“জুলাই আন্দোলনে আমাদের পরিবারে নেমে আসে ‘রোজ কিয়ামত’। ছেলে নাহিদ ইসলাম পুরো আন্দোলনের নেতৃত্বে। ফলে সদস্যদের ঘরে থাকা দায়। একমাত্র মহান আল্লাহই ছিলেন সহায়। দ্বিতীয়বার ডিবি অফিসে নাহিদদের নেওয়া হলো। অত্যাচার, নির্যাতন, প্রাণনাশের হুমকি। পরিবারের একজন নারী সদস্যকেও নেওয়া হলো। ডিবি অফিসে গিয়ে সন্তানের সাক্ষাৎ পাই না। গোপন প্রহরীরা বলে, ওরা আছে। তবে ‘ডু অর ডাই’ পরিস্থিতি। আন্দোলনের শেষ না দেখে ছাড়বে না।”
বিশেষ সাক্ষাৎকারে নাহিদ ইসলামের বাবা বদরুল ইসলাম জমির। দুর্লভ সব তথ্যের ভান্ডার তিনি। বললেন, ‘আমি শিক্ষক মানুষ, তবে রাজনীতিতে সক্রিয়। ছাত্রজীবন থেকে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত। হাসিনা সরকারের আমলে ১১ মামলার আসামি। তবে মামলা আর নির্যাতন দিয়ে দমানো যায়নি। আমার ছেলে নাহিদের ধমনিতে রাজনীতির রক্তকণিকা। আমাদের চেয়ে ১০ গুণ সাহসী সে। পারিবারিকভাবে তারও বিএনপি করার কথা। কিন্তু ৫ আগস্ট থেকে বিএনপির সুকীর্তি নষ্ট হয়ে গেছে। এত চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মববাজি-কল্পনার বাইরে। আজতক এসবের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে বিএনপির ব্যর্থতা থেকে এনসিপি জন্ম নিল। সরকারের উপদেষ্টা থেকে নাহিদরা নতুন রাজনীতির হাল ধরল।’
উল্লেখ্য, বদরুল ইসলাম জমিরের পৈতৃক বাস ঢাকার বেরাইদ, বাড্ডা। পেশাগতভাবে শিক্ষক, কোচিং সেন্টারের কর্ণধার। ১৯৮৪-তে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ‘নটর ডেম’ থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিংয়ে অনার্স-মাস্টার্স। ঘর-সংসার করা গৃহিণী মমতাজ ইসলাম, দুই সন্তান। নাহিদ ইসলামের কনিষ্ঠজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। জনাব জমিরের বসবাস ঢাকার দক্ষিণ বনশ্রীতে। মসজিদ বাজারস্থ সুবিশাল ‘প্রতীক হাউজ’-এ। ৫ আগস্ট ’২৪-এর পর পুরোপুরি দাম্পত্যে নাহিদ। পুরোনো বসবাস ছেড়ে বাস করছেন বেইলি রোডে।
উল্লেখ্য, নাহিদ ইসলামের জন্ম ২৮ এপ্রিল ১৯৯৮। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স। ২৪-এর ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের মুখ্য সমন্বয়ক। অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। নতুন দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’র (এনসিপি) আহ্বায়ক।
জুলাই আন্দোলনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এই বিশেষ সাক্ষাৎকার। নাহিদ ইসলামের পিতা বদরুল ইসলাম জমির ছিলেন প্রাণবন্ত। দক্ষিণ বনশ্রীতে হাউজিং চত্বরে চলে প্রশ্নোত্তর পর্ব। ব্যক্তিগতভাবে ভীষণ রকম ব্যস্ত তিনি। দর্শনার্থীদের ভিড় আর টেলি-ব্যস্ততা চলমান। সন্ধ্যায় ‘প্রতীক হাউজ’-এর ‘বকুল’ ভবনে গিয়ে হতবাক। বাসার ড্রয়িংরুমে তিল ধারণের জায়গা নেই। পরে হাউজিং চত্বরের দোলনায় গিয়ে উভয়ে বসি। সাক্ষাৎকার শেষে আড্ডা দিই একটি টং-দোকানে। আড়ম্বরহীন মানবিক জীবনযাপন ওনার। সঙ্গে ছিলেন এনসিপি, নীলফামারীর কর্ণধার এম এ মজিদ। এ ছাড়া জনাব জমিরের শিক্ষা-সতীর্থ মোশতাক খান।
