১৩ বিলিয়ন ডলার দিয়ে শুরু করেছিলেন ক্ষমতা যাপন। ২০২৪-এর ৯ আগস্ট থেকে জুলাই ২০২৫। প্রায় একবছরে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রিজার্ভ। অর্থনীতির সূচক আশাব্যাঞ্জক হলেও রাজনীতিতে হতাশা। বরং রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের সরাসরি অভিযোগ। এছাড়া গোপালগঞ্জ কেলেংকারি থেকে ‘মাইলস্টোন’ শিক্ষালয়ে বিমান পতন। লাশের ভেলায় ঢাকা বিভাগ থেকে রাজধানী কম্পমান। জুলাই ২০২৪-এর ছাত্র-গণ আন্দোলনের ‘ছায়া-প্রত্যাবর্তন’। দু’জন প্রভাবশালী উপদেষ্টা ঘটনাস্থলে ৯ ঘন্টা আটক। সরকারের তীর্থস্থান ‘সচিবালয়ে’ প্রতিবাদী তান্ডব। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বিব্রত। নানা সমীকরণে তিনি নিতে চান নতুন সিদ্ধান্ত। বিশেষ সূত্র মতে- খুঁজছেন নতুন ‘প্রধান উপদেষ্টা’। রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী এর নেপথ্য কারণ।
গোপালগঞ্জে হাসিনা যেভাবে জিতলেন
ভোটে আওয়ামী লীগ এখন ১৬%
১৬ জুলাই ২০২৫ ছিলো শহীদ আবু সাঈদ দিবস। ২০২৪-এর এই দিনে ৬ তরুণ হত্যার শিকার। হাসিনা সরকার-বিরোধী ‘কোটা আন্দোলন’ ঘুরে দাঁড়ায়। ৯ দফা থেকে এক দফা কর্মসূচি সফল হয়। আগস্ট ২০২৪ শতভাগ পতন হয় হাসিনা সরকারের। ৫ ফেব্রয়ারি ২০২৫ বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়ি ধ্বংস। অতঃপর নিষিদ্ধ করা হয় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এখন ‘এনসিপি’। ‘ন্যশনাল সিটিজেন পার্টি’- নতুন রাজনৈতিক দল। নির্বাচন কমিশনে জুলাই মাস পর্যন্ত ‘অনিবন্ধিত’। জুলাই আন্দোলনের স্মৃতিতে ৬৪ জেলায় ‘পথযাত্রা কর্মসূচি’। পীরগঞ্জস্থ শহীদ আবু সাঈদের সমাধি দিয়ে শুরু। গত ১৬ জুলাই পদযাত্রা ছিলো গোপালগঞ্জে। শহরে সংক্ষিপ্ত জনসভা করতে পারলেও তা সফল ছিলো না। ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে পদযাত্রা ব্যহত হয়। সেনা ও পুলিশ হেফাজতে এনসিপিকে খুলনা যেতে হয়। বাতিল হয় বৃহত্তর ফরিদপুরের শরিয়তপুর ও মাদারীপুর অভিযাত্রা। আঘাত ও প্রতিরোধে ঝরে পড়ে ৪টি প্রাণ। তথ্য মতে, ঘটনার নেপথ্যে ছিলো একাধিক ঘটনা। প্রথমত ভারত থেকে শেখ হাসিনা বিশেষ চাল দিয়েছিলেন। ৩/৪ দিন আগে এলাকায় ছড়িয়ে দেন বিশাল আতংক। যে, ‘বঙ্গবন্ধুর টুঙ্গিপাড়াস্থ সমাধি’ গুড়িয়ে দেয়া হবে। এনসিপি বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর ভেঙেছে। ছাত্রলীগ পুরোপুরি এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করিয়েছে। এবার পদযাত্রার নামে গোপালগঞ্জ ঢুকে তান্ডব চালাবে। তাই বঙ্গবন্ধুর সমাধি রক্ষার্থে প্রতিরোধ গড়তে বলেন এলাকাবাসীকে। এই আকুল আবেদনে দেশীয় অস্ত্রে-শস্ত্রে পুরো সাজ সাজ রব। গাছ কেটে প্রায় সব পথ বন্ধ করা হয়। শুধু আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ অন্যলীগ নয়- এলাকার অনেক নিরপেক্ষ মানুষও প্রতিরোধে সামিল হন।
