আমেরিকা মানে অনেকের কাছে সোনার হরিণ। স্বপ্নের দেশ। সেই সোনার হরিণ ধরতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বপ্নের দেশ আমেরিকা এসেছেন, এমন বাংলাদেশির সংখ্যা গুণে শেষ করা যাবে না। আমেরিকায় থিতু হতে তাদের কেউ আবেদন করেছিলেন রাজনৈতিক আশ্রয়ের। আকার কেউ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে অ্যামিনেস্টির সুযোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু অনেকেই দীর্ঘ প্রবাস জীবনে সোনার হরিণের দেখা পাননি। এসব প্রবাসী বাংলাদেশির কেউ এসেছেন ৪০ বছর আগে, কেউবা এসেছেন ৩৫ বছর আগে। কারো ২০, কারো ২৫ বছর হয়েছে এদেশে। এখনো আসছেন অনেকে নানাভাবে। কিন্তু কখনো নিজেদের ভুল, কখনো অন্যের ভুলে ইমিগ্রেশনে ভুল আবেদনের কারণে পুরো জীবনটা প্রবাসে কাটছে একপ্রকার আফসোসের মধ্য দিয়ে। তাদের অর্থ আছে, প্রতিপত্তি আছে। কিন্তু বছরের পর বছর আনডকুমেন্টেড থাকায় চিত্তে সুখ নেই।
১৯৮৪ সালের বিভিন্ন দেশ ঘুরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছিলেন লক্ষ্মীপুরের রহমত আলী (ছদ্মনাম)। চোখেমুখে তার কত স্বপ্ন ছিল- একদিন আমেরিকার পাসপোর্ট নিয়ে মাতৃভূমিতে বেড়াতে যাবেন। প্রতিদিন ঘুমাতে যাবার আগে এমন স্বপ্ন দেখতেন। তখন নিউইয়র্কে ঝুঁকি ছিল। কৃষ্ণাঙ্গরা অনেক সময় হামলা করতো। কিন্তু কাজের অভাব ছিল না। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, সপ্তাহে পকেট ভরে ডলার কামাতাম। ছয় মাস পরে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিলাম। কিন্তু সেই আবেদন প্রত্যাখাত হয়েছিল। তিনি বলেন, কী করবো ভেবে, দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। কারো সঙ্গে তেমন জানাশোনা ছিল না। পরে এক বাংলাদেশির পরামর্শে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের নিষ্পত্তি না করেই যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কৃষিকর্মী (এসএডব্লিউ) প্রোগ্রামের আওতায় আবেদন করলাম। সেখানেই বাধলো বিপত্তি। সে আবেদনও প্রত্যাখ্যাত হলো। এরপর দিশেহারা হয়ে আরেক বন্ধুর পরামর্শে নাম বদলে আবারো রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করলাম। এরপর যে জটিলতা তৈরি হয়েছে তা আর বলার মত নয়। প্রায় ৩৮ বছর ধরে সেই ভুলের মাশুল দিচ্ছি।
রহমত আলী বলেন, আমেরিকায় আমার সব আছে। একাধিক ব্যবসা আছে। অর্থ আছে। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা আছে। তারাও প্রতিষ্ঠিত। জন্মসূত্রে ছেলে মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। বড় মেয়ের বয়স ৩২ বছর। ২১ বছর বয়সে বাবা হিসাবে আমার জন্য আবেদন করেছিল আমার মেয়ে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। আগের তিনটি আবেদনের কারণে আমার ইমিগ্রেশনের ভাগ্য ঝুঁলে আছে। তিনি বলেন, আমি যা করেছি তা ছিল বোকামি। আমার মত অনেকেই ভুল পরামর্শে তাদের প্রবাস জীবনকে একপ্রকার ধ্বংস করেছে।
তিনি বলেন, দেশে বাবা-মা ও ভাই বোন ছিলেন। একের পর মৃত্যু সংবাদ শুনেছি। চিৎকার করে কেঁদেছি। কিন্তু দেশে ফিরে যেতে পারিনি। সে কথা চিন্তা করলে এখনো কষ্টে বুক ফেটে যায়।
নিউইয়র্কের বাসিন্দা মুন্সীগঞ্জের আলী হোসেন (ছদ্মনাম) জানালেন আরো কষ্টের কথা। তিনি বলেন, ১৯৯৫ সালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মেক্সিকো সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে ঢুকেছিলাম। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছি। প্রবাসী এক বন্ধুর সহযোগিতায় কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছি। কারাগারে থাকতেই রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিলাম। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান হয়েছিল। নামের জটিলতার কারণে আমার আবেদন বার বার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এখন ডিপোর্টেশনের খড়গ ঝুঁলছে তার ভাগ্যে।
তিনি জানান, ২৮ বছরের প্রবাস জীবনে কী পেলাম, সে হিসাব করলে কিছুই পাইনি। বরং, দেশে থাকা বাবা-মা আমার দুশ্চিন্তায় তিলে তিলে নিঃশেষ হয়েছেন। তারা অনেক কষ্ট পেয়েছেন। বাবা-মায়ের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। তারা পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন।
আলী হোসেন বলেন, একজন প্যারালিগ্যালের মাধ্যমে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিলাম। তিনি ছিলেন বাংলাদেশে একজন আইনজীবী। স্বল্প অভিজ্ঞতার আলোকে যুক্তরাষ্ট্র ইমিশ্রেশন সংক্রান্ত কাজ শুরু করেন। আমার হয়ে কাল্পনিক কাহিনী নির্ভর আবেদন করেন। এরপর যা হবার তা-ই হয়েছে। ইমিগ্রেশন অফিসার আমার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর আদালতে যাবার পরামর্শ দেন। কিন্তু আদালতে যাবার পর প্রতি বছর শুনানিতে অংশ নেই। আট বছর একটানা শুনানি চলার পর আমার আবেদন আদালতেও অগ্রাহ্য হয়। মামলায় আমার ডিপোর্টশনের অর্ডার হয়েছে। উচ্চ আদালতে আপিল করার কারণে ডিপোর্টেশন স্থগিত আছে। কিন্তু প্রত্যেক বার শুনানিতে লাগেজ নিয়ে আদালতে যেতে হয়। প্রত্যেক বার ধরেই নেই, আদালত থেকে সরাসরি এয়ারপোর্টে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এভাবে কেটে যাচ্ছে অনিশ্চিত এক প্রবাস জীবন।
স্ট্যাটেন আইল্যান্ডের বাসিন্দা জলি বেগমের (ছদ্মনাম) এদেশে সব আছে। বাড়ি-গাড়ির মালিক তিনি। ব্যাংক ব্যালেন্সও আছে। সন্তানেরা জন্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। কিন্তু সেসব দিক থেকে কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না তিনি। ভুল আবেদনের কারণে প্রায় এক যুগ ধরে তার মামলা আদালতে ঝুঁলে আছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একজন আমেরিকান অ্যাটর্নির মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সাক্ষাতকারের দিন ওই অ্যাটর্নি তাকে যা যা বলতে বলেছেন, তিনি তাই বলেছেন। কিন্তু ইমিগ্রেশন অফিসার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে আদালতে পাঠিয়ে দেন। সেই থেকে শুধু শুনানিতে অংশ নিচ্ছেন। অ্যাটর্নিকে চুক্তি মোতাবেক অর্থ দিয়েছেন। কিন্তু কোনো ফল আসেনি।
কুইন্সের বাসিন্দা কাজী মাসুকুল হক (ছদ্মনাম) আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তখন তার অনুকূলে ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর বিভিন্নভাবে আবেদন করেও ইমিগ্রেশন সুবিধা পাননি। পার্টনারশিপে ব্যবসাও শুরু করেছিলেন। কিন্তু ইমিগ্রেশন জটিলতার কারণে পার্টনার তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গ্রাস করেছে। নিরূপায় হয়ে তিনি ছোটখাটো ব্যবসা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
তিনি জানান, যখন বাংলাদেশ থেকে চলে আসি তখন আমার স্ত্রী গর্ভবর্তী ছিলেন। আমেরিকায় আসার পর মেয়ে ভুমিষ্ঠ হয়েছে। কিন্তু মেয়ের মুখটি দেখার সুযোগ হয়নি কখনো। আনডকুমেন্টেড থাকায় দেশে যেতে পারিনি। তরুণী স্ত্রী বৃদ্ধ হয়েছেন। মেয়ের বিয়ে হয়েছে। নাতি-পুতিও জন্ম নিয়েছে মেয়ের ঘরে। একসময় স্ত্রী পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। প্রায় ৩৫ বছর পর কাজী মাসুকুল হকের শিকে ছিঁড়েছে। তার রাজনৈতিক আবেদন আদালতে গৃহীত হয়েছে। এখন তিনি গ্রিনকার্ড পেয়েছেন। কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সেও দেশে যেতে চান না তিনি। এক বুক কষ্ট বুকে চেপে তিনি নিউইয়র্কেই আছেন। বললেন, শুধু নিজের ভুলে নয়, ভুল পরামর্শ শোনায় জীবন থেকে হারিয়েছি সব। কিন্তু যখন গ্রিনকার্ড পেলাম, তখন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। না আছে শক্তি, না আছে সামর্থ্য।
সর্বশেষ কুইন্সের বাসিন্দা রেহানা বেগম (ছদ্মনাম) ১৭ অক্টোবর মঙ্গলবার ঠিকানা অফিসে এসেছিলেন। ওই নারী অভিযোগ করেন, ছয় বছর আগে তার ইমিগ্রেশনের মামলা আদালতে প্রত্যাখান হয়েছে। কিন্তু একটি বারের জন্য তার অ্যাটর্নি তাকে এ খবর জানাননি। অথচ দুই মাস আগে যখন অ্যাটর্নির সহকারীকে তিনি ফোন দিয়ে মামলার কথা জানতে চান, তখনো তিনি জানিয়েছিলেন যে মামলা ঠিকঠাক মত চলছে। ১৬ অক্টোবর সোমবার তাকে ফোনে জানানা হয় যে ছয় বছর আগে মামলা আদালতেই শেষ হয়ে গেছে।
নিরূপায় হয়ে ওই রেহানা বেগম একজন অ্যাটর্নির দ্বারস্থ হয়েছিলেন। কিন্তু আইনগত সহায়তার ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করে তাকে আদালতে যাবার পরামর্শ দেন ওই অ্যাটর্নি। তিনি জানান, আমার জীবন থেকে ছয়টি বছর হারিয়ে গেছে। আমেরিকা আইনের দেশ। আমি আদালতে যাব বিচার চাইতে।
ভুলে কারণে যাদের জীবন থেকে হারিয়েছে অনেকগুলো বছর, তারা বলছেন- আমেরিকা সম্ভাবনার দেশ। প্রেসিডেন্ট রিগ্যান বলে গেছেন, এই দেশে যে পা রাখবে, দেশটি তার। কিন্তু নিজেদের ভুলে আমরা সব হারাচ্ছি। তাদের মতে, রাজনৈতিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে আবেদনের জন্য ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত অভিজ্ঞ অ্যাটর্নি এবং প্যারালিগালের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আবেদন প্রস্তুতের আগে প্রতিটি বিষয় নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে।
এ ব্যাপারে নিউইয়র্কের অভিজ্ঞ অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরী ঠিকানাকে জানান, রাজনৈতিকসহ যে কোনো আবেদনের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ অ্যাটর্নির সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। কারণ একজন অ্যাটর্নি আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেই অ্যাটর্নি হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইমিগ্রেশনের ক্ষেত্রে সামান্য ভুল সাহায্য সবসময় কঠিন জটিলতা তৈরি করে।
মঈন চৌধুরী বলেন, ইদানিং স্পেশাল ভিসা ইবি-১, ইবি-২ ও ইবি-৩ ক্যাটাগরিতে বিপুল প্রতারণা হচ্ছে। এই প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে অনেকে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অনেকে দালালের মাধ্যমে এসব আবেদন করছেন। প্রত্যেক আবেদনকারীর উচিত সংশ্লিষ্ট অ্যাটর্নির সঙ্গে সরাসরি, ফোনে অথবা ভিডিও কলে পরামর্শ করা। কারণ অনেকে যোগ্য না হলেও দালালরা যোগ্য বানিয়ে ভিসা পাইয়ে দেবার কথা বলে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়। এ ব্যাপার সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরী।
নিউইয়র্কের অভিজ্ঞ প্যারালিগ্যাল ও প্রবীণ সাংবাদিক মঈনুদ্দিন নাসের ঠিকানাকে জানান, অতীতে অনেকে নিজ ভুলের কারণে রাজনৈতিক আশ্রয়সহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির আবেদনে ভুল করেছেন। তারা বছরে পর বছর ধরে সেই ভুলে খেসারত দিচ্ছেন। তিনি বলেন, কেউ যদি রাজনৈতিক আবেদন করেন, তাহলে তার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অবগত হতে হবে। আগে রাজনৈতিক আবেদন ফরম ছিল তিন পৃষ্ঠার। এখন তা ১২ পৃষ্ঠার। অনেক তথ্য লাগে। এসব তথ্যের স্বপক্ষে প্রচুর তথ্যপ্রমাণ দাখিল করতে হয়। কিন্তু অনেকে তাড়াহুড়ো করে যে কারো হেল্প নিয়ে বসেন। কিন্তু অনভিজ্ঞ বা অভিজ্ঞতা কম এমন কারো হেল্প না নেওয়াই ভালো বলে মনে করেন তিনি।
মঈনুদ্দিন নাসের বলেন, একসময় যুক্তরাষ্ট্রে কৃষিকাজের কর্মী নেওয়া হতো। তাদের সাক্ষাৎকারে কৃষি সংক্রান্ত প্রশ্ন করা হতো। কিন্তু অনেকের কৃষিকাজের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তাদের কোনো ধারণাও ছিল না। হয়তো প্রশ্ন করা হয়েছে, গাছ থেকে স্ট্রবেরি কীভাবে পারা হয়? জবাবে কেউ বলেছেন, মই দিয়ে। যাকে প্রশ্ন করা হয়েছে তিনি হয়তো কোনোদিন স্ট্রবেরি গাছই দেখেননি। তাই, আবেদনের আগে তিনি কোন বিষয়ে আবেদন করছেন সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা উচিত, বলেন মঈনুদ্দিন নাসের।