বিশ্ব কূটনীতিতে ভারতের নেতিয়ে পড়া ভরসার প্রশ্নে কিছুটা অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলেছে সরকারকে। এ সময়ে চীন-রাশিয়ার আগ বাড়িয়ে সরকারের পাশে থাকার ঘোষণাও আরেক অস্বস্তি। দেশ দুটিই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপের বেশি বেশি সমালোচনা করে সরকারকে চীন-রাশিয়া ঘেঁষার ‘সিল’ খাইয়ে বেকায়দা অবস্থায় ফেলছে। সেখান থেকে কায়দা করে সেফ পজিশন নেওয়ার রাস্তা সংকীর্ণ করে দিচ্ছে। করে দিচ্ছে কিছুটা বেসামালও। এর আগে কখনো এতটা কাবু হয়নি সরকার। বরং কোনো না কোনো অপশনে উতরে গেছে।
ভিসানীতিতে কার নাম আছে যুক্তরাষ্ট্র কখনোই তা প্রকাশ বা প্রচার করে না। সচরাচর তারা যে দেশের যে ব্যক্তিকে ভিসা রেস্ট্রিকশন দেয়, কেবল তাকেই জানায়। বড়জোর জিটুজি (সরকার থেকে সরকার) জানে। সেটাও টপ সিক্রেটে শীর্ষ পর্যায়ে। কিন্তু বাংলাদেশে সমানে নামধাম প্রকাশনা উৎসব চলছে। কারও কারও মধ্যে স্যুয়োমোটু হয়ে নিজ থেকেই বেফাঁস মন্তব্যে নাম ফাঁস করে দেওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। কেউ বলছেন, এসব ভিসা রেস্ট্রিকশন-স্যাংশনে তিনি বা তারা কেয়ার করেন না। এ নিয়ে মনে ভয় নেই, মাথায় ব্যথা নেই। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিজ থেকে টেনে এনেছেন তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের কথা। বলেছেন, জয়ের যুক্তরাষ্ট্রে থাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করলে কিচ্ছু যায়-আসে না। তার এ বক্তব্যের মাঝে মানুষ অন্তত একটি নাম জেনে নিয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র ফারুক হোসেন বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যের ওপর ভিসানীতি প্রয়োগ হয়েছে। এতে পুলিশের ইমেজ সংকট হবে না বলে জানিয়েছেন স্বয়ং আইজিপি। ‘ঠাকুর ঘরে কে, কলা খাই নার’ মতো তাদের এ প্রবণতা। এর বিপরীতে অতি উৎসাহী মহলের মধ্যে বিচারপতি, মন্ত্রী, আমলা, শীর্ষ সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তার নামধাম দিয়ে ভিসা রেস্ট্রিকশনে পড়াদের তালিকা প্রচারের এক ধুম পড়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ছাই দিয়ে বা সাঁড়াশি দিয়ে বাংলাদেশকে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্র। অক্টোবরের মাঝামাঝি এই ধরাধরিতে যোগ দেবে যুক্তরাজ্য-কানাডাসহ পশ্চিমা আরও কয়েকটি শক্তিধর রাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের গণতন্ত্রের একটি রসায়ন চলমান বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশে রয়েছে প্রতিবেশী ভারতীয় গণতন্ত্রের কিছু মিশেলও। সেই ভারতেরই এখন বেগতিক দশা। ২০১৪ এবং ১৮-তে পরপর দুটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পেছনে ভারত এ সরকারকে একচেটিয়াভাবে ক্ষমতাসীন করেছে, ক্ষমতায় টিকিয়েও রেখেছে। সেই হিসেবে আগামীতে ভারত গেল দুবারের মতো না পারলেও যদ্দুর সম্ভব ভূমিকা রাখার আশাবাদ ছিল আওয়ামী লীগের। সেখানে এখন বিশাল ছন্দপতন। কূটনীতি করতে গিয়ে সাপ লুডু খেলার মতো খেলায় নেমেছিল ভারত। রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে পুরোনো স্নায়ুযুদ্ধের শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বর্তমান স্নায়ুযুদ্ধের সময় ঘনিষ্ঠ বন্ধু বানাতে গিয়ে ভুল চালের খেসারতে পড়েছে ভারত। কয়েক মাস পর দেশটির লোকসভার নির্বাচন। এর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঝামেলা পেকেছে কানাডার সঙ্গে। তা এখন জটিল এবং বেশ নোংরা পর্যায়ে।