যথাযথ গোয়েন্দা রিপোর্ট না থাকায় প্রশাসন ছিলো অপ্রস্তুত। তথাপি সেনা প্রশাসন ‘মন্দের ভালো’ ভূমিকায় ছিলেন। এনসিপির জনসভায় হাসনাত আব্দুল্লাহ তীর্যক শ্লোগান দেন। ‘মুজিববাদ মুজিববাদ, মুর্দাবাদ মুর্দাবাদ’- শ্লোগান প্রশংসিত/সমালোচিত হয়। এলাকায় প্রতিরোধ ঠেকাতে প্রশাসনকে মারমুখী হতে হয়। চারজনের প্রাথমিক মৃত্যুতে আওয়ামী শিবির তৎপরতা দেখায়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলা হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। ভারতীয় মুখপত্র আনুষ্ঠানিক উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর প্রতিও ছোড়া হয় চ্যালেঞ্জ। জাতিসংঘ শান্তিমিশনে বাংলাদেশকে নিষিদ্ধের অনুরোধপত্র যায়। বৃটেন থেকে ব্যারিস্টার নিঝুম মজুমদার বৈদেশিক তৎপরতা দেখান। আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট শম রেজাউল করিমও তৎপর। ইউনূস সরকারের আইনগত ত্রুটিসমূহ ফেসবুক, ইউটিউবে ছড়াচ্ছেন। যদিও একাধিক শ্রোতা এই কথকের তীব্র সমালোচক। তাদের মতে, শম রেজাউল একজন ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’। বায়োডাটামতে ১৯৭১-এ ওনার বয়স ছিলো মাত্র ৯ বছর। এছাড়া হাসিনা সরকারের গণপূর্তমন্ত্রী হয়েই অনিয়ম করেছেন। প্রথম মাসেই নিজের নামে ১০ কাঠার প্লট নেন ঢাকায়। খবর পেয়ে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী ওনাকে স্থানান্তর করেন। ‘গণপূর্ত’ থেকে বদলি করেন মৎস্য ও প্রানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে। উল্লেখ্য, ভারত হয়ে তিনি বৃটেনে আশ্রয় নিয়েছেন। সচেতন মহলের মতে গোপালগঞ্জে সরকারের হার হয়েছে। জনপ্রিয়তা কমেছে, এনসিপি ধাক্কা খেয়েছে। বরং শেখ হাসিনা কিছুটা অগ্রবর্তী হয়েছেন।
আওয়ামী লীগ বিষয়ে সম্প্রতি চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়েছে। ডিজিডিএফআই-এর সাবেক উর্ধতন কর্মকর্তা মুখ খুলেছেন। এফ আই করিম নামের কর্মকর্তা প্রামাণ্য তথ্য দিয়েছেন। বলেছেন, ২০১৪-এর নির্বাচনের দায়িত্ব ছিলো ডিজিএফআই-এর। ২০১২-এ বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুরে চলে জরিপ। বিদেশী একটি সংস্থার জরিপে মাত্র ১৯% ভোট আওয়ামী লীগের। পরে ডিজিএফআই জরিপ চালিয়ে ২২% দেখায়। তখন সিদ্ধান্ত হয় কারচুপির মাধ্যমে জিতবার। জাপার জে. এরশাদকে চিকিৎসাবন্দি করে চলে ভোটের নাটক। প্রতিবেশী দেশের পররাষ্ট্র সচিব ঢাকায় এসে হস্তক্ষেপ করেন। বিনাভোটে ১৫৪ আসন নিয়ে আয়োজিত হয় নির্বাচন। ভোটকেন্দ্রে ভোটকেন্দ্রে ছিলো সাজানো লাইন।