জনাব জমির বললেন, আমার আরেকটি পরিচয় আছে। কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌসী রহমানের ছেলে রুবাইয়াৎ আমার বন্ধু। ‘নটর ডেম’ কলেজে একসাথে ‘ইন্টারমিডিয়েট’ পড়েছি। আপনাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলে জানতাম। বললাম, জি, ফেরদৌসী আপা আমার ফুপাতো বোন। রুবাইয়াৎ আমার ভাগ্নে, এখন আমেরিকা প্রবাসী। জমির বললেন, এই তো দুই মাস আগে আসলো। বললাম, জি, ওর বাবা রেজা দুলাভাই মারা গেছেন। মৃত্যু-পরবর্তী কার্যাদি সারতে দেশে এসেছিল।
দোলনায় জমির একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলেন। বললেন, আন্দোলনকালে বেশি করে ফোন দিত। সব সময় সাবধানে থাকতে বলত। প্রয়োজনে আমেরিকায় যেতে বলত। কিন্তু আমার বউ-সন্তান রাজি হয়নি। আমরা মাটি কামড়ে বাংলাদেশেই পড়ে আছি। মহান আল্লাহ সুনজর দিয়েছে বলে ফ্যাসিস্টরা পালিয়েছে। কিন্তু নতুন ফ্যাসিস্টদের জন্ম দেখে আবার আতঙ্কিত হচ্ছি।
প্রশ্ন করলাম, আপনার কাছে এত লোক কেন? ফোনের পর ফোন আসছে, এগুলো কি তদবির?
জমির বললেন, আমরা রাজনৈতিক পরিবার। মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থাকি। শেখ হাসিনার ১৫/১৬ বছর দুঃসহকাল গেছে। এলাকার মানুষ সঠিক বিচার পায়নি, সাহারাও পায়নি। আমার ছেলে সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিল। ক্ষমতায় বসেছিল, অনেকের প্রত্যাশা তো থাকবেই। আমরা পারতপক্ষে মানুষের কল্যাণ করে যাই। কিন্তু কোনো রকম অর্থনৈতিক লেনদেন নেই। আমি শিক্ষক মানুষ, আদর্শই বড় সম্পদ। সন্তানকেও সেভাবেই লালন-পালন করেছি।
বললেন, আন্দোলনকালে কত রকমের প্রলোভন এল। হাসিনা সরকার বিশাল অঙ্কের টাকায় কিনতে চেয়েছিল। কচুক্ষেতের ডিজিএফআইয়ের আয়নাঘরে আটকে রাখল। নির্যাতন করল আবার কোটি টাকার লোভও দেখাল। কিন্তু নাহিদসহ সোনার ছেলেরা আদর্শকে বিক্রি করেনি। বাবা-মা হিসেবে কষ্ট চেপে রাখতে পারতাম না। কিন্তু নাহিদ বলত, সন্তান তো দুটো। একটা গেলে না হয় আরেকটা আছে। মরতে তো একদিন হবেই, ভাবনা কী!
আবার প্রশ্ন করি-সেবার ডিবি অফিসে কী হলো? মধ্য জুলাইয়ে পাঁচ ছাত্রনেতা আটক। সন্তান নাহিদকে দেখতে ‘মিন্টো রোডে’ গেলেন। নাহিদের মমতাময়ী মা মমতাজ বেগম। সঙ্গে দুই ফুপু, এক খালা। কিন্তু আপনাদের ফিরিয়ে দেওয়া হলো। তবে ডিবি-প্রধান হারুনুর রশিদ কথা বলেছিলেন। কী কথা হয়েছিল ‘ভাতের হোটেল’-খ্যাত হারুন সকাশে?
