Thikana News
১৭ অক্টোবর ২০২৫
  1. ই-পেপার
  2. চলতি সংখ্যা
  3. বিশেষ সংখ্যা
  4. প্রধান সংবাদ
  5. আমেরিকার অন্দরে
  6. বিশ্বচরাচর
আমেরিকা শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৫

‘সেফ এক্সিট’ ইস্যুতে দেশে নতুন বিতর্ক

‘সেফ এক্সিট’ ইস্যুতে দেশে নতুন বিতর্ক



 
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে যখন উত্তাপ বাড়ছে, ঠিক তখনই ‘সেফ এক্সিট’ (নিরাপদ প্রস্থান) ইস্যুতে দেশে সৃষ্টি হয়েছে নতুন বিতর্ক। গত ৪ অক্টোবর একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম দাবি করেছেন, অনেক উপদেষ্টা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এবং নিজেদের সেফ এক্সিট নিয়ে ভাবছেন। নাহিদ ইসলামের এমন বক্তব্যে সচিবালয়সহ সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়। পর্দার আড়ালে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা নিয়ে কানাঘুষা চলছে সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও। সারা দেশে এ নিয়ে নানা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
এদিকে নাহিদ ইসলামের মন্তব্যের সূত্র ধরে প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেছেন এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক এবং জুলাই আন্দোলনের আরেক শীর্ষ নেতা সারজিস আলম। তিনি বলেছেন, ‘কিছু উপদেষ্টার মাঝে আমরা এই আচরণ দেখতে পাচ্ছি যে, তারা এখন কোনোভাবে দায়সারা দায়িত্বটা পালন করে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এক্সিট নিতে পারলেই হলো। দেশে থাকুন আর দেশের বাইরে থাকুন; এই দায়সারা দায়িত্ব নেওয়ার জন্য অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি সরকার কাজ করতে পারে না।’
তাদের এ ধরনের বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক নেতারা পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা করছেন। প্রতিদিনই কোনো না কোনো উপদেষ্টা এই ইস্যুতে বক্তব্য দিচ্ছেন। নাহিদ ইসলামের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় এ পর্যন্ত অন্তত আটজন উপদেষ্টা প্রকাশ্যে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাদের মধ্যে আছেন প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন, মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তাদের মধ্যে উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বক্তব্যের সপক্ষে নাহিদ ইসলামকে তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরার আহ্বান জানান।
আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘বর্তমানে অনেকেই সেফ এক্সিটের কথা আলোচনা করছেন। আসলে উপদেষ্টা হিসেবে সেফ এক্সিটের প্রয়োজন নেই। তবে এখনকার রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে এই জাতির সেফ এক্সিট হওয়া দরকার।’
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘আমার ছেলেমেয়ে সবাই দেশে। আমি একা সেফ এক্সিট নিয়ে কী করব? বিদেশে কার কাছে যাব?’
সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মোহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘৭২ বছর বয়সে সেফ এক্সিট, ভাবার প্রশ্নই আসে না।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেছেন, ‘আমি নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেফ এক্সিট আমার জন্য নয়। আমি এ দেশেই থাকব। বছরের পর বছর আমাদের সমাজে যে বৈষম্য ও অধিকার বঞ্চনার চিত্র ছিল, সেখান থেকে জাতির একটি সেফ এক্সিট নিশ্চিত করতে আমরা সবাই মিলে কাজ করছি। জাতি যেন ন্যায়, সমতা ও মানবিকতার পথে এগিয়ে যেতে পারে- এটাই আমাদের লক্ষ্য।’
ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, ‘আমরা কোথায় দেশ থেকে পালাব, আমার ঢাকা শহরে কোনো বাড়ি নেই। চট্টগ্রাম শহরেও কোনো বাড়ি নেই। তো আমি সেফ এক্সিট নিয়ে কি বাইরে রাস্তায় গিয়ে শুয়ে থাকব। এই দেশটা আমার। আমরা যদি একটা নির্বাচিত সরকারকে দায়িত্বটা বুঝিয়ে দিতে পারি, সেটা আমাদের বড় সফলতা। এটা আমাদের জন্য কৃতিত্ব। সেফ এক্সিটের কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা কোনো অপরাধ করিনি, কোনো টাকা লুট করিনি যে আমাদের লুকিয়ে থাকতে হবে।’
মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, ‘উপদেষ্টাদের সেফ এক্সিটের দরকার আছে বলে মনে করি না। একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে এই সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। উপদেষ্টাদের সেফ এক্সিট বা নিরাপদ প্রস্থানের দরকার নেই।’
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘নাহিদ ইসলামের বক্তব্যটা স্পেসিফিক হলে হয়তো সরকারের পক্ষ থেকে কথা বলা যেত। এখানে তো সরকারের বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমি কোনো সেফ এক্সিট খুঁজছি না। সারা জীবন এ দেশেই থাকব।’
এ বিষয়ে এক ফেসবুক পোস্টে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘যাদের একাধিক দেশের পাসপোর্ট, নাগরিকত্ব নেওয়া, তারাই আবার অন্যদের সেফ এক্সিটের তালিকা করে।’ আসিফ আরও বলেন, ‘যারা ৫ আগস্ট পালিয়েছিল, তাদের সিমপ্যাথাইজাররা কষ্টে মরে যাচ্ছে। বারবার ফ্যাসিস্টদেরই পালাতে হবে। আমাদের জন্ম এ দেশে, মৃত্যুও এ দেশের মাটিতেই হবে। ফ্যাসিস্ট, খুনিদের সঙ্গে লড়তে লড়তে আমার ভাইদের মতো শহীদি মৃত্যুই কামনা করি।’
সেফ এক্সিট সংক্রান্ত বিতর্ক নিয়ে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাও। একটি টেলিভিশন টক শোতে অংশ নিয়ে রুমিন বলেন, ‘উপদেষ্টারা অনেকেই এখন সেফ এক্সিট খুঁজছেন। তবে আমার মনে হয়, তাদের খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না, কারণ ম্যাক্সিমাম উপদেষ্টাই ডুয়েল সিটিজেনশিপ নিয়ে চলছেন। ফলে তারা দেশের বাইরে অটোমেটিক্যালি চলে যেতে পারবেন।’
বিতর্কের মুখে এনসিপি নেতারা বলছেন, সেফ এক্সিট নিয়ে নাহিদ ইসলাম যা বলেছেন তা অজানা গোপন কিছু নয়। বরং বিষয়গুলো একেবারেই দৃশ্যমান। যতই দিন যাচ্ছে কয়েকজন উপদেষ্টার ভূমিকা পরিষ্কার হচ্ছে। তারা রীতিমতো একটি রাজনৈতিক দলের আজ্ঞাবহ হয়ে উঠছেন। হয়তো তারা ধরেই নিয়েছেন নিশ্চিতভাবে তাদের পছন্দের দল ক্ষমতায় আসছে। অথচ তারা শত শত লাশের ওপর পা দিয়ে ক্ষমতার চেয়ারে বসেছেন।
নাহিদ-সারজিসের এমন মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে দলের সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিচার ও সংস্কার- জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এই দুই আকাক্সক্ষা পালনের দায়িত্ব নিয়ে তা পূরণ না করে কোনো কোনো উপদেষ্টা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বাঁচতে চান। নাহিদ কিংবা সারজিস সেই বিষয়টিই বলেছেন।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কয়েকটি কারণে ‘সেফ এক্সিট’ শব্দটি হঠাৎ আলোচনায় এসেছে। এটি মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রিক টানাপোড়েন ও পারস্পরিক অবিশ্বাস, আসন্ন নির্বাচনের আগে অবস্থান শক্ত করা, উপদেষ্টাদের মধ্যে দায়িত্ব ও মতবিরোধ, মিডিয়া ও জনমতের প্রভাব তৈরি করার কৌশল। তারা বলছেন, সেফ এক্সিট বিতর্ক পুরোটাই রাজনৈতিক; আগামী নির্বাচন ও রাজনীতির গতি-প্রকৃতিকে প্রভাবিত করতেই মূলত এই আলোচনা জোর পেয়েছে। অন্যদিকে নাহিদ ইসলাম এই সরকারেরই একজন সাবেক উপদেষ্টা। তার কাছ থেকে যখন এ ধরনের মন্তব্য আসে, তখন সেটা নিঃসন্দেহে গুরুত্ব পায়।

কমেন্ট বক্স