মি. করিম বলেন, ২০১৮-এর নির্বাচনী দায়িত্ব ছিলো পুলিশের ওপর। তারা আগের রাতেই ব্যালটবাক্স ভর্তি করে রাখে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ২২% ভোট আরো কমে গেছে। জুলাই আন্দোলনের পর এখন তা মাত্র ১৬%। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে তিনি এই তথ্য দিয়েছেন।
এনসিপিকে নিয়ে বিএনপি
-জামায়াত টানাটানি
আসন্ন নির্বাচন জোটগতভাবে করার প্রস্তুতি চলমান। যেকোন মূল্যে ‘এনসিপি’ সরকারি দল হতে চায়। জুলাই আন্দোলনের মুখ্য কুশীলব হিসেবে তারা ক্ষমতার ‘হকদার’। জামায়াতে ইসলামী তাই এনসিপিকে সঙ্গে-পাশে চায়। বরগুণার জামায়াত নেতার মেয়েকে উৎসর্গ করা হয়েছে। এনসিপির অন্যতম কর্ণধার সারজিস আলমকে ‘জামাই’ করেছে। তবে বিএনপিও এনসিপির জন্যে দরোজা খোলা রেখেছে। ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের বৃটেন-বৈঠকেও বিষয়টি ওঠে। একান্ত আলোচনায় ৫০টি আসন এনসিপিকে দিতে বলা হয়। ২৫-৩০টির বিষয়ে বিএনপি আগ্রহী বলে জানা যায়। সেক্ষেত্রে ২০২৬-এর ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের শর্ত ছিলো। সংস্কার ও হাসিনাগং-এর বিচারের বিষয়েও কথা হয়। বর্তমানে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে স্নায়ুর লড়াই চলছে। মূল বিষয় ‘এনসিপিকে’ পক্ষে রাখতে পারা না-পারা।
‘প্রধান উপদেষ্টা’ খুঁজছেন ড. ইউনূস
ফের ভারতের হাতে আমেরিকার লাগাম
২১ জুলাই থেকে রক্ত-গঙ্গা বইছে ঢাকায়। এফটি-৭ নামীয় প্রশিক্ষণ বিমানের অলক্ষুণে পতন। উত্তরার ‘মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজ’-এ কারবালা পরিস্থিতি। আগুন ঝলসানো শিক্ষার্থীদের করুণ আহাজারি। অর্ধশতাধিক লাশ ও তিনশতাধিক পঙ্গুত্বের দায়। সরকারের দু’জন উপদেষ্টা ঘটনাস্থলে গিয়ে আটক। ব্যর্থতার জন্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসও অপদস্ত হচ্ছেন।
অবশ্য ঘটনার অপর পিঠে সৃষ্টি হয়েছে নতুন চমক। ‘কূটনৈতিক শৈত্য’ কেটে সাড়া দিয়েছে ভারত। শোক প্রকাশ করে সহযোগিতা-সংহতি জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ‘বার্ন ইউনিটে’র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স পাঠাচ্ছেন। সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস পেয়ে বাংলাদেশ উৎফুল্ল। কারণ ভারতের সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সরকার আগ্রহী। ভারতের একটি ‘কূটনৈতিক চাল’ সরকারকে বিপদাপন্ন করেছিলো। হঠাৎ করেই বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন আচরণ উল্টোরথে। পণ্যের ওপর ৩৭% শুল্ক বহাল রাখার চাপ। সমাধান পেতে গম ও উড়োজাহাজ ক্রয়ের প্রস্তাব।
