‘সেল্ফি’ শব্দটি প্রথম এসেছে ইংরেজি ‘সেলফিশ’ থেকে। সেলফি প্রায়ই ফেসবুক, গুগল, ইন্সটাগ্রাম, টাম্বলার এবং টুইটার ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে শেয়ার করা হয়ে থাকে। ১৯০০ সালে পোর্টেবল কোডাক ব্রাউনি বক্স ক্যামেরা বাজারে আসার পর ফোটোগ্রাফিক আত্ম-প্রতিকৃতি তোলা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। বহনে সহজ এই ক্যামেরার সাহায্যে আয়নার মাধ্যমে সেল্ফি তোলার প্রচলন শুরু হয় তখন থকেই। সেল্ফি শব্দটির প্রাথমিক ব্যবহার ২০০২-এর আগে পাওয়া গেলেও একই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়ান এক অনলাইন ফোরাম এবিসি অনলাইনে প্রথম ব্যবহৃত হয়। প্রাথমিক অবস্থায় তরুণদের মধ্যে সেল্ফি অধিক জনপ্রিয়তা পেলেও বর্তমানে সমাজের সব স্তরেই এটি চলমান। ‘সেলফি’র বাংলা তরজমা ‘নিজস্বী’। আত্ম-প্রতিকৃতিও বলা যায়। যা সাধারণত হাতে ধরা ডিজিটাল ক্যামেরা বা ক্যামেরা ফোন ব্যবহার করে তোলা হয়। ফেসবুক জনপ্রিয় হওয়ার পর থেকে সেল্ফিকে আর ঠেকায় কে?
২০১২ সালের শেষের দিকে টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে ‘সেল্ফি’ শব্দটি বছরের আলোচিত সেরা ১০ শব্দের অন্যতম শব্দ হিসেবে বিবেচিত হয়। সেল্ফি তোলা কেবল ধান্ধা-ফিকির নয়, একটি রোগও। শিল্প-সাহিত্য মাড়িয়ে রাজনীতিতেও এই ব্যারামের চরম ব্যাপকতা। এক-সময় রাজনীতিকদের মধ্যে পড়ালেখার ঝোঁক ছিল, জানার-বলার চেষ্টা থাকতো সবসময়। আরেকজনকে দেখে বা ফলো করে নিজে সমৃদ্ধ হতেন। ওই সময়টায় লেখক-বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক, শিল্পীদের মধ্যেও ছিল এই প্রবণতাটি। এখন কি তা লাগছে না? নাকি ওই তরিকায় বরকত নেই?
অনেকটা তেমনই। কিছু শেখা বা জানার চেয়ে নেতাদের সঙ্গে সেল্ফিতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন দলে নিজেকে ত্যাগী-যোগ্য প্রমাণের এক মহামারি চলছে। আবার নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাতের সেল্ফি তুলে নানা মাধ্যমে ছড়িয়ে রাতারাতি বিশাল কিছু বনে যাওয়ার বহু দৃষ্টান্ত আছে বাংলাদেশে। পাপিয়া, শাহেদ, হেলেনা জাহাঙ্গীর, দর্জি মনিররা সেই তালিকার কয়েকজন মাত্র। ঘটনাচক্রে তারা ফেঁসে গেছেন। না ফাঁসলে এতোদিনে কোথায় চলে যেতেন তারা!
দৈনিক দু-চারটা সেল্ফি তোলা এখন আর ফ্যাশন নয়, রুটিন। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, সেল্ফিবাজি শুধু অভ্যাস নয়, মস্ত রোগ। আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের একদল গবেষক সেল্ফিতে আক্রান্ত হওয়া রোগের নাম দিয়েছেন ‘সেলফাইটিস’। রোগটির তিনটি ধাপ। প্রথম ধাপের নাম ‘বর্ডার লাইন সেলফাইটিস’। এ ধাপে আক্রান্তরা দিনে অন্তত তিনটি সেলফি তুলবে এবং তা নিজের কাছেই রেখে দেবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করবে না। দ্বিতীয় ধাপে ‘একিউট সেলফাইটিস’। এ ধাপে আক্রান্তরা দিনে অন্তত তিনটি সেলফি তুলবে এবং তিনটি ছবিই সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করবে। আর তৃতীয় ধাপকে বলা হয় ‘ক্রনিক সেলফাইটিস’। এ ধাপে আক্রান্তরা সারাদিনে নিয়ন্ত্রণহীন তাড়না বা ইচ্ছা থেকে বিরামহীনভাবে যখন-তখন সেল্ফি তুলবে এবং দিনে অন্তত ছয়টি বা এর বেশি সেল্ফি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করবে। অন্যদিকে মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, বেশি সেল্ফি তোলা ব্যক্তিত্বহীনতার পরিচয়। এদের বেশিরভাগই ছবি দিয়ে নানা ব্যর্থতা ঢাকে।
এ রোগ সারানোর ওষুধ কী?
বিজ্ঞানী ও গবেষকরা রোগ ধরতে পারলেও রোগী সারানোর ওষুধ বাতলে দিতে পারছেন না। তবে সেলফাইটিসদের কাছ থেকে সাবধান থাকার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। সেল্ফি এলবো একবার দেখা দিলে তা আর সারে নাÑ এ পরামর্শও দিচ্ছেন।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমসের এক খবরে বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত সেল্ফি তোলার অভ্যাসের সঙ্গে মানসিক ব্যাধির সম্পর্ক থাকতে পারে। সেই বিবেচনায় সাময়িক চিকিৎসা হিসেবে কগনিটিভ বিহেভিয়েরাল থেরাপিÑ সিবিটি কাজে লাগতে পারে। এই থেরাপি নেয়া ক’জনের পক্ষে সম্ভব? এছাড়া এ রোগে আক্রান্তদের ‘রোগী’ বলাও কি সম্ভব? তেড়ে এলে ঠেকাবে কে?
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন, ঢাকা।