জি কথা হয়েছিল, স্বীকার করি। আমরা জানতাম, অনেক নির্যাতন চালানো হয়েছে। এ জন্য পরিবারের সবাই আতঙ্কগ্রস্ত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিল। ওরা ৪/৫ দিন ধরে আটক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-অভিভাবকেরাও দেখতে গেল। কিন্তু শত অনুরোধেও সাক্ষাৎ পেল না। সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাজউদ্দীনপুত্র সোহেল তাজও সাক্ষাৎ চান। ৪/৫ ঘণ্টা পর কিছুটা সুযোগ পান। কিন্তু আমরা পারিবারিক অভিভাবকেরা বিফল মনোরথে ফিরি। সে সময় ডিবি-হারুন এক মিনিট কথা বলেন। একটু আশ্বাসের সুর লক্ষ করি। বললেন, নাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র। আমিও একই ডিপার্টমেন্ট থেকে পাস করেছি। সিনিয়র ভাই হিসেবে চেষ্টা করছি সমাধান টানার। ওদের সাথে আলোচনা চলছে, একটা কিছু হবে। এটুকু বলতে পারি, ওরা গুম হবে না।
আবার প্রশ্ন-সেবার তো ছেড়ে দেওয়া হলো। আন্দোলনের যবনিকাসুলভ মুচলেকা দিয়ে প্রত্যাবর্তন। কিন্তু উত্তাল হওয়ার আন্দোলন তো থামানো যায়নি। বিষয়টি কীভাবে নতুন করে প্রজ্বলিত হলো? সন্তান নাহিদের সঙ্গে কি নিয়মিত যোগাযোগ হতো?
জমির বললেন, প্রায়ই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতো। সরকার ‘ইন্টারনেট’ বন্ধ করল। হুটহাট করে কারফিউ দিল। নাহিদ প্রথম গ্রেফতার হয় যাত্রাবাড়ী থেকে। এক বন্ধুর বাসায় লুকিয়ে থেকে আন্দোলন চালাচ্ছিল। ওই সময় ৩/৪ দিন কোনো খোঁজখবর ছিল না। আন্দোলনকারীদের পরিকল্পনাগুলো অভিনব ছিল। সামনের সারির নেতারা গ্রেফতার হলে আরেক টিম প্রস্তুত। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এত সব তথ্য পেত না। ফলে তারা চালে বারবার ভুল করেছে।
আবার প্রশ্ন, ভেঙে পড়া আন্দোলন চাঙা হতো কীভাবে?
জি, সঠিক প্রশ্ন, আন্দোলনকারীরা হতাশও হতো। তবে সরকারপক্ষই নেগেটিভ কর্ম দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করত। যেমন ১৪ জুলাই চীন থেকে ফিরলেন স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী। আন্দোলনকারীদের শেখ হাসিনা বললেন ‘রাজাকারের সন্তান’। আর যায় কই-‘শিক্ষাঙ্গন’ অপমান বোধ করল। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলা। ছাত্রী বা নারীদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন জাতি মানল না। আর ১৬ জুলাই আবু সাঈদসহ ৫ জন নিহত। পরদিন গায়েবানা জানাজা, রাতে ‘কমপ্লিট শাটডাউনে‘র ঘোষণা। আমার ছেলে নাহিদ ইসলাম ঘোষণাটি দিয়েছিল। সর্বসাধারণ সেবারই প্রথম সোচ্চার হয়ে ওঠে।
আবারও প্রশ্ন, জুলাই আন্দোলনকালে ঈদ, মহররম। পারিবারিকভাবে সেগুলো পালিত না উপেক্ষিত হয়েছে?
অবশ্যই উপেক্ষিত-কারণ তখন তো ‘কারবালা পরিস্থিতি’। সন্তানকে নিকটে না পাওয়ায় মায়ের কী আহাজারি। ১৭ জুলাই পবিত্র আশুরা বা ১০ মহররম। আন্দোলনের শাটডাউন বনাম সরকারের কারফিউ। ১৯ জুলাই নাহিদ গোপনে বনশ্রীর বাসায় ফিরল। কিন্তু থাকতে পারল না, আবার পলায়ন। পরে বন্ধুর বাসা থেকে মধ্যরাতে আটক। ২১ জুলাই ভোরবেলা জুরাইন এলাকায় ফেলে যায়। সাভারের ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে’ চিকিৎসা নিতে গিয়ে পুনঃপ্রস্তুতি। আবার ডিবি অফিসে আটক, পয়লা আগস্ট মুক্তি। তখন ৯ দফার আন্দোলন চলছিল। অবশেষে সমন্বয়কদের সমন্বয়ে শহীদ মিনারে নতুন চমক। ৩ আগস্ট নাহিদের কণ্ঠে ঐতিহাসিক ‘এক দফা’র ঘোষণা। যার পরিপ্রেক্ষিতে ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতন ও পলায়ন।
কিন্তু নাহিদ ইসলামরা রাজনৈতিক দল ‘এনসিপি’ গঠন করল কেন?