মুফতে পাওয়া চাল-গম এখন কিনতে হচ্ছে। আরো কিছু বিষয়ে মার্কিন আচরণ কিছুটা রহস্যময়। ঘটনার তদন্তে বেরিযে আসে নতুন তথ্য। ভারত ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে ড. ইউনূসকে পঁচিয়েছে। জানিয়েছে, তিনটি কারণে ‘ইউনূস প্রীতি’ বন্ধ করুন। প্রথমত তিনি ডেমোক্র্যাট তথা ক্লিনটন-হিলারি সমর্থক। দ্বিতীয়ত, তিনি চীনের কাছে বাংলাদেশকে ‘বন্ধক’ দিচ্ছেন। তৃতীয়ত, ট্রাম্প-বিরোধী ইলন মাস্ককে নিয়ে মাতামাতি করছেন।
তথ্যগুলো পেয়ে সারল্যমথিত ড. ইউনূস দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। আগে স্বাচ্ছন্দে বিদেশ সফর করতেন। এখন রাজীনতির কারণে প্রতিটি শহরে প্রতিবাদ। বৃটেনে নোবেল বিজয়ীর ছবি দিয়ে ডাস্টবিনও বানানো হয়েছে। হাসিনাপন্থীরা ওনাকে রাতদিন ‘সুদখোর, অবৈধ ক্ষমতাধারী’ বলছেন।
দেশের রাজনৈতিক জটিলতা নিয়ে তিনি অস্থির। দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়নি, বরং বিরোধ বেড়েছে। জুলাই ঘোষণা, সংস্কার এখনও চূড়ান্ত নয়। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন দিতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছেন। একদিকে ভোটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা চূড়ান্ত হয়নি। অন্যদিকে জামায়াত ঘোষণা করেছে ‘পিআর পদ্ধতি’। ভোটের অনুপাতে দলীয় আসন বন্টন। প্রধান দল বিএনপি তা মানে না। অন্যদিকে জামায়াত ও ধর্মপ্রধান দলগুলো একাট্টা। তাদের কথা, জনমতেয় প্রতিফলন ঘটাতে ‘পিআর পদ্ধতি’ উত্তম।
নতুন এই ইস্যুতে দ্বিধা-দ্বন্ধে ড. ইউসূস। বয়স বেড়ে এখন ৮৫ বছর অতিক্রান্ত। ক্ষমতা গ্রহণকালে বলেছিলেন ‘আমার চাকরিদাতা ছাত্ররা’। আন্দোলনের সেই তরুণ-তুর্কিরা এখন রাজনৈতিক চরিত্র। ‘এনসিপি’ দলের মাধ্যমে তারা সংসদ নির্বাচনে আসছে। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন এসেছে- এটি ইউনূস-বান্ধব দল। দু’জন ছাত্র উপদেষ্টা সরকারে এনসিপির প্রতিনিধিত্ব করছে। অর্থাৎ নির্বাচনে ‘অন্তর্বর্তী সরকার’ নিরপেক্ষ নয়। বিতর্কের বিষয়টি মাথায় নিয়েছেন ড. ইউনূস। তাই নিবাচনকালে ‘তত্ত্ববধায়ক সরকার’ গড়তে চান। তাতে প্রধান উপদেষ্টা করতে চান ‘তৃতীয়’ কাউকে। এজন্যে একজন ‘প্রধান উপদেষ্টা’ খুঁজছেন তিনি। বিএনপি অবশ্য এই গোপন তথ্যটি জানে। বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানও জানেন। উভয়ের ইচ্ছে বিএনপি সরকার গঠন করুক। তাতে ৫ বছরের রাষ্ট্রপতি হবেন নোবেলজয়ী ড. ইউনূস। যদিও ড. খোন্দকার মোশাররফ, মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর অনিচ্ছুক। তবে ঘনিষ্ঠদের মতে, ড. ইউনূস এমন পদায়নে ইচ্ছুক। কারণ প্রধানমন্ত্রীসম প্রধান উপদেষ্টা পদ পরিচালনা অত্যন্ত দূরুহ। অনেকটা ‘থ্যাংকলেস জব’ বলেই ইত্যবসরে প্রতীয়মান হয়েছে। তাই ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের প্রস্তুতির চূড়ান্ত করতে চান। সেনাপ্রধান জে. ওয়াকারুজ্জামানও তেমনটিই চেয়েছিলেন।