বিরোধী মতসহ বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচিত এখন আদালতাঙ্গন। তার ওপর রাজনীতির তাবৎ বিষয়াদি নিয়ে তোলা হচ্ছে আদালতে। এরই মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য সরানোর নির্দেশ দেওয়াকে কেন্দ্র করে এজলাস কক্ষে দুই পক্ষের আইনজীবীদের হট্টগোলে পালানোর মতো এজলাস ছেড়ে যান দুই বিচারপতি। যাদের একজন আইনজীবী থাকার সময় প্রধান বিচারপতির দরজায় লাথি মারার জন্য বহুল আলোচিত। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগে সম্পৃক্ত আরেক বিচারপতি নিজেদের ‘শপথবদ্ধ রাজনীতিক’ মন্তব্য করে রীতিমতো বোমা ফাটিয়েছেন। বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা একে একে বিচারপতিদের প্রতি অনাস্থা প্রকাশে নেমেছেন। দুই বিচারপতির বিরুদ্ধে এ ধরনের আচরণ করায় বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছে আপিল বিভাগে।
উত্তেজনাকর এমন পরিস্থিতিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসও এখন আদালতের আইটেম। তাকে জেলে নিয়ে ছাড়ার সরকারি আয়োজন ও তৎপরতা স্পষ্ট। বিষয়টি উপলব্ধি করে ১০০ জনেরও বেশি নোবেল বিজয়ীসহ ১৬০ জনেরও বেশি বিশ্বনেতা চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে। এতে স্বাক্ষর করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস-হোর্তা, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুনের মতো ব্যক্তিত্ব। ওই চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের একজন রেজাল্টস অ্যান্ড সিভিক কারেজের প্রতিষ্ঠাতা স্যাম ডেলি-হ্যারিস এক বিজ্ঞপ্তিতে চিঠিটি প্রকাশ করেছেন। চিঠিতে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদও দেওয়া হয়েছে। এ নিয়েও তীব্র উষ্মা সরকারের। ড. ইউনূসের পক্ষে ১০০ নোবেল বিজয়ীর বিবৃতিকে দেশের বিচারব্যবস্থার ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ বলে জানানো হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনÑদুদকের আইনজীবী দিয়ে। শুধু তা-ই নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, আত্মবিশ্বাস থাকলে ড. ইউনূস আন্তর্জাতিক বিবৃতি ভিক্ষা করে বেড়াতেন না। সরকার কোনো বিবৃতিতে প্রভাবিত হবে না। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা আইন অনুযায়ী চলবে।
এর আগের ৪০ জনের বিবৃতির সঙ্গে এবারেরটির কিছু তফাত লক্ষণীয়। এতে কেবল ইউনূসকে রক্ষা নয়; বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকট, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সরকারের বৈধতার ঘাটতির কথাও এসেছে। এমন ব্যাপক পরিসরে আগে আর কখনো তিনটি বিষয় একসঙ্গে আনা হয়নি। কান টানতে গিয়ে মাথা কাটার এ অবস্থা সরকারের জন্য বিরক্তিকর। অ্যালার্মিংও। ইউনূস প্রশ্নে সরকার নাছোড়বান্দা। শ্রমিকদের পাওনা টাকা পরিশোধ না করায় আরও ১৮টি মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে গ্রামীণ টেলিকমের ১৮ জন শ্রমিক বাদী হয়ে আলাদা মামলাগুলো করেন। এসব মামলায় ড. ইউনূসকে আর হয়রানি না করতে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠির শুরুতে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’ সম্বোধন করে লেখা হয়েছে, ‘আমরা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, নির্বাচিত কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের নেতার পাশাপাশি বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে লিখছি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে আপনাদের জাতি যেভাবে প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে, আমরা তার প্রশংসা করি। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি যে হুমকি দেখেছি, তাতে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা বিশ্বাস করি, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া এবং নির্বাচনে প্রশাসন দেশের সব বড় দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগের দুটি জাতীয় নির্বাচনে বৈধতার অভাব ছিল।’
