যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেনের স্বঘোষিত উপদেষ্ট পরিচয় দিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করা মিয়া জাহিদুল ইসলাম ওরফে মিয়া আরেফী সম্পর্কে সব মহলে কৌতুহল বেড়েছে। ঢাকায় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা তার সম্পর্কে বিস্তর জানতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রেখেছে। জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
ঢাকার একাধিক সূত্র বলছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মিয়া জাহিদুল ইসলাম স্বীকার করেছেন যে তাকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে একটি মহল বিএনপি অফিসে নিয়ে গেছে। তিনি বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয়ে বিএনপি অফিসে উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে যেসব তথ্য দিয়েছেন তা ছিল শেখানো।
সূত্র জানায়, গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে কথিত উপদেষ্টা মিয়া জাহিদুল ইসলাম ওরফে মিয়া আরেফী জানিয়েছেন, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তিনি বিএনপি কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। এর আগে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে। সব যোগাযোগের নেপথ্যে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির শীর্ষস্থানীয় একজন নেতা, যিনি সদ্য দলটির নির্বাহী কমিটির সদস্য হয়েছেন। ওই বিএনপি নেতা জেনারেল সোহরাওয়ার্দীর নিকটাত্মীয় বলে জানা গেছে। তাদের তিনজনের পরামর্শে তিনি বিএনপি অফিসে গিয়ে বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয় দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন।
বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হওয়ার পর মিয়া জাহিদুল ইসলাম ওরফে মিয়া আরেফীর বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে। ওই মামলায় জেনারেল সোহরাওয়ার্দী ও ইশরাক হোসেনকেও আসামী করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির ওই নেতাকেও আসামি করা হতে পারে ওই মামলায়।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির ওই নেতা ঠিকানাকে জানান, এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। জেনারেল সোহরাওয়ার্দী তার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তাছাড়া ইশরাক হোসেনের সঙ্গে তার অনেক দিন কথা হয় না। তিনি বলেন, যে মুহূর্তে সরকারবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে, সেই মুহূর্তে আন্দোলন দুর্বল করতে সরকার এই নাটক সাজিয়েছে। তদন্তের স্বার্থে ঠিকানা ওই বিএনপি নেতার নাম প্রকাশ করছে না।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কথিত উপদেষ্টা মিয়া জাহিদুল ইসলাম ওরফে মিয়া আরেফীর জন্য কনস্যুলার অ্যাক্সেস চেয়েছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। ৩০ অক্টোবর সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ তথ্য জানান।
বিএনপি সংঘটিত ২৮ ও ২৯ অক্টোবরের রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতা নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের ব্রিফিং শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানান, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কথিত উপদেষ্টার জন্য কনস্যুলার অ্যাক্সেস (যোগাযোগ বা আলাপের জন্য অনুমতি) চেয়েছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। আমরা এ বিষয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।
উল্লেখ্য, গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নিজেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা হিসেবে দাবি করেন মিয়া জাহিদুল ইসলাম ওরফে মিয়া আরেফী নামে এক ব্যক্তি। ঢাকার মার্কিন দূতাবাস তার এই পরিচয় নাকচ করে দিয়ে তাকে একজন বেসরকারি ব্যক্তি বলে পরিচয় দেয়। পর দিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়। আরেফী মার্কিন নাগরিক হওয়ায় কনস্যুলার এক্সেস চেয়েছে মার্কিন দূতাবাস।