হারদীপ সিং নিজ্জার হত্যার বিচার চেয়ে কানাডায় ভারতীয় কূটনৈতিক মিশনগুলোর সামনে বিক্ষোভ করেছে দেশটির শিখরা। জাস্টিন ট্রুডো সরকারের বিরুদ্ধে পাল্টা বিক্ষোভ হয়েছে নয়াদিল্লিতেও। ভারত সরকারকে দায়ী করে কানাডার পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর অভিযোগের এক সপ্তাহ পর, কানাডার বিভিন্ন শহরে ভারতীয় কূটনৈতিক মিশনগুলোর সামনে বিক্ষোভ করেছে শিখরা। কানাডায় বর্তমানে সাড়ে সাত লাখেরও বেশি শিখের বসবাস। এ সময় নিজ্জার হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবির পাশাপাশি পাঞ্জাবের স্বাধীনতার দাবিও জানানো হয়। তারা ভারতের পতাকায় আগুন দেয়। জুতা ছোড়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতিকৃতিতে। এদিকে ভারতের নয়াদিল্লিতে খালিস্তানপন্থীদের আশ্রয় দেওয়ায় কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে বিভিন্ন সংগঠন। খালিস্তানপন্থীরা কানাডায় ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী ভারতের কূটনৈতিক মিশনগুলোর নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে দাবি করেছে নয়াদিল্লি।
ভারতের চোখে সন্ত্রাসী কিন্তু খালিস্তানপন্থী গুরুত্বপূর্ণ তিনজন নেতা খুন হয়েছেন ৪৫ দিনের ব্যবধানে। কানাডায় হারদীপ সিং নিজ্জর খুন হন জুলাই মাসে। তার আগে মে মাসে পাকিস্তানের লাহোরে খুন হন পরমজিত সিং পাঞ্জর। ভারতের তথ্য অনুসারে, পাঞ্জর খালিস্তান কমান্ডো ফোর্সের নেতৃত্ব দিচ্ছিল। জুনে লন্ডনে খুন হন খালিস্তান লিবারেশন ফোর্সের প্রধান অবতার সিং খান্দা। এই তিনটি খুনের মধ্যে কানাডাই কেবল ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে। জাস্টিন ট্রুডো প্রকাশ্যে অভিযোগ তোলার অন্তত সপ্তাহ দুই আগে কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষ খালিস্তানপন্থী নেতা হারদীপ সিং নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততার প্রমাণ হিসেবে নথিপত্র ভারতকে দিয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে টেলিফোন নম্বর, যেটি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধির বলে কানাডা বিশ্বাস করে।
হত্যাকাণ্ডের আগের বিভিন্ন সময়ের ‘কমিউনিকেশন’ কানাডা ভারতকে দিয়েছে বলে কানাডার গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে। অবশ্য ভারত এই বক্তব্য নাকচ করে দিয়ে বলেছে, কানাডা ‘অফিশিয়ালি’ কোনো প্রমাণ তাদের কাছে হস্তান্তর করেনি। নিজ্জর হত্যায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততার প্রমাণ হিসেবে ‘হিউম্যান এভিডেন্স’ এবং সার্ভিল্যান্স এভিডেন্স’ কানাডার হাতে আছে। ‘সার্ভিল্যান্স এভিডেন্স’ এর উল্লেখযোগ্য অংশ ‘ফাইভ আই’ভুক্ত কোনো একটি দেশের গোয়েন্দাদের কাছ থেকে পাওয়া। কানাডার সঙ্গে এমন কূট-কাইজ্জার জেরে ভারতের আপাতত বাংলাদেশ বা আওয়ামী লীগকে প্রণোদিত করার সময় দেওয়ার সুযোগ কম। দিল্লি বারবার ওয়াশিংটনকে বার্তা দিতে চেয়েছে যে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় না রাখলে বাংলাদেশ চীনা বলয়ে ঢুকে যাবে। এখন দিল্লি বার্তা দিচ্ছে কানাডা চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখলে তারাই চীনের বুকে ঝুঁকে পড়বে।
এ রকম সময়েই বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন-প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারী ব্যক্তিদের ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপের পদক্ষেপ নেয় যুক্তরাষ্ট্র। পরিস্থিতিটা বিএনপির জন্য উৎসব আমেজের। এই ভিসানীতি যেন তাদেরই অর্জন! টানা ১৫ বছর আন্দোলন-সংগ্রামের বরকত দেখছে তারা। এই পুলক ধরে রাখতে পারছেন না দলটির নেতাকর্মীরা। উইন-উইন ভাব তাদের মধ্যে। নির্বাচনের আগেই ক্ষমতায় এসে যাওয়ার মতো মাস্তি কারও কারও।