ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাঠ প্রশাসন নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। রাজনৈতিক দলগুলো অভিযোগ তুলছে, নিরপেক্ষতা নয়, বরং দলীয় আনুগত্যই যেন নিয়োগের প্রধান মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক দলগুলো ততই দলীয়করণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে, অভিযোগ তুলছে। বিশেষত রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে এই মাঠ প্রশাসন নিয়ে উদ্বিগ্ন দলগুলো পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করা হচ্ছে যে সরকারের গত এক বছরে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং মাঠ প্রশাসনে ‘একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের’ অনুগত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও পদায়ন করা হয়েছে।
নতুন জনপ্রশাসন সচিব নিয়োগের পর দলীয়করণ-সংক্রান্ত এই বিতর্কের পালে তীব্র হাওয়া লেগেছে। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তিনি ‘একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের’ আদর্শে বিশ্বাসী কর্মকর্তা। অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গত এক বছরে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসনে ‘একটি বিশেষ দলের অনুগতদের’ পদায়নে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এর পেছনে তাদের অনুগত উপদেষ্টাদের সমর্থন রয়েছে। এ অবস্থায় দলটির পক্ষ থেকে নির্বাচনের আগে প্রশাসনকে ‘নিরপেক্ষ’ করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হচ্ছে। দুটি দলের এমন পাল্টাপাল্টি অভিযোগের কারণে প্রশাসনে নিরপেক্ষতার সংকট সৃষ্টি হওয়ার এবং নির্বাচনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক পর্যালোচকেরা।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন সূত্র বলছে, জনপ্রশাসনে জ্যেষ্ঠ সচিব নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। রাজনৈতিক আনুগত্যের অভিযোগ ভিত্তিহীন। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন এখনো নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। যারা অভিযোগ করছেন, তাদের অনেকেই নিজের অনুগত কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। সরকার সেই চাপ উপেক্ষা করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম লক্ষ্য ছিল প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা। এ জন্যই প্রথম মাসে গঠন করা হয় একটি প্রশাসনিক সংস্কার টাস্কফোর্স। টাস্কফোর্সের প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়েছিল-রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রশাসনের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এর সমাধানে স্বচ্ছ নিয়োগ ও কর্মসম্পাদন মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, টাস্কফোর্সের সুপারিশগুলোর অগ্রগতি ধীর। অভিযোগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা পরিবর্তনের বিরোধিতা করছেন। কারণ এতে তাদের বিদ্যমান সুবিধা ও প্রভাব কমে যাবে।
অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, গত ১৪ মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে প্রশাসনে বেশ কিছু বড় পরিবর্তন এসেছে। ৩২ জন নতুন ডিসি নিয়োগ হয়েছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন এর আগে রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল পদে ছিলেন। ১৫টি মন্ত্রণালয়ে সচিব রদবদল ঘটেছে। জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার ও তথ্য মন্ত্রণালয়ে নতুন সচিব নিয়োগ হয়েছে। ৫৩ জন অতিরিক্ত সচিবের পদোন্নতি ঘটেছে। এসব পদোন্নতির কয়েকটি নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। গত ১২ মাসে মোট ৪১৮টি পদে বদলি বা পদায়ন ঘটেছে। যা বিগত তিন বছরের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন মাঠ প্রশাসনের তালিকা তৈরি শুরু করেছে। কিন্তু অভিযোগ উঠছে, ওই তালিকাতেও একটি নির্দিষ্ট দলের প্রভাব পড়েছে। বিএনপি বলছে, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরিতেও স্পষ্ট দলীয় প্রভাব দেখা দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে অবাধ নির্বাচন সম্ভব নয়। তবে সরকারের এক উপদেষ্টা এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন, ‘বিএনপি এখন থেকেই প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ ছড়াচ্ছে। এটি আসলে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার আগাম অজুহাত।’
সরকারের একাধিক সূত্রমতে, নিরপেক্ষ প্রশাসন সাজানোর প্রক্রিয়ায় ড. ইউনূস সরকারের সামনে এখন সবচেয়ে বড় পরীক্ষা বিশ্বাসযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা রক্ষা। রাজনৈতিক চাপ, উপদেষ্টাদের প্রভাব এবং আসন্ন নির্বাচনজনিত পরিস্থিতি-সব মিলিয়ে প্রশাসন এখন এক কঠিন সন্ধিক্ষণে। তবে নির্বাচনকে অর্থবহ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ করতে হলে সরকারকে দলনিরপেক্ষ প্রশাসনের পথে হাঁটতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।