চলতি মাসের শুরুতে দিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে যে বিশ্বনেতারা ভারতে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান-ও ছিলেন। সম্মেলনের এক ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর ‘দক্ষিণ এশিয়াতে তুরস্কের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার’ ভারতের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর ওপরও জোর দেন তিনি।
দিল্লিতে এরদোগান ও মোদি যখন করমর্দন করে আলোকচিত্রীদের সামনে ‘পোজ’ দিচ্ছেন, তার ঠিক ২৪ ঘণ্টা আগেই দিল্লিতে ঘোষিত হয়েছে ‘ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ’ অর্থনৈতিক করিডর বা ইন্টার ইউনিভার্সিটিয়ার মাইক্রো-ইলেক্ট্রনিকা সেন্ট্রামের (আইএমইসি) রূপরেখা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বা এমবিএস এবং সেইসাথে আমিরাত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতি ছিল তাতে।
সেখানে জানানো হয়, নৌপথে ভারতের পশ্চিম উপকূল থেকে শুরু করে তারপর রেলে আমিরাত, সৌদি, জর্ডান এবং ইসরায়েল হয়ে আবার সমুদ্রপথে এই করিডর কিভাবে ইউরোপের বন্দরে গিয়ে ভিড়বে।
এই করিডরের ঘোষণায় সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট হয়েছিল যেসব দেশ, তার অন্যতম হচ্ছে তুরস্ক। তুরস্ক থেকে যে সাংবাদিকরা প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গী হয়ে দিল্লিতে এসেছিলেন, পরদিন তাদেরকে এরদোগান জানিয়ে দেন, ‘তুরস্ককে পাশ কাটিয়ে এমন কোনো করিডর তৈরির চেষ্টা আমরা কিছুতেই মেনে নেব না।’
পূর্বের এশিয়া থেকে পশ্চিমে ইউরোপের মাঝে কোনো ‘ট্র্যাফিক’ (পণ্য চলাচল) গেলে তা তুরস্কের মধ্যে দিয়েই যেতে হবে। আঙ্কারার এই অবস্থানের কথাও খুব স্পষ্টভাবেই ওই দিন ঘোষণা করেন তিনি।
এরপর দেশে ফিরে কয়েকদিনের মধ্যেই এরদোগান জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে যান এবং সেখানে বিগত কয়েক বছরের মতো আবারো কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন।
ভারতও যথারীতি সে বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করে জানায়, কাশ্মীর প্রশ্নে তিনি স্রেফ পাকিস্তানের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি করছেন, যাকে কোনো গুরুত্ব দেয়ারই দরকার নেই। এরই মধ্যে দিল্লির ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকা রিপোর্ট করে, দিল্লি সফরের সময় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট শহরের বিখ্যাত জামা মসজিদে গিয়ে শাহী ইমামের সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু ভারত সরকার তার সেই অনুরোধ খারিজ করে দেয়। ফলে তুরস্ক ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের শীতলতা ধীরে ধীরে কমেছে বলে কিছুদিন আগেও যে ধারণা তৈরি হচ্ছিল তা ধূলিসাৎ হতেও সময় লাগেনি।বস্তুত এই মুহূর্তে দু’দেশের সম্পর্ক যে তলানিতে এসে ঠেকেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
পর্যবেক্ষকরা আরো বলছেন, ইসরায়েল, গ্রীস, সাইপ্রাস বা আর্মেনিয়ার মতো তুরস্কের যে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে আঙ্কারার সম্পর্ক খুব খারাপ-ঠিক তাদের সাথেই ভারতের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা এ সঙ্কটকে আরো জটিল করে তুলেছে। ‘বড় কাঁটা কাশ্মীর’ দিল্লিতে পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করেন, তুরস্ক ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হলো কাশ্মীর।
বস্তুত ইসলামি বিশ্বে তুরস্কের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ানোর জন্য এরদোগান সাম্প্রতিককালে যেভাবে কাশ্মীর ইস্যুটিকে ব্যবহার করেছেন তেমনটা আর কেউই করেননি।
গত সাত-আট বছর ধরে তিনি নিয়ম করে কাশ্মীরে ভারতের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে তুলে আসছেন, তার সরকার জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার পরিষদেও বিষয়টি বারবার উত্থাপন করেছে।
অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনে পশ্চিম এশিয়া বিশেষজ্ঞ কবীর তানেজা বলছিলেন, ‘মনে রাখতে হবে কাশ্মীরে ভারত ৩৭০ ধারা বিলোপ করার পর যে মুসলিম দেশটি পাকিস্তানের সুরে সুর মিলিয়ে সেই পদক্ষেপের নিন্দা করেছিল সেটি হলো তুরস্ক।’ এর আগে ২০১৯-এ জাতিসঙ্ঘে দেয়া ভাষণে এরদোগান কাশ্মীর কনফ্লিক্টকে সাত দশক ধরে ভুলে থাকার জন্য আন্তর্জাতিক বিশ্বকেও তীব্র ভাষায় দায়ী করেছিলেন।
কবীর তানেজা আরো জানাচ্ছেন, ‘কাশ্মীর ইস্যুটিকে উপেক্ষা করার জন্য এরদোগান কিন্তু ইসলামিক দেশগুলোর জোট অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি) এবং সৌদি আরবেরও সমালোচনা করতে দ্বিধা করেননি।’ অন্যদিকে, পাকিস্তানের সাথে তুরস্কর ‘মিত্রতা’র সম্পর্কও ঐতিহাসিক।
বস্তুত এরদোগান হলেন একমাত্র বিশ্বনেতা যিনি পাকিস্তানে পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশনে চার চারবার ভাষণ দিয়েছেন-দু’বার প্রধানমন্ত্রী এবং দু’বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে।
বিশ্লেষকরা বলেন, অটোমান সাম্রাজ্যের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার বা ‘নিও-অটোমানাইজেশনে’র মাধ্যমে এরদোগান যেভাবে তুরস্ককে বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠা দিতে চান-তার সেই প্রচেষ্টায় পাকিস্তান খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।
ফলে কাশ্মীর প্রশ্নে কেন এরদোগান পাকিস্তানের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে চলেছেন, তা অনুমান করা শক্ত নয়। অন্যদিকে, বিগত প্রায় এক দশক ধরে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারতে একটি হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় আছে, যারা আন্তর্জাতিক মঞ্চে ‘নিউ ইন্ডিয়া’ বা নতুন ভারতের আবির্ভাব ঘোষণা করতে চাইছে।
এই নতুন ভারতকে আন্তর্জাতিক বিশ্ব অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এবং কাশ্মীরের পরিস্থিতিকে ‘নিয়ন্ত্রণে আনতে পারাটা সেই সাফল্যের একটা বড় কারণ বলে ‘নিউ ইন্ডিয়া’র কর্ণধাররা হামেশাই দাবি করে থাকেন।
অর্থাৎ একই কাশ্মীরকে ভারত এবং তুরস্ক সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী দু’টি কারণে বিশ্বমঞ্চে ব্যবহার করতে চাইছে। আর সেটাই দু’দেশের মধ্যে তিক্ততার একটা প্রধান কারণ।
ভারতের ‘আউটরিচ’ নিয়ে সন্দেহ লক্ষ্যণীয়ভাবে, সাম্প্রতিককালে তুরস্কের প্রতিবেশী বা কাছেপিঠে এমন একাধিক দেশের সাথে ভারত সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার উদ্যোগ নিয়েছে, যাদের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক রীতিমতো খারাপ।
এর মধ্যে ইসরায়েলের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠতা বেশ কিছুটা পুরনো হলেও গ্রীস, সাইপ্রাস বা আর্মেনিয়ার সাথে বেশ হালেই ভারত সম্পর্ক উন্নয়ন করার ব্যাপারে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে।
গত মাসেই দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন থেকে দেশে ফেরার পথে নরেন্দ্র মোদি রাষ্ট্রীয় সফরে গ্রীসে গিয়েছিলেন।
ওই সফর ছিল সে দেশে ৪০ বছরের মধ্যে কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রথম সফর। সেই সফরের মাত্র দিন পনেরোর মধ্যেই দিল্লিতে আইএমইসি প্রকল্পের কথা ঘোষণা করা হয়, যে করিডরের ইউরোপ প্রান্তে গ্রীস একটি গুরুত্বপূর্ণ হাব।
তুরস্ককে উপেক্ষা করে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী গ্রীসকে যেভাবে ওই করিডরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, এরদোগান ইতোমধ্যেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন সেটা তিনি মানতে পারছেন না।
অন্যদিকে, গ্রীস যেমন ভারতকে কাশ্মীর প্রশ্নে সমর্থন করছে, তেমনি ভারতও সাইপ্রাস ইস্যুতে গ্রীসকে সমর্থন জানাচ্ছে।
