আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রধানত তার তিনটি অঙ্গ থাকা আবশ্যক। এ তিনটি অঙ্গ হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ (এক্সিকিউটিভ), আইন বিভাগ (লেজিসলেচার) এবং বিচার বিভাগ (জুডিশিয়ারি)। আর যত বিভাগ ও উপবিভাগ আছে, তার সবই এই তিনটি প্রধান বিভাগ বা অঙ্গের অধীনে। প্রশাসনিক সকল কর্ম পরিচালার জন্য তিনটি নির্বাহী বিভাগ। আইন বিভাগ বা জাতীয় সংসদ দ্বারা দেশের সকল আইন প্রণীত হয়। আর সব আইন কর্মে প্রয়োগ করে বিচার বিভাগ। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বলা হয় রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ হবে একে অন্যের থেকে স্বাধীন। সকল অঙ্গ স্বাধীনভাবে পরিচালিত হবে। কেউ কাউকে নিজের অধীন ভাবতে পারবে না।
আরও একটি অঙ্গ আছে, আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনায় তার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অন্য তিনটি থেকে কম নয়। বরং কোনো কোনো দিক থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেটি ‘গণমাধ্যম’। গণমাধ্যমকে বলা হয় ‘ফোর্থ স্টেট’। এই ফোর্থ স্টেটকে গণ্য করা হয় জাতির বিবেক বা রাষ্ট্রের আয়না হিসেবে। রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগ এবং অন্যান্য বিভাগ ও উপবিভাগ তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না, তার ওপর নজর রাখে। বিশেষ করে, নির্বাহী বিভাগ নিজে স্থায়ীভাবে এবং অন্যদেরকেও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিচ্ছে কি না, তা নজরদারি করে। কেননা সব সময় নির্বাহী বিভাগই বিভাগ-উপবিভাগের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে তাদেরকে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ হরণ করে নেয়। বিশেষ করে, এ রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে নির্বাহী বিভাগের হাতে এবং দেশ হোক বিদেশ হোক, অনুন্নত তো বটেই, উন্নয়নশীল অনেক দেশেও গণমাধ্যমের পরিবেশ কমবেশি এ রকমই। সরকারের প্রধান নির্বাহী সব ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করে একক ক্ষমতা নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় যত মত্ত হবেন, রাষ্ট্র ততই হয়ে ওঠে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্র তখন কারও হাতেই দেখতে চায় না কোনো ক্ষমতা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একটি কথা আছে, ‘উইনার টেক্স অল।’ তখন উইনার হওয়ার কৌশলও তাদের হস্তগত থাকে। কেননা তখন রাষ্ট্রের পুলিশ, ডিসি, এসপি এমনকি নির্বাচন পরিচালনায় সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ক্ষমতাসীন দলের ইশারায় পরিচালিত হয়। রাষ্ট্রের সবকিছুই চলে সরকার প্রধানের দ্বারা। সে সময়টায় রাষ্ট্র, দল-ক্ষমতাসীন দলের নেতা-পাতিনেতার ক্ষমতাবলয়ে চলে আসে। সে রকম রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানকে একনায়ক মনে করা হয়।
তখন ক্ষমতাবলয়ে সবকিছু একাকার হয়ে যায়। গণতন্ত্রের অনন্য সৌন্দর্য কার্যকর বিরোধী দলের অস্তিত্ব তখন লোপ পায়। পুলিশ, সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র-যুব-শ্রমিক সংগঠনের সব সদস্যও ক্যাডার বাহিনী বা ঠাঙারে, হেলমেট -নানা বাহিনীতে রূপ নেয়। রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, দলের প্রধান হয়ে আবির্ভূত হন একক ব্যক্তি। ‘সবার উপর মানুষ সত্য’-অসত্য হয়ে যায়। জনগণ তখন আর একক ক্ষমতাধর ব্যক্তির নজরে আসে না। জনগণ আর গণ্য বলে বিবেচিত হয় না। চেক অ্যান্ড ব্যালান্স বলতে কিছু থাকে না।
গণমাধ্যমও সেই দুঃসহ সময়ে নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্য ভুলে একক শক্তি বা সর্বক্ষমতার অধিকারীর আরাধনার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। তখন এক গণমাধ্যমের সঙ্গে অন্য গণমাধ্যমের ক্ষমতা তোষণের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। সাংবাদিকেরাও তখন লোভ-লালসায় কিংবা ভয়ে বশংবাদে পরিণত হন। প্রাপ্তি প্রতিযোগিতায় তারাও তখন জ্ঞানশূন্য হয়ে যান। গণমাধ্যম তখন নিজের শক্তি, সাহস, ক্ষমতা, মর্যাদা, দায়িত্ব সব হারিয়ে ফেলে। রাষ্ট্র ও সমাজও অধঃপতনের দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু চিরদিন এই অবস্থা থাকে না। সকল অগণতান্ত্রিক শক্তির অজান্তে যে তাদের পায়ের নিচে মাটি সরে যেতে থাকে, ক্ষমতা-অন্ধ শক্তি তা বুঝতে পারে না। এক দিন জনগণের সামান্য ধাক্কাতেই তাদের সাম্রাজ্য ধসে পড়ে।
সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম স্বাধীনতা হারালে গণতন্ত্রও অর্থহীন হয়ে পড়ে। আমরা স্বদেশে, ভিন্ন দেশে অহরহ একনায়কদের পরিণতি দেখতে পেলেও তা থেকে শিক্ষা নিতে পারি না। প্রবাদে বলে, ‘ইতিহাসের বড় শিক্ষা, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।’ রাষ্ট্রনায়ক, রাষ্ট্রপরিচালকেরা সবাই যেদিন ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারবেন, সেদিনই এই বিশ্বটার চেহারা পাল্টাবে নিশ্চিত। তবে সামনে তাকালে দেখা যায়, দিন যত গত হচ্ছে, সেই প্রত্যাশার জায়গাটাও আঁধারে আচ্ছন্ন দেখা যাচ্ছে। বাংলার প্রবাদ ‘যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ।’ বাঙালিদের বিধিলিপি যেন সেই প্রবাদেই বাঁধা।