প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠক রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজমান অস্থিরতার অবসান ঘটিয়ে সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারা প্রবাহিত করবে বলেই আশা করা হয়েছিল। মনে করা হয়েছিল, হিংসা, প্রতিহিংসা, সংঘাতের রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও তা সংহত করতে এই বৈঠক কার্যকর ভূমিকা রাখবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হয়নি। বরং এই বৈঠক রাজনৈতিক সংকট বাড়িয়েছে। তবে দলগতভাবে বিএনপির রাজনীতিকে শক্তিশালী, গতিময় করতে এটি অবদান রেখেছে।
দেশের রাজনৈতিক ময়দানে জাতীয়তাবাদী শক্তির ধারক-বাহক বিএনপির বিপরীতে ধর্মীয় রাজনীতির একনিষ্ঠ আনুগত্যকারী জামায়াত ক্রিয়াশীল। বিএনপির সঙ্গে রয়েছে ছোট ছোট দল, যারা জাতীয়তাবাদী চেতনা ও ক্রিয়াকর্মে বিশ্বাসী। এরা সংখ্যায় নেহাত কম না হলেও জাতীয় রাজনীতিতে এদের কোনো ভূমিকা নেই। নাম ও প্যাডসর্বস্ব এসব দলের বিপরীতে ধর্মীয় রাজনীতিতে বিশ্বাসী দলগুলোও সক্রিয়। তারাও সংখ্যায় কম নয়। প্রধানত জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, আদর্শের অনুসারী, অনুগামী হলেও পৃথক রাজনৈতিক সত্ত্বা নিয়েই নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখছে। এদের কেউ কেউ জামায়াতের চেয়ে অধিকতর বিএনপি-ঘেঁষা। রাজনৈতিক মেরুকরণে জামায়াত ও বিএনপি চেষ্টা করছে ছোট ছোট এসব দলকে কাছে টানা, অভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থানে আনা। এই দলগুলোও অভিন্ন স্বার্থ ও উদ্দেশ্যে স্বপ্রণোদিত হয়ে মূল স্রোতধারায় মিলিত হতে নানাভাবে যথাযথ ভূমিকা রাখছে।
দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক অবস্থায় এবং জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক মেরুকরণ প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। সরকারপ্রধান ড. ইউনূস ক্ষমতায় থেকে পূর্ববর্তী একাধিক সরকারপ্রধানের মতো রাজনৈতিক দল গঠনে উদ্যোগী নন। এ নিয়ে তার মধ্যে আগ্রহও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যদিও তাকে ভর করে দল গঠন এবং সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে দীর্ঘমেয়াদে মসনদ দখলে নিতে নানামুখী কার্যকর ভূমিকা রেখে চলেছে অসংখ্য প্রভাবশালী ক্ষমতালোভী। ড. ইউনূস এই ক্ষমতালিপ্সু চক্রকে শেষ করে নিজেকে কতটা দূরে রাখতে পারেন, তা পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষ।
প্রধান উপদেষ্টাকে প্রভাবিত করা এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা নিশ্চিত করার নানামুখী চেষ্টা দেশে-বিদেশে চালানো হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা অবশ্য ঘোষণা করেছেন, একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও নজিরবিহীন নির্বাচন তিনি করে যেতে চান, যা এদেশে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তার এই প্রশংসনীয় মানসিকতা, প্রস্তুতি, উদ্যোগ কীভাবে কতটা সফল করতে পারেন, তা নির্ধারণ করবে ইতিহাসে তার স্থান এবং দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক ছিল পূর্বনির্ধারিত। প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকেই আগ্রহ প্রকাশ করার পরিপ্রেক্ষিতে বৈঠকের আয়োজন করা হয়। বৈঠকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নির্বাচনসহ দেশের বর্তমান ও সম্ভাব্য রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়। স্বভাবতই বিএনপির প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াত বিষয়টি সহজভাবে নেয়নি। ড. ইউনূসকে যারা ক্ষমতায় বসিয়েছেন সেসব শিক্ষার্থী ও তাদের সংগঠন জাতীয় নাগরিক পার্টিও তা সানন্দচিত্তে নেয়নি। বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বার্থচিন্তায় তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। তবে প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা জানানো হয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এই বলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে, ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকে নির্বাচন যতটা না গুরুত্ব পেয়েছে; সংস্কার এবং শেখ হাসিনা ও তার সরকারের মন্ত্রীদের বিচারের ব্যাপারটি ততটা গুরুত্ব পায়নি। এ নিয়ে সরকারও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা প্রথমে ঘোষণা করেন, আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপির শীর্ষ নেতার সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচন এগিয়ে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়। এতে বিএনপি সন্তুষ্ট হলেও জামায়াত নয়। তারা আরও পরে নির্বাচনের পক্ষে। নবগঠিত এনসিপিও বিলম্বিত নির্বাচন চায়। সারা দেশে সাংগঠনিকভাবে দল গুছিয়ে নিতেই তারা সময় নেওয়ার পক্ষে। অপরদিকে নির্বাচন বিলম্বিত হলে বিএনপির ক্ষমতার স্বপ্ন ভঙ্গ হতে পারে। দ্রুত ক্ষমতা নিশ্চিত করতেই তারা দ্রুত নির্বাচন চায়। এ অবস্থায় কোন পক্ষে যাবে অন্তর্বর্তী সরকার? তাদের সিদ্ধান্ত দৃশ্যমানভাবেই কোনো না কোনো পক্ষের অনুকূলে যাচ্ছে!
বিএনপি-জামায়াতের ক্ষমতার লড়াইয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে সরকার। তাদের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হলে এই সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানই কঠিন হয়ে পড়বে। নির্বাচনী ফলাফল কোনো পক্ষের অনুকূলে না এলে নির্বাচন-পরবর্তী গোলযোগ, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে তারা, যা গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকেই ব্যাহত করে তুলতে পারে।