বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর শেষ পর্যন্ত ৩৫ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ১ আগস্ট থেকে এটি কার্যকর হওয়ার কথা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৭ জুলাই সোমবার চিঠি দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বিষয়টি জানিয়েছেন। নতুন বাণিজ্য চুক্তি না হলে এই শুল্ক কার্যকর হবে।
নতুন শুল্ক হার ঘোষণা করে ট্রাম্প বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশকে চিঠি দিয়েছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে আর যেসব দেশ শুল্কের খড়গে পড়েছে, তার মধ্যে রয়েছে লাওস, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, সার্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, বসনিয়া, হার্জেগোভিনা, মালয়েশিয়া, তিউনিসিয়া, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ শুল্কের মুখে পড়েছে মিয়ানমার ও লাওস। তবে ট্রাম্প আগেই ভিয়েতনামের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা বলেছেন।
এই ঘোষণাকে ট্রাম্প প্রশাসনের বাণিজ্য নীতির কঠোর অবস্থানের পুনরাবৃত্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটি কার্যকর হলে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্প গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে পারে। কারণ, ট্রাম্প প্রশাসনের এ পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অনেকটা কমিয়ে দেবে। যুক্তরাষ্ট্র হলো বাংলাদেশের পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় বাজার। এ ছাড়া এর প্রভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এমনটিই মনে করেন বিশেষজ্ঞ ও পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা।
যুক্তরাষ্ট্রের গার্মেন্টস আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত কম দাম, স্থিতিশীল সরবরাহ ও মানের কারণে বাংলাদেশমুখী। ট্রাম্পের ঘোষিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে একই পণ্যের দাম গড়ে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন ক্রেতারা বাংলাদেশের পরিবর্তে ভারত, ভিয়েতনাম বা মেক্সিকোর মতো বিকল্প দেশে ঝুঁকতে পারেন।
যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল থেকে আশা প্রকাশ করে বলা হচ্ছে, এ শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এখনো আলোচনা অব্যাহত আছে। ওয়াশিংটন ডিসিতে বুধবার (৯ জুলাই) যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরের (ইউএসটিআর) সঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বৈঠক করবেন। এ ছাড়া নতুন শুল্কহার নিয়ে ১০, ১১ ও ১২ জুলাই ইউএসটিআর-এর সঙ্গে নেগোসিয়েশন বৈঠক রয়েছে বাংলাদেশের। বৈঠকগুলোর পর শুল্কহার আরও কমে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রপ্তানি বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে দেশের মোট পোশাক রপ্তানির ১৮ শতাংশের বেশি পণ্য পাঠানো হয়, যার পরিমাণ প্রায় সাড়ে আট বিলিয়ন ডলার। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ৮৬৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১৮ শতাংশের কিছু বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের ৮৫ শতাংশের বেশিই তৈরি পোশাক।
গত ৩ এপ্রিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছিলেন ট্রাম্প। সে সময় বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। তবে দর-কষাকষির জন্য শুল্ক তিন মাস স্থগিত রেখেছিলেন তিনি। এত দিন বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার ছিল গড়ে ১৫ শতাংশ, এখন নতুন করে আরও ৩৫ শতাংশ শুল্ক বাড়ায় এটি দাঁড়াবে ৫০ শতাংশে। চড়া শুল্ক দিয়ে শীর্ষ বাজারটিতে টিকে থাকা নিয়ে ব্যবসায়ী মহলে চরম উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অনেকেই একে ‘বাণিজ্যিক ভূমিকম্প’ বলে উল্লেখ করছেন।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা ব্যর্থ হলে উচ্চ শুল্কের সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে বহু কারখানার ওপর; বিশেষ করে যেগুলো মার্কিন ক্রেতার ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের পণ্যগুলো আরও বেশি অপ্রতিযোগিতামূলক হয়ে পড়তে পারে, যার ফলে রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া তৈরি পোশাক খাতের সহায়ক শিল্প, যেমন প্যাকেজিং, পরিবহন এবং এর সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও এই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন।
তবে আগামী ১ আগস্ট থেকে শুল্ক কার্যকরের কথা বলা হলেও এই তিন সপ্তাহের মধ্যেও দর-কষাকষির সুযোগ থাকবে বলে চিঠিতে জানিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প বলেছেন, ‘এই সিদ্ধান্তই বহাল থাকবে, তবে তা ১০০ শতাংশ চূড়ান্ত নয়। কোনো দেশ যদি আমাকে ফোন করে ভিন্ন কোনো চুক্তির প্রস্তাব দেয় এবং সেটা আমার পছন্দ হয়, তবে চুক্তি করব।’ যদি এই শুল্ক আরোপের প্রভাবে বাংলাদেশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করে, তাহলে যে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, সেটির সঙ্গে আরও শুল্ক আরোপ করা হবে বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এখনই কিছু বিকল্প উদ্যোগ নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আলোচনার গতি বাড়াতে হবে, শুল্ক সুবিধা পুনরায় পেতে জোরালো কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে, বিকল্প বাজার (চীন, রাশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা) তৈরি করতে হবে, উচ্চমূল্যের পণ্য এবং ব্র্যান্ডভিত্তিক উৎপাদনে মনোযোগ দিতে হবে, পণ্যের বৈচিত্র্য এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকে মনোযোগ জরুরি। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা শুল্কের কারণে আমাদের রপ্তানিতে অবধারিতভাবে প্রভাব পড়বে। এখন ভিয়েতনামের সঙ্গে আমাদের ১৫ শতাংশ শুল্কের পার্থক্য। স্বাভাবিকভাবেই তারা ভালো করবে। যদি ভারত, পাকিস্তান ও চীনও শুল্কের পরিমাণ কমানোর সুযোগ পায়, তবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। রপ্তানি একদম শূন্যের কোঠায় চলে যাবে না, তবে রপ্তানির বাজারে যে ঊর্ধ্বগতি ছিল, তা হারাতে হবে। অনেক বড় বড় কারখানার মালিক যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ওপর নির্ভর করে বিশাল অঙ্কের পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন। তারা এখন বিপদে পড়বেন।’
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘তৈরি পোশাকশিল্পে বাড়তি শুল্কের প্রভাব হবে ভয়াবহ। পণ্য রপ্তানি কমে যাবে। যেসব কারখানার মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির ৫০ শতাংশ বা তার বেশি যুক্তরাষ্ট্রে যায়, সেসব প্রতিষ্ঠান বেশি বিপদে পড়বে। আবার যেসব কারখানা দেশটিতে কম রপ্তানি করে, সেগুলো কম ঝুঁকিতে থাকবে।’