মি. জমির বললেন, এ ছাড়া উপায় কী? হাসিনা পতনের আন্দোলনটিই তো রাজনৈতিক পদক্ষেপ। অন্যান্য বিরোধী দল যা পারেনি, তারা তা পেরেছে। কৌশল, বুদ্ধিমত্তা, মেধা, প্রজ্ঞা কাজে লাগিয়েছে। বিএনপিও আন্দোলনে ছিল, কিন্তু নেতৃত্ব দিতে পারেনি। ১৫০০ লাশের রক্তের দাগ শুকায়নি। কিন্তু হাসিনা পতনের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে উৎসব করল। এ ছাড়া অবৈধ ক্ষমতা প্রদর্শনের মহোৎসব চালাচ্ছে। সংস্কার হয়নি, হত্যার বিচারও হয়নি শুধু নামকাওয়াস্তে নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের দায়বদ্ধতার বিষয়ে সচেতনতা নেই। অন্যদিকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগও ক্ষমা চায়নি। ধর্মপ্রধান দলগুলোর ভূমিকাও ঘোলাটে। তাই স্বতন্ত্র রাজনীতির স্বার্থে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ গঠিত হয়েছে। নতুন হলেও এটি মেধাবীদের ফোরাম। প্রায় আড়াই কোটি নতুন ভোটার এর প্রধান শক্তি।
অভিযোগ উঠেছে, ফের নির্বাচন পেছানোর পাঁয়তারা চলছে। এনসিপি সাবালক হলে তবেই নির্বাচন-এমন গুজব চতুর্দিকে। ‘পিআর পদ্ধতি’ বা সংখ্যানুপাতিক হারে সংসদীয় আসন প্রাপ্তির দাবি। বিএনপি-বহির্ভূত দলগুলোর সঙ্গে ‘এনসিপি’ও শামিল হলো কেন?
বদরুল ইসলাম জমির বললেন, এটা সময়ের দাবি। ২৪-এর ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের রূপকল্প এটি। আওয়ামী ফ্যাসিস্টের চেহারা আর জনগণ চায় না। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে বিএনপি আবার ফ্যাসিস্ট হতে চায়। ড. ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের লন্ডন বৈঠক বিতর্কিত। ফেব্রুয়ারি ’২৫-এর নির্বাচনী রোডম্যাপ তো একদলীয় চাপের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু বহুদলীয় স্বার্থ বিবেচনা করতে হবে। জামায়াত নিবন্ধন-প্রতীক ফিরে পেল ২০২৫-এর জুনে। এনসিপি সেগুলো পাওয়ার পথে। এরপর রাজনৈতিক ও নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য সময় তো প্রয়োজন। কমপক্ষে দুই বছর প্রস্তুতিমূলক সময় তারা পেতেই পারে। বিয়ে দিলেই কি পরের মাসে সন্তান নেওয়া সম্ভব? ১০/১১ মাস অন্তত অপেক্ষা করতে হয়। ২০২৫-এর শেষভাগে নিবন্ধন দিলে ৬ মাসে ভোট করা কি যৌক্তিক। কমপক্ষে ২ বছর সময় চাইতেই পারে নব-নিবন্ধিত দলগুলো। আইনের আশ্রয় নিলে নিশ্চয় আদালতও তা বিবেচনা করবে। সেই সাথে ‘পিআর পদ্ধতি’-ও সংস্কারের মাধ্যমে সিদ্ধান্তভুক্ত হোক। ‘জুলাই ঘোষণা’র আলোকে চূড়ান্ত হোক সংবিধান, নির্বাচন, রাষ্ট্র-সংশোধন।