বাংলাদেশে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা দাবি করা মিয়া আরেফিকে নিয়ে রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে। বাংলাদেশে বিমানবন্দরে আটক হওয়ার পর কারাগারে তার সাথে দেখার জন্য মার্কিন দূতাবাসের পক্ষ থেকে অনুমতি চাওয়া হয়েছে। আমেরিকায় আরেফির খোঁজ খবর নিয়ে যা জানা গেছে তাতে বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের অভিযোগে পড়া জেনারেল নাসিমের ভাই পরিচয় দিতেন আরেফি। আমেরিকায় দীর্ঘদিন থেকে থাকলেও খুচরা দোকানেই কাজ করেছেন বেশী সময়। এখানকার কোন দলীয় রাজনীতিতে তাকে কখনো দেখা যায়নি। দুই সন্তান সহ পরিবারের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন। অভিবাসী জীবনের শুরুতে প্রায় দুই দশক আগে নিউইয়র্কেও বসবাস করেছেন। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ২০১০/২০১১ সালের দিকে নিউজার্সির পেরামাস এলাকায় বসবাস করেছেন এবং একটি খুচরা ক্রাফটের দোকানে ব্যবস্থাপনার কাজ করেছেন আরেফি।
গত মাস তিনেক আগে তিনি ডেমোক্র্যাট দলের একজন নেতা হিসেবে আমেরিকায় অন্তত একজনের কাছে পরিচয় দিয়েছেন বলে জানা গেছে। বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ম্যারিলেন্ডের দামাস্কা এলাকায় শেষ তিনি বসবাস করেছেন। ডেমোক্র্যাট দলের সেখানকার স্থানীয় কোন কমিটিতে তার নাম নেই। কাউন্টি বা স্টেট কমিটিতেও তিনি কোন নির্বাহি সদস্য নন। ডেমোক্র্যাট দলের জাতীয় নির্বাহি কমিটির সদস্য হিসেবে ঢাকায় দেয়া পরিচয়ের কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি। ডেমোক্র্যাট দলের জাতীয় নির্বাহি কমিটিতে এ নামে কেউ নেই বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
মাস কয়েক আগে মিয়া আরেফি বাংলাদেশে গেছেন। বাংলাদেশে গিয়ে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করারও চেষ্টা করেছেন। বিএনপির একাধিক প্রভাবশালী নেতাদের সাথে আরেফি যোগাযোগ করেছেন। তখন থেকেই তিনি নিজেকে ডেমোক্র্যাট দলের একজন প্রভাবশালী নেতা এবং প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন।
আমেরিকায় আরেফিকে কখনো কোন রাজনৈতিক তৎপরতায় দেখা যায়নি। তাকে যারা দুই দশক থেকে জানেন তারাও বলেছেন এখানকার কোন দলীয় রাজনীতি, এমনকি বাংলাদেশের বিএনপি বা আওয়ামীলীগের কোন রাজনৈতিক তৎপরতায় তাকে দেখা যায়নি। ম্যারিল্যান্ডের ডিসট্রিক্ট ডেমোক্র্যাট ককাসের সাবেক প্রেসিডেন্ট আনিস আহমেদ একই এলাকায় বসবাস করেন। আনিস আহমেদ ডেমোক্র্যাট দলের হয়ে রাজ্য পর্যায়ে নির্বাচনও করেছেন। তিনি জানিয়েছেন আরেফিকে দীর্ঘদিন থেকেই একজন সাধারণ কর্মজীবী হিসেবে জানেন। বিয়ে বিচ্ছেদ ও পারিবারিক কারণে কিছুটা হতাশ হলেও এমন কোন কাজে নিজেকে কেন জড়ালেন তা তিনি নিজেও ভাবতে পারছেন না বলে জানালেন।
আনিস আহমেদ জানালেন, ১৯৯৬ সালের সামরিক অভ্যত্থানের চেষ্টার অভিযোগে তখনকার সেনা প্রধান জেনারেল নাসিমের ভাই পরিচয় দিতেন আরেফি। একসময় জেনারেল নাসিমের মুক্তির জন্য মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে তার উদ্যোগে একটি আবেদন জানানো হয়। সে আবেদনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় লোকজন তখন ব্যাপকভাবে স্বাক্ষর করেছেন বলে আনিস আহমেদ এ প্রতিবেদককে জানান।
ম্যারিল্যান্ডের দামেস্কা শহরে আরেফিকে তেমন কেউ চেনেও না। ২৯ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপি অফিসে একজন সাবেক জেনারেলের পাশে বসে নিজেকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা দাবি করা এবং ধরা পড়ার পর সংবাদ সম্মেলনে দেয়া আরেফির বক্তব্য এখন নানা ডালপালা গজাচ্ছে। এসবের পেছনে কোন নেপথ্য লোকজনের খেলা কি না, তা নিয়েও আমেরিকা প্রবাসীদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।