‘ড. ইউনূসকে টার্গেট করা হয়েছে’ মন্তব্য করে বলা হয়েছে, ‘এতে আমরা উদ্বিগ্ন। এটা ক্রমাগত বিচারিক হয়রানি বলেই আমাদের বিশ্বাস।’ এ ধরনের বক্তব্যের প্রতিটি শব্দ সরকারের জন্য বিষের মতো। তার ওপর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইন বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা রাখার সুযোগসহ বাংলাদেশ থেকে ‘নিরপেক্ষ বিচারকদের’ একটি প্যানেল দ্বারা অভিযোগের পর্যালোচনা করার কথাও বলা হয়েছে। চিঠির সমাপ্তিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আশাবাদে বলা হয়েছে, ‘আসছে দিনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন এবং সব ধরনের মানবাধিকারের প্রতি সম্মান নিশ্চিত করবেন। সামনের দিনগুলোতে কীভাবে এই বিষয়গুলোর সমাধান করা হয়, তা ঘনিষ্ঠভাবে নজরে রাখার জন্য আমরা বিশ্বের লাখ লাখ উদ্বিগ্ন নাগরিকদের শিবিরে যোগ দেব।’ এসব ভাষা সরকারকে রীতিমতো ওয়ার্নিং। স্বাভাবিকভাবেই তা সরকারের জন্য অসহ্যের ও বিব্রতকর। এ ছাড়া চিঠিতে ড. ইউনূসের নানা প্রশংসা তো আছেই। এরই মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বিচারিক ‘হয়রানির’ বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। ২৮ আগস্ট জাতিসংঘের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বিচারিক হয়রানির অভিযোগ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক এ কথা বলেন।
সরকারের বিরক্তির বিপরীতে বিএনপি ড. ইউনূস প্রশ্নে বেশ পুলকিত। ড. ইউনূসকে জাতির সূর্যসন্তান আখ্যা দিয়ে তাকে হেনস্তা না করার দাবি জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই জাতির একজন সূর্যসন্তান। শত বছর পরেও এই জাতির মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে এবং লজ্জিত হবে এই ভেবে যে, এ রকম বরেণ্য একজন মানুষের সাথে দেশের সরকার কী রকম নীচ আচরণ করেছিল।’ ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে করা সব মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে ফখরুল বলেন, ‘তিনি দেশের একজন কীর্তিমান ব্যক্তি। তাঁকে যারা ছোট করতে চান, অপমান করতে চান, তারা আরেকবার জন্ম নিলেও তাঁর (ড. ইউনূস) সমান উচ্চতায় যেতে পারবেন না। এই অনিবার্য সত্যটা মেনে নিয়ে ওনাকে হেনস্তা করা বন্ধ করুন। এসব মামলাবাজি বন্ধ করুন।’ ইউনূস ইস্যুতে বিএনপি পুলকিত হলেও ভেতরের খবর হচ্ছে দলটি ক্ষমতার জন্য প্রস্তুত নয়। তারা একটি ট্রানজিট পিরিয়ড চায়। মধ্যবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের বাইরে অন্য কাউকে ক্ষমতায় দেখতে আগ্রহী বিএনপি। দেশি-বিদেশি হিতাকাক্সক্ষীদের নির্দেশনাও তেমনই। প্রথমে বিএনপিকে মাঠে নামানো হয়েছিল নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ের জন্য। এখন সেখান থেকে অনেকটা সরে গেছে তারা। এ ছক বুঝে বিএনপির কর্মসূচির সমান্তরালভাবে আওয়ামী লীগ রাজপথে থেকে উপরন্তু বিএনপিকেই কোণঠাসা করে ফেলেছে। এরপর পশ্চিমা দেশগুলোর একটি ফর্মুলা ছিল, নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া। আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে একমত হয়নি। বরং আওয়ামী লীগ পারলে নির্বাচন আরও এগিয়ে আনে। সুশীল সমাজ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন মহল আওয়ামী লীগ সরকারের অবসান চায়। একটি বিকল্প বা জাতীয় সরকারের ভাবনাও আছে তাদের মনমগজে। জাতীয় পার্টির একটি গ্রুপেরও এতে সায় আছে। রাজনৈতিক শূন্যতার মাঝে শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনের স্বপ্ন তাদের। সামাজিক আন্দোলন হলো নতুন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার একটি দলীয় প্রচেষ্টা। রাজনৈতিক ও সামাজিক চাঞ্চল্য থেকে এর সূচনা হয়। তা প্রশাসন, বিচার বিভাগ, শিক্ষাঙ্গন যেকোনো জায়গা থেকেই বিস্ফোরণের মতো সূচনা হতে পারে। প্রচলিত একঘেয়ে ব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ এবং নতুন জীবনব্যবস্থার আশার আলো সামাজিক আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি। এ প্রশ্নে সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ড. ইউনূস এক আপদ। এ আতঙ্ক কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না সরকারকে।