আর্মেনিয়াতে ১৯১৫ সালে সংঘটিত জেনোসাইড বা গণহত্যাকে কেন্দ্র করে তুরস্কের সাথে তাদের সম্পর্ক নেই বললেই চলে। সেই আর্মেনিয়াতেও জি-টু-জি বা সরকারি পর্যায়ে করা চুক্তির আওতায় ভারত সম্প্রতি অস্ত্র রফতানির পদক্ষেপ নিয়েছে।
ইস্তাম্বুলের সিনিয়র সাংবাদিক বেকির সিটকি সিরিন মনে করেন, এই সব কারণেই ভারতের এই নতুন নতুন ‘ডিপ্লোম্যাটিক আউটরিচ’ গুলোকে তুরস্ক খুব একটা ভাল নজরে দেখছে না।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, ‘তুরস্কের একটা সন্দেহ তৈরি হচ্ছে যে তাদের ভৌগোলিক অঞ্চলে ভারত নিজস্ব প্রভাব বাড়িয়ে তাদের বিরক্ত করতে চাইছে।’
দিল্লিতে কবীর তানেজাও অনেকটা একই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেছেন। তিনি বলছিলেন, ‘হয়তো এটা ভারতের তুরস্ককে একটা বার্তা দেয়ার চেষ্টা (মেসেজিং) যে তোমরা কাশ্মীর নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে, আমরাও তোমাদের ঘরের পাশে গিয়ে গন্ডগোল করব।’
এরই মধ্যে আগামী বছরের শুরুতেই গ্রীস-ইসরায়েল-সাইপ্রাস এবং সেই সাথে আমেরিকাকে নিয়ে গঠিত ‘থ্রি প্লাস ওয়ান’ গ্রুপিংয়ের সম্মেলনেও ভারতকে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এই পদক্ষেপেও তুরস্ক যথারীতি খুশি নয়।
সম্পর্ক কী স্বাভাবিক করা সম্ভব? বিগত সাড়ে নয় বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বে নরেন্দ্র মোদি একটিবারের জন্যও কোনো দ্বিপক্ষীয় সফরে তুরস্কতে যাননি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি একবারই তুরস্কে গিয়েছিলেন সেটা ২০১৫-তে বহুপক্ষীয় প্ল্যাটফর্ম জি২০-র শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে।
অন্যদিকে, এরদোগানও এই সময়কালে মাত্র একবারই দ্বিপক্ষীয় সফরে ভারতে এসেছেন। কিন্তু ২০১৭-তে ওই সফরের ঠিক আগে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত এবং পাকিস্তানের মাঝে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেয়ায় সেই সফরও একরকম ভেস্তে গিয়েছিল।
কাশ্মীর প্রশ্নে ভারতের ঘোষিত অবস্থান হলো, ১৯৭২-র সিমলা চুক্তি অনুসারে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপক্ষীয়ভাবেই এর মীমাংসা হতে হবে। অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষ এর মধ্যে ঢুকতে পারবে না। এরদোগান সেই বিরোধে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়ে সফরের আগেই ভারতকে চটিয়ে দিয়েছিলেন যে সম্পর্ক আজ পর্যন্ত স্বাভাবিক তো হয়ইনি, বরং দু’পক্ষের মধ্যে তিক্ততা ক্রমশ বেড়েছে।
তুরস্কের সাংবাদিক বেকির সিটকি সিরিন কিন্তু বলছেন, কাশ্মীরের মতো সংবেদনশীল ইস্যুতেও একটা মাঝামাঝি রাস্তা নেয়ার অবকাশ আছে বলে এরদোগান এখনো বিশ্বাস করেন।
সিরিনের কথায়, ‘তুরস্ক মনে করে ভারত ও পাকিস্তান যা বলছে সে দু’টি রাস্তার বাইরেও কাশ্মীর নিয়ে একটা মধ্যপন্থী সমাধান সম্ভব।’
‘এটা এমন একটা পথ, যেটাতে ভারতীয়, পাকিস্তানি বা কাশ্মীরিরা কেউই ‘ভিক্টিম’ হবেন না বলে এরদোগানের বিশ্বাস।’
তিনি বলছিলেন ‘এই আইডিয়াটা তিনি ভারতকে বোঝাতে পারলে দু’দেশের সম্পর্কের উন্নতি হতে বাধ্য।’
তবে কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত তাদের অবস্থান নমনীয় করার বিন্দুমাত্র ইঙ্গিত দেয়নি।
বরং বছরচারেক আগে ওই অঞ্চলের বিশেষ স্বীকৃতি লোপ করার ভারত সরকার সেখানে পরিস্থিতি আরো শক্ত হাতে দমন করতে শুরু করেছে।
তাছাড়া ‘মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে এরদোগানের মতো পাকিস্তানের একজন ঘোষিত মিত্রকে ভারত যে কিছুতেই মেনে নেবে না, তাতেও কোনো সংশয় নেই।
ফলে তুরস্ক এবং ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক অদূর ভবিষ্যতে কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হতে পারে, দিল্লিতে কমপক্ষে পর্যবেক্ষকরা তার কোনো লক্ষণই দেখছেন না।
ঠিকানা/এসআর