কুশভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোকে সমর্থন দিয়েছিল, সেখান থেকে জাপানের বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করার ক্ষেত্রে জাপান তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে। এখন জাপান বলছে, যেকোনো অবস্থাতে তারা রাশিয়ার কাছ থেকে তেল আমদানিসহ অন্যান্য বাণিজ্য বন্ধ করবে না। এর ফলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের একটি নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি হয়েছে। জাপানের এই অবস্থান পরিবর্তন বিশ্ব ভূ-রাজনীতিতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে বলে কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। এ রকম প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফর নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বে যখন ডি-ডলারাইজেশন তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছে এবং অনেক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর তাদের নির্ভরতা কমাতে বিকল্প পথ খুঁজছে, তখন বাংলাদেশকে এই পাইপলাইনে নিচ্ছে তারা। বাংলাদেশ ইউয়ান ব্যবহার করে রাশিয়ার অর্থে পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্র নির্মাণে গৃহীত অর্থের মধ্যে ৩১৮ মিলিয়ন ডলার প্রদানের অনুমোদন মার্কিন ডলারকে বাইপাস করবে। চীন-রাশিয়া মিলে শেষতক মার্কিন ডলারের আধিপত্য চ্যালেঞ্জ করতে পারবে কি না, তা প্রশ্ন হয়ে থাকলেও মোটাদাগের ঘটনা। বিশ্বজুড়ে বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেনে ডলার প্রধান মুদ্রা হলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন এক পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।