Thikana News
৩০ অক্টোবর ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫


নিয়ন্ত্রণহীন দ্রব্যমূল্যে জনজীবন ওষ্ঠাগত

নিয়ন্ত্রণহীন দ্রব্যমূল্যে জনজীবন ওষ্ঠাগত



 
১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তোফায়েল আহমদ। সচিবালয়ে মাঝেমধ্যেই এ প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা হতো, কথা হতো। বাজার পরিস্থিতি, বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য এবং জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইতেন। দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি সম্পর্কে একদিন জানতে চাইলে বললাম লবণের দাম বাড়ছে। কোন কোন পত্রিকায় রিপোর্টও এসেছে। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ বললেন, বিষয়টি আমারও নজরে এসেছে। সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা বিজন লাল দেবকে ডেকে বললেন, একটি প্রেস রিলিজ তৈরি করো যে, সরকার ভারত থেকে এক লাখ টন লবণ আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সড়কপথে কয়েক দিনের মধ্যেই ভারত থেকে ৫০ হাজার টন লবণ আসছে। বাণিজ্যসচিবকে ডেকে এ নিয়ে আলোচনা করলেন। তদানীন্তন পাকিস্তান আমলের সিএসপি সচিব বললেন, স্যার, মন্ত্রণালয়ে এ ধরনের কোনো বৈঠক হয়নি, সিদ্ধান্তও হয়নি। তোফায়েল আহমদ টেবিল চাপড়ে তারস্বরে বললেন, আপনি মন্ত্রী না আমি মন্ত্রী। খবর রাখেন, বাজারে যে লবণের দাম বাড়ছে। দেশে পর্যাপ্ত লবণ উৎপাদন ও মজুত থাকার পরও লবণের দাম বাড়বে কেন? একটি কুচক্রী মহল ৫৪ সালের অবস্থা সৃষ্টি করতে চায়।
বাণিজ্যমন্ত্রী তৎক্ষণাৎ মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতিকে ফোন করে বললেন, আমি চাই কাল সকালের মধ্যে নিউমার্কেট, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, শান্তিনগর, ফকিরাপুল, পুরান ঢাকাসহ ঢাকা শহরের সব বাজারে ট্রাকে লালসালু কাপড়ে ন্যায্য মূল্যের লবণ বিক্রির ব্যানার টানিয়ে লবণ বিক্রি করতে হবে। মন্ত্রণালয়ের স্টাফ, সাংবাদিকরা, আমি নিজে বাজারে গিয়ে দেখব আমার কথা অনুযায়ী কাজ করছ কি না। উপস্থিত সাংবাদিকদেরও অনুরোধ করলেন ট্রাকে লবণ বিক্রি করা হচ্ছে কি না দেখার জন্য। ঢাকা ও চট্টগ্রামের সব দৈনিক পত্রিকার বার্তা সম্পাদকদের ভারত থেকে লবণ আমদানির খবর ভালো করে প্রকাশ করার অনুরোধ করলেন। ভোরের সকল পত্রপত্রিকায় খবরটি প্রকাশিত হলো। সে সময়ে তো আজকের মতো টিভি চ্যানেলের ছড়াছড়ি ছিল না। একমাত্র ভরসা বিটিভিতে বারবার প্রচার করার জন্য মন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করলেন। দ্বিতীয় দিন আর বাজারের সামনে লবণবোঝাই ট্রাক রাখতে হয়নি। লবণের দাম বাড়েনি, কমার প্রবণতা লক্ষ করা গেল।
এখনো তোফায়েল আহমদের সঙ্গে দেখা হলে সহাস্যে ঘটনাটির কথা স্মরণ করেন। আর আজকের বাংলাদেশের নিত্যপণ্যের বাজারের অবস্থা কী! নিয়ন্ত্রণহীনভাবে প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েই চলেছে। সরকার আছে, প্রশাসন আছে কিন্তু দেখার কেউ নেই। অথচ কৃষিপণ্য কি আমদানিকৃত শিল্পজাত পণ্যÑপ্রতিটি জিনিসেরই পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। সরবরাহ ঘাটতি নেই কোনো সামগ্রীর। তার পরও সব জিনিসেরই দাম বাড়ছে কেন, উত্তর নেই। মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, পুলিশ সবই আছে। বাজারে নিম্নবিত্ত, বিত্তহীন, মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখারও কেউ নেই, যেন কারও কোনো মাথাব্যথাই নেই।
নির্দিষ্ট কয়েকটি জিনিসের ক্ষেত্রেই নয়, জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের দাম অস্বাভাবিক, রীতিমতো আকাশছোঁয়া। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, সীমিত আয়ের মানুষের আয়ত্তের বাইরে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কি আমদানিকৃত সব পণ্যের দামেই চরম অস্বাভাবিক অবস্থা। কোনো কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে সাময়িক সরবরাহ ঘাটতি দেখা দিলেও অন্যান্য জিনিসের সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। কিন্তু দাম নাগালের বাইরে। কৃষকের উৎপাদন খরচ ও বিক্রয়মূল্যের সঙ্গে অত্যন্ত সামঞ্জস্যহীনভাবে রাজধানীতে ও বিভিন্ন শহরাঞ্চলে কৃষিপণ্য অনেক বেশি দামে, অনেক ক্ষেত্রে দ্বিগুণ মূল্যে বিক্রি হচ্ছে।
