ঢাকায় মজুরি নির্ধারণে বোর্ডসভা চলাকালে গাজীপুরে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আবারও বিক্ষোভে নেমেছেন আন্দোলনরত শ্রমিকেরা। গাজীপুরে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বাসে আগুন ধরিয়ে দেওয়াসহ নানান কর্মকাণ্ডে শক্তির জানান দেন তারা। মজুরি বাড়ানোর দাবিতে কয়েক দিন টানা বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকেরা। মালিকপক্ষের আশ্বাসে সপ্তাহের প্রথম দিন
শনিবার থেকে কাজে ফিরেছিলেন কিছু শ্রমিক। বাকিরা আন্দোলন জমানোর চেষ্টা করেও পারছিলেন না পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন দলের মারমুখী নেতাকর্মীদের দাপটে। তার ওপর শ্রমিকদের গণহারে বিএনপির সহযোগী বানিয়ে রাখা হয় দৌড়ের ওপর। বিএনপির নেতাকর্মীদেরও ফাঁসানো হতে থাকে গার্মেন্টস শ্রমিকদের উসকানির অভিযোগে। শ্রমিকদের দাবিকৃত ন্যূনতম মজুরি ২৩ হাজার টাকার বিপরীতে ৭ নভেম্বর মজুরি বোর্ড ১২ হাজার ৫০০ টাকা ঘোষণা করায় তা প্রত্যাখ্যান করেন গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলনের নেতারা। পল্টনের তোপখানা রোডে মজুরি বোর্ডের সামনেই তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ মিছিল করেন কয়েকটি গার্মেন্টস সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এর প্রতিবাদে আগামী ১০ নভেম্বর শুক্রবার বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা করেছেন শ্রমিক নেতারা। এ রকম সময়েই বাংলাদেশের শ্রম ও শ্রমিক পরিস্থিতি দেখতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের ঢাকায় আসার বার্তা। এর ঠিক আগে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া কিছু পোশাক ‘স্বাস্থ্যঝুঁকির’ কারণ দেখিয়ে প্রত্যাহার করে নেওয়ার আকাশ ভেঙে পড়া ঘটনা। সেই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কড়া বার্তা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাগুলো তারা খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে জানিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, খুব কাছ থেকে দেখা হচ্ছে নির্বাচনী পরিবেশও।
এমন একটি ঝড়ের আভাস সরকারের কাছেও ছিল। অগ্নিসন্ত্রাসের ভিডিও বিদেশি কূটনীতিকদের দেখিয়ে সুবিধা করতে পারেনি সরকার। সরকারের এডিটেড ফুটেজ দেখানোর ঢের আগেই ওইসবের র’ ফুটেজ চলে গেছে কূটনীতিকদের কাছে। এতে বিষয়টি হয়ে যায় জাতীয় নির্বাচনী মঞ্চনাটকের প্রথম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্য। সরকারবিরোধীদের ওপর চলমান ধরপাকড়, নিপীড়ন ও অগ্নিসংযোগকারীদের হাত পুড়িয়ে দিতে ক্ষমতাসীন নেতাদের বক্তব্যের সূত্র টেনে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে বলা হয়েছে, তাদের নজর আছে সেদিকে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আরও এক ধাপ এগিয়ে। ধরপাকড়ের মাত্রা ও তীব্রতা নিয়ে ইইউ গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে।
এ রকম উত্তাল সময়ে শ্রম খাতের অগ্রগতি দেখতে ইইউ প্রতিনিধি দলের ঢাকায় আসা কেবল গার্মেন্টস শিল্প নয়, আগামী দিনের রাজনীতির জন্যও ঘটনা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পাওলা প্যাম্পালোনির নেতৃত্বাধীন দলটি ১২ নভেম্বর থেকে তাদের ঢাকা সফরের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করবে। ননস্টপে তা চলবে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত। এই ৫ দিনে তারা গুরুত্বপূর্ণ বেশ কটি বৈঠক করবেন। কথা বলবেন অন্তত তিনজন সচিবের সঙ্গে। আইন, বাণিজ্য, শ্রম, পররাষ্ট্রসহ কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজনের সঙ্গেও কথা বলবেন। রুটিন সফর হলেও এসব বৈঠকে কেবল শ্রমিক অসন্তোষ বা শ্রম খাত নয়; কথা হবে নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার নিয়েও। যার পুরোটা যুক্তরাষ্ট্রেরও অ্যাজেন্ডাভুক্ত।
বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া কিছু পোশাক ‘স্বাস্থ্যঝুঁকির’ কারণ দেখিয়ে প্রত্যাহার করে নেওয়াও অ্যাজেন্ডার বাইরে নয়। সরকার শুরুতে এ খবর অস্বীকার করেছে। পরে বলেছে, এমনটি হতেই পারে। আগেও হয়েছে। এতে সরকারের কোনো দায় নেই। কিন্তু এবার ১২টি দেশের বাজার থেকে বাংলাদেশের কারখানায় তৈরি হওয়া পোশাক উঠিয়ে নিতে বাধ্য করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনেছে, সেগুলোর মধ্যে আছে পোশাক পরার কারণে চাপে শ্বাসরোধ হওয়ার শঙ্কা; বাচ্চাদের পাজামায় মেটাল বাটন বা জিপারের কারণে আঘাত পাওয়ার আশঙ্কা; ঢিলেঢালা হওয়ার কারণে আগুনের সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি; পোশাকে অতিমাত্রায় রাসায়নিক পদার্থ থাকা, আগুন-প্রতিরোধী মান নিশ্চিত না হওয়া ইত্যাদি।
সরকার যা-ই বলুক, বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে অর্থনৈতিক ও আর্থসামাজিক নীতি সহায়তা দেওয়া সংস্থা অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টÑওইসিডির এমন সিদ্ধান্তের জের হাড়ে হাড়ে বোঝেন সংশ্লিষ্টরা। তারা জানেন, এটি সবে শুরু। কেবল পোশাকশিল্প নয়, রাজনীতি-কূটনীতি-অর্থনীতি মিলিয়ে সামনে কী দুর্গতি আসতে পারে বাংলাদেশের সামনে?
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব জাল অনেকটা গুটিয়ে এনেছে। দূর থেকে, কাছ থেকেÑদুভাবেই দেখা প্রায় শেষ। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্র হাফ ডান বা আধাআধি কাজ করে না। হয় পুরো কাজ করে, নইলে করেই না বা গায়ে মাখে না। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পুরোপুরিই গা মেখেছে। সরকার বিএনপিসহ কয়েকটি বিরোধী দলকে দমাতে গিয়ে নানা কাজে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তির্যক নানা মন্তব্যও করেছে। এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের জবাব কোমল-কুসুম। বাংলাদেশের জনগণ যা চায়, তারাও তা চায় জানিয়ে বলা হয়েছে, সহিংসতার যেকোনো ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্র অবিশ্বাস্যভাবে গুরুত্ব দেয়। ঢাকায় তাদের একজন অভিজ্ঞ রাষ্ট্রদূত ও অবিশ্বাস্য প্রতিভাবান দল রয়েছে জানিয়ে বলা হয়েছে, ‘আমরা পরিবেশ ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।’
কূটনীতি বোঝা ব্যক্তিদের কাছে মার্কিনি এসব মোলায়েম-নরম কথার অর্থ বড় কঠিন-গরম। কখনো কখনো নির্মমও। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের হিসাব ভিন্ন। তাদের বিশ্বাস, দেশে পঁচাত্তর-পূর্ববর্তী পরিস্থিতি বিরাজ করলেও সেটা সামাল দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা পরাশক্তিগুলোও দিন শেষে আওয়ামী লীগ তথা সরকারের দিকেই আসবে। দুর্বল বিএনপির দিকে যাবে না। সেই বিশ্বাস থেকে বিরোধী শিবিরে বলপ্রয়োগ এবং ক্রমবর্ধমান হতাহতের ঘটনা বিএনপির ক্ষমতার আশাকে চুরমার করে দেবে। এ ধরনের সমীকরণের ফলাফল শিগগিরই পরিষ্কার হয়ে যেতে পারে।