পাকিস্তান বা তারও আগে ব্রিটিশ আমলের কথা বাদ। ১৯৭১ সালে সাধারণ বাঙালিরা এক সাগর রক্ত দিয়ে পেল স্বাধীন বাংলাদেশ। এরপর বাঙালির মুখে শুরু হলো বাঙালির দুঃখ মোচনের গল্প। অনেক ভাঙচুর, ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে আছে রক্তস্নাত হাড় জিরজিরে বাংলাদেশ ‘আমার সোনার বাংলা। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ শোনালো ব্যর্থ পরিহাস। ‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে’ নিজেকে যারা লেনিন মনে করলেন, তারাই হয়ে উঠলেন হিটলার, মুসেলিনি, চেঙ্গিসখাঁ উত্তর সূরি।
‘তিন বছর কিছু দিতে না পারার নির্দেশ নতশিরে মেনে নিল নিম্নবর্গের মানুষ। দিতে না পারার নির্দেশদাতারা অস্তিনের নিচে, পকেট ভরে আঁচল ভরে চেটে পুটে খেয়ে মুখ মুছে মহারাজারা সাধু হয়ে গেলেন। এলো দুর্ভিক্ষে জাদুঘরে পাঠানোর গল্প। দুর্ভিক্ষ জাদুঘরে না গেলেও, অপুষ্টিতে, অনাহারে ভোগা মানুষেরা দর্শনীয় জন্তু হয়ে চিড়িয়াখানায় স্থান পাওয়ার মতো হলো। রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, দালাল মোসহেবদের চক্রে ‘ভগবান ভূত’ হওয়ার অবস্থা। শান্তি নেই, শৃঙ্খলা নেই, জানমালের নিরাপত্তা নেই। এক দিকে ‘শান্তির ললিত বাণী’, অন্য দিকে জনপদে সর্পদের বিষ নিঃশ্বাস। কথা বলা যাবে না। বলতে গেলেই পিঠে সপাং সপাং চাবুকের কশাঘাত।
এবার গরিবের ভাগ্য বদলের কিছু গল্প শোনা যায়। ইতিহাস বলে : গজনীর সুলতান মাহমুদ ১৭ বার বাংলায় ডাকাতি করে বিপুল সম্পদ লুটপাট করে নিয়ে যায়। ব্রিটিশ ২০০ বছর শাসন করে এ জেন কী করেনি। বাংলায় গোলাবারুদের প্রাচীন সংস্করণের তেজ দেখিয়ে বাংলার রূপাসাগরে সব নিয়ে গেছে। মাঝ দিয়ে শত শত রাজা, মহারাজা, জমিদার, জোতদার আসা যাওয়ার পথে কত কিছু খেয়ে গেল, নিয়ে গেল। সবাই প্রজা অন্তপ্রাণ। প্রজাদের জন্যই তাদের দেয়ার প্রতিশ্রুতি। কিন্তু সে ধন-সম্পদের সে গোলায় প্রজাকুলের ‘প্রবেশ নিষেধ’।
এরপর বাঙালিকে শাসন করার সুযোগ এলো বাঙালি শাসককুলের। দূর হলো পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক দুঃশাসন। নিপীড়ন, নির্যাতন, জেল-জুলুম, বঞ্চনা-প্রতারণা। বাঙালির হাতে নতুন বন্দোবস্ত, নতুন কথা। নতুন আশা। বাঙালি হাসলো, স্বপ্ন দেখলো। জেল-জুলুম সয়ে যেসব অসাধারণ বাঙালিকে সাধারণ বাঙালি জান দিয়ে, মান দিয়ে স্বাধীন একটা দেশ দিলো, সেই স্বপ্নদ্রষ্টার হাতেই নতুন রূপে, নতুন নামে লুট হয়ে গেল তাদের মুক্তির আকাক্সক্ষা। একবার নয়, বারবার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের আস্থা ভরসা মাঠে মারা যাচ্ছে, ‘যা নেবে তাই ছ’ আনা’ ফেরিওয়ালাদের পুতুল নাচের তালে।
এবার কিছু কথা ফ্যাসিবাদ রুখে দেয়ার আকাক্সক্ষা নিয়ে। সবাই ফ্যাসিবাদ রুখে দিতে চায়। এ পক্ষ, সে পক্ষ, সব পক্ষ। ’২৪-এর জুলাই আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এ ফ্যাসিবাদ দূর হয়েছে দাবি করছে নতুন আন্দোলনে জয়ীরা। আবার যারা তখন পালিয়েছিল, সেই পতিতরা এখন নতুন ফ্যাসিবাদ রুখে দিতে নিজেদের ঐক্য সুদৃঢ় করার আহ্বান জানাচ্ছে। ফ্যাসিবাদ কি তাতে দূর হচ্ছে? হচ্ছে না। বরং আরও বেশি করে জনজীবনে ফ্যাসিবাদ জেঁকে বসছে চার দিক থেকে নতুন নামে, নতুন চেহারায়।
আসলে মানুষ সব করতে পারলেও বিধিলিপি ভাঙতে পারে না। বিধিলিপি খণ্ডানো নাকি একটি দুঃসাধ্য বিষয়।