কৃষক তার উৎপাদিত শাকসবজিসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্যের ন্যূনতম ন্যায্য মূল্য থেকে যেমনি বঞ্চিত হচ্ছেন, ভোক্তারাও প্রতারিত হচ্ছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণহীন নজিরবিহীন অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, বিত্তহীন মানুষসহ সর্বস্তরের মানুষের দুর্ভোগ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। সরকারিভাবেই বলা হয়, এসবের পেছনে কাজ করছে সিন্ডিকেট। কৃষিপণ্য থেকে নিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত এবং আমদানিকারক সকল পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে এই সিন্ডিকেট। প্রশ্ন উঠেছে, এসব সিন্ডিকেট অত্যন্ত শক্তিশালী হলেও এরা কি সরকারের চেয়েও ক্ষমতাধর। সরকার, সরকারি সংস্থা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে, জনজীবনের দুর্ভোগ লাঘবে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না, নিতে পারছে না। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ আছে, তারা অভিযানও পরিচালনা করে। কিন্তু ভোক্তা সাধারণ সুফল পাচ্ছে না। ভোক্তা অধিকারের অভিযানের খবর আগেভাগেই বাজারে চলে আসার ঘটনাও ঘটেছে। কী করে তা সম্ভব! অসৎ কর্মচারীদের গোপন সহযোগিতা ছাড়া। অভিযানের আগাম খবর পেয়ে মুনাফাশিকারি ব্যবসায়ীরা সাময়িকভাবে দাম কম হাঁকে। অনেক ব্যবসায়ী দোকান, আড়ত বন্ধ করে দেন। কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয় না। অভিযান পরিচালনার কয়েক ঘণ্টা পরই আবার আগের চড়া দামেই জিনিসপত্র বিক্রি করা হয়। এতে চরম অসহায় হয়ে পড়ছেন ক্রেতারা।
এই ভরা মৌসুমেও ইলিশের দাম আকাশচুম্বী। এক কেজি ওজনের একটা ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা। ৭৫০, ৮০০ ও ৮৫০ গ্রামের প্রতিটা ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১১০০ টাকায়। ইলিশের এ রকম অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ খুঁজে পান না সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশে ইলিশের দামের তুলনায় প্রতিবেশী ভারতে অনেক কম। ভারতে রফতানিকে এ জন্য অনেকে দায়ী করছেন। অন্যান্য মাছের দামও আকাশছোঁয়া। শিং মাছের কেজি ৮৫০ টাকা। নদীর চিংড়ির কেজি ১৪০০-১৫০০, চাষের চিংড়ি ৮০০ টাকা, কুঁচি চিংড়ি হাজার টাকা কেজি, চাষের পাঙ্গাশ ২৫০ টাকা কেজি। দেশি কই দুষ্প্রাপ্য। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের ভরসা চাষের কই, দাম কেজিতে ২৫০ টাকা, নদী-হাওরের রুই মাছের দাম সাড়ে চার হাজার টাকা। চাষের রুইয়ের দামও কেজিতে ৫৫০ টাকা। চাষের পুঁটির কেজি ৫৫০ টাকা, টেংরা ৬৫০ টাকা।
ডিমের দাম এখনো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। দেশি মুরগির ডিম ৮০ টাকা হালি, হাঁসের ডিমের হালিও ৮০ টাকা। ফার্মের মুরগির ডিমের হালি ৫০ টাকা। পোল্ট্রি ফার্ম মালিক ও ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে ডিমের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বাজারে গরুর মাংসের দামও বেড়ে কেজিতে এখন ৮০০-৮৫০ টাকা। খাসির মাংস হাজার থেকে ১১০০ টাকা কেজি।
আলুর দাম দ্বিগুণ হারে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে কেজিতে ৫০ টাকায়। বগুড়া, মুন্সিগঞ্জসহ দেশে পর্যাপ্ত আলু উৎপাদন হয়েছে। পাইকারিতে কেজিপ্রতি দাম ২৮-২৯ টাকা। হিমাগার মালিক, আড়তদারদের কারসাজি এর পেছনে কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পেঁয়াজের দাম এখনো সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এক কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ৯০ টাকা। আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা। পেঁয়াজের উৎপাদন সংকট না থাকলেও খোলাবাজারে দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়।
চিনির কেজি ১২৫ টাকা। মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। দেশি মসুর ডাল ১৪০ টাকা কেজি। সয়াবিন পাঁচ লিটারের বোতল ৮৪০ টাকা, লিটারপ্রতি ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সয়াবিন তেল ও চিনির দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। দেশীয় হাতে গোনা ছয়-সাতটি কোম্পানি এগুলো আমদানি করে। অপরিশোধিত সয়াবিন তেল অপেক্ষাকৃত অনেক কম দামে কিনে বাংলাদেশে নিজেদের রিফাইনারিতে পরিশোধন করে চড়া দামে বিক্রি করে আমদানিকারকরা। একইভাবে অপরিশোধিত চিনি এনে দেশে রিফাইন করে চড়া দামে বিক্রির ঘটনা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অজানা নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত একটি চিনিকল মাত্র ৪৫ হাজার মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করছে। ১৪টি চিনিকলের বাকি সবগুলোই বন্ধ।
মাছ মাংসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে সবজির ওপর নির্ভরশীল নগরের নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত সীমিত আয়ের মানুষ। সেই সবজির দামেও হাত দেওয়া দায়। এক কেজি করলা ৮০ টাকা, টমেটো ১২০ টাকা, পটল ৬০ টাকা, মরিচ ১২০ টাকা থেকে ১৪০ টাকা, ধুন্দুল ৫০ টাকা, পেঁপে ২৫ টাকা, ঢেঁড়স ৫০ টাকা, শসা ৬০ টাকা, বেগুন ৮০ টাকা, জালি ৪০ টাকা পিস, বরবটি ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। নতুন সবজি শিম উঠেছে ২০০ টাকা কেজি। সবজির দামও অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার সাধারণ মানুষের পক্ষে জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে।
 

কমেন